কেন্দ্রিয় মনশ্চিকিৎসা সংস্থানে কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে অনেকেই থাকত কলকাতায়। তারা প্রায়ই দ্বিতীয় শনিবারের সরকারি ছুটির সুযোগ নিয়ে মাসে একবার শনি–রবিবারের ছুটি কাটাতে চুপচাপ চলে যেত দেশে। আবার সোমবার ভোর–ভোর ফিরে এসে কাজে যোগ দিত সক্কাল সক্কাল।
রাঁচি থেকে কলকাতা যাবার সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল বাস। সন্ধেবেলা কাজটাজ সেরে বাসে চড়ে বসা, ভোর–ভোর এসপ্ল্যানেডে নামা। তবু কিছু লোক ট্রেনটাই পছন্দ করত – যেমন আমি। ট্রেনের সুবিধে ছিল এই, যে সারা রাত শুয়ে ঘুমোন যেত (যেটা খুব জরুরি)। বাসের ঝাঁকুনিতে কোমর ব্যথা করে, জানলায় মাথা ঠুকে কপাল ফুলিয়ে কলকাতা পৌঁছতে হত না। আমার ধারণা যারা বাসে যেত, তারা বাড়ি গিয়ে অন্তত ঘণ্টা চারেক ঘুমোত। আর আমি, সকালবেলায় ট্রেনেই দাঁত–টাত মেজে, প্রাতঃকৃত্য শেষ করে, বাড়ি গিয়ে চা খেতাম।
ফেরার পথেও একই ব্যাপার। যারা শনি–রবি কাউকে কিছু না বলে দেশে পালিয়েছে, তারা বাসে ফিরত যাতে ছ’টা–সাতটার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে হস্টেলে। আর যারা আমার মতো ছুটি নিয়ে গেছে, তারা পাশ ফিরে আপার বার্থে ঘুমিয়ে নিত। ট্রেন সময়মত পৌঁছলে হাসপাতাল যেত, আর লেট করলে দেরি করে হাসপাতাল গিয়ে বলত, “ট্রেন লেট থা, বস্।”
একবার মেঘমন্দ্র আর আমি দু’জনেই একই সময়ে কলকাতায়। ফিরব একই সঙ্গে, তাই টিকিটও কাটা একসঙ্গে। আমি ট্রেন মিস করা ব্যাপারটা খুব ডরাই, তাই দশটা কুড়িতে ট্রেন হওয়া সত্ত্বেও সাড়ে সাতটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে তৈরি। মেঘমন্দ্রর বাড়ি আমার বাড়ির কাছেই। আগের দিন ওকে ফোন করেছিলাম।
“কী রে? কখন বেরোবি? আমি ট্যাক্সি করে যাব। সাতটা কুড়িতে বেরোব। তোকে তুলে নেব?”
মেঘমন্দ্র খুব অবাক হয়ে বলেছিল, “সাতটা কুড়ি? তখনও তো ট্রেন ছাড়তে তিন ঘণ্টা দেরি! আমি তখন থাকব যাদবপুরে। মাসির বাড়িতে। ডিনার খেয়ে বাড়ি যাব, বাড়ি থেকে হাওড়া বড়োজোর একঘণ্টা। দেরি হলে একঘণ্টা দশ মিনিট। এত তাড়া কিসের? আমি সাড়ে ন’টায় বেরোব।”
আমার পোষাবে না। সময় মতো বেরিয়ে পড়লাম। হাওড়া স্টেশন পৌঁছে গেলাম সাড়ে আটটার মধ্যে, প্ল্যাটফর্মে বসে বই পড়লাম দু’ঘণ্টা, তারপর, ন’টা পঞ্চাশে ট্রেন দিল, খুঁজে খুঁজে গিয়ে বার্থে বসলাম।
সময় যায়, মেঘমন্দ্রর দেখা নেই। আস্তে আস্তে আমার মনোযোগ বই থেকে কমতে শুরু করল। আগেই বলেছি – মোবাইল ফোনের যুগ নয়, সুতরাং জানলা দিয়ে যতটা পারা যায়, মাথা বের করে গরাদে ঠেসে ধরে পিছনে দেখা ছাড়া গতি নেই। লাভ হল না। মেঘমন্দ্র এল না – ট্রেন ছেড়ে দিল।
একটু পরে টিকিট চেকার এলেন। বললাম, “এই বার্থে যিনি আছেন তিনি আসবেন আমি জানি, কিন্তু…”
টি.টি. বললেন, “অসুবিধে নেই। এমনিতেই খড়্গপুর অবধি তো কাউকে দেব না, সুতরাং উনি যদি অন্য কোনও বোগিতে উঠে থাকেন, এসে যাবেন। খড়্গপুর ছাড়ার পরেও কেউ না এলে আর.এ.সি–কে দিয়ে দেব।”
খড়্গপুর ছাড়ার পরে টি.টি. বার্থটা আর.এ.সি–কে দিয়ে দিলেন। আমরা আলো–টালো নিভিয়ে শুতে গেলাম।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল, দেখি সূর্যোদয়ের আভাস আসার আগের গভীর অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলেছি। টি.টি. নিজের আসনে বসে ঢুলছিলেন, বাথরুমের কাজ সেরে বেরিয়ে দেখি জানলা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “কত লেট?”
উনি বললেন, “বুঝছি না। মুরিতে একঘণ্টা লেট ছিল। এখন আরও বেশি।”
বুঝলাম আজ লাঞ্চের আগে হাসপাতাল যাওয়া হবে না। গিয়ে শুলাম।
ট্রেন রাঁচি পৌঁছল বেলা প্রায় দশটার কাছাকাছি। স্যুটকেস নিয়ে নেমে আড়মোড়া ভাঙছি, আর অটোওয়ালারা ঘিরে ধরেছে, “কহাঁ জাইয়েগা?”
বলছি, “বিদ্যাপতি নগর,” হঠাৎ কানের পেছনে শুনলাম, “থাক থাক, আর অটো দরাদরি করতে হবে না। চ’, চ’।”
চমকে ফিরে দেখি মেঘমন্দ্র মিট্মিট্ করে হাসছে।
বললাম, “তুই কোত্থেকে? কোন কামরায় ছিলি?”
বলল, “চ’, বলছি।”
বললাম, “একটা অটো নিয়ে নিই – আমি নেমে যাব, তুই বাড়ি চলে যাস।” রাঁচিতেও আমাদের বাড়ি ছিল পাশাপাশি পাড়ায়।
মেঘমন্দ্র বলল, “গাড়ি এনেছি।”
সে আবার কী!
“চ’ তো! সেই কথাই তো বলছি।”
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দুজনে গাড়িতে বসলাম। মেঘমন্দ্রর গাড়ি। শুক্রবার এই গাড়িই ওর রাঁচির বাড়ির গ্যারেজে রেখে তালা বন্ধ করে দু’জনে অটো নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলাম। আজ সোমবার সকালে সে গাড়ি স্টেশনের পার্কিং–এ কী করে দাঁড়িয়ে আছে?
মেঘমন্দ্র বলল, “তোকে তো বললাম তোর সঙ্গে যাব না – তারপরে কাল ধীরে–সুস্থে খেয়ে দেয়ে উঠে মামাবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরে বাক্স নিয়ে থেকে বেরিয়ে দেখি কোথাও একটা ট্যাক্সির দেখা নেই। একটু পরে ‘সল্ট লেক হইতে হাওড়া’ মিনি বাস এল। উঠলাম। বাস ঢিকঢিক করে চলছে তো চলছেই। আমি বুঝছি দেরি হবে, কিন্তু কিছু করার নেই। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে মনে মনে বলছি, ভগবান, ট্রেনটাকে একটু লেট করিয়ে দাও।”
বাস ঢিকঢিক করে চলছে, ট্রেন নিগঘাৎ মিস হবে, এর মধ্যে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে… এই হল মেঘমন্দ্র। বললাম, “একদম ঠিক টাইমে ছেড়েছিল।”
“তাই তো বলছি। রাঁচি এল আড়াই ঘণ্টা দেরি করে, তার পাঁচ মিনিট যদি হাওড়ায় দেরি করত, আমি ধরে নিতাম – দৌড়ে স্টেশনে ঢুকে দেখি ট্রেনের পিছনের লাল আলোটা শুঁউঁউঁউঁউঁ করে শুষে গিয়ে নেই হয়ে গেল।”
জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে?”
“জানতে চাইলাম, খড়্গপুরের নেক্সট ট্রেন কখন? বলল, এক্ষুনি ছাড়বে। ওমুক প্ল্যাটফর্ম। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম, ট্রেনও ছাড়ল।”
আমি বললাম, “কিন্তু লোক্যাল তো তিন ঘণ্টা নেয় খড়্গপুর পৌঁছতে। হাতিয়া এক্সপ্রেস তো দু’ঘণ্টায় যায়।”
“আরে, তাই তো ভাবছিলাম – তোদের যদি লেট হয়! তা পৌঁছলাম গিয়ে খড়্গপুরে, কিন্তু তোরা ততক্ষণে আবার ছেড়ে গেছিস। জামশেদপুরের কোন ট্রেন আসবে? জানলাম বম্বে মেল। হাওড়া থেকে রওয়ানা হয়ে গেছে। খড়্গপুর হয়ে টাটানগর। বসে রইলাম। এল বম্বে মেল। কিন্তু সে–ও যখন গিয়ে টাটা পৌঁছল, তখন তোরা আধঘণ্টা লেট – কিন্তু ছেড়ে গেছিস। কী আর করা, ওয়েটিং রুমে গিয়ে একটা ঘুম দিলাম। চারটের সময় বেরিয়ে অটো ধরে বাস–স্ট্যান্ড। ফার্স্ট বাস ধরে বাড়ি গেলাম সাড়ে ছ’টা। তখন তুই অলরেডি একঘণ্টা লেট। হসপিটাল গিয়ে সই করলাম, পেশেন্ট টেশেন্ট দেখলাম। তারপর ভাবলাম যাই, তোকে স্টেশন থেকে তুলে আনি। তোর তো আজ সকালে হাসপাতালে যাওয়া হল না।”
আমি ভাবলাম, তাও তো আমি সকালে ট্রেনের বাথরুম ব্যবহার করতে পেরেছি। এই রকম সার্কাস করতে করতে কাজে ফেরা আমার দ্বারা হত না।
টাটানগর থেকে রাঁচি যেতে গেলে পাহাড় চড়তে হয়। গাড়ির রাস্তা পাহাড় কেটে উঠেছে, কিন্তু ট্রেনকে উঠতে হয় পাহাড়ের কোল বেয়ে, মুরি জংশন হয়ে। তাই ভোর চারটেয় বাসে চড়ে সকাল ছটায় রাঁচি পৌঁছন’ গেলেও, ট্রেন রাত্তির দুটোয় টাটা ছেড়েও রাঁচি পৌঁছয় সকাল সাড়ে সাতটায়। আর সেইজন্যই আমাদের সঙ্গীরা অনেক সময় টাটা পৌঁছে যদি বুঝত ট্রেন লেট করবে, তখন ট্রেন ছেড়ে বাস ধরত’ রাঁচি ফিরতে।
নাসিম আবার আরও এক–কাঠি ওপরে। ও আসত বম্বে থেকে, টাটা অবধি টিকিট কেটে। টাটানগর পৌঁছত মাঝরাত্তিরে। স্টেশনে নেমে জিজ্ঞেস করত, “হাওড়া হাতিয়া এক্সপ্রেসের কী খবর?” উত্তর শুনে যদি বুঝত সেই ট্রেন ধরলে সময়মত পৌঁছন’ যাবে না, তাহলে বাসের সন্ধানে যেত। না–হলে হাতিয়া এক্সপ্রেসে উঠে কোনও টিটিকে ধরে টিকিট এক্সটেন্ড করে নিত রাঁচি অবধি।
রাঁচির পাট চুকে যাবার পর নাসিমকে সার্টিফিকেট ইত্যাদি ছাড়াই বম্বে ফিরতে হয়েছিল বিদেশ যাবার কাগজপত্র তৈরি করতে। মাসখানেক পরে আমরা যখন খবর দিলাম, “নাসিম, এবার আয়, শোনা যাচ্ছে তোর সার্টিফিকেট সব তৈরি। ক্লার্করা বলছে, ‘নাসিম স্যার কাঁহা? বতাইয়ে সার্টিফিকেট রেডি হ্যায়।’” তখন ও ফিরল শেষ বারের মতো, সব কিছু গুছিয়ে (এবং ঘুচিয়ে), সার্টিফিকেট নিয়ে চলে যাবার জন্য।
সোমবার ফেরার কথা। কিন্তু সকাল থেকে কেউ নাসিমকে দেখেনি। আমি আর মেঘমন্দ্র মাঝে মাঝে আউটডোর আর হাসপাতালের ভিতরের ক্যান্টিনে খবর নিচ্ছি – আসেনি। দুপুরে দেখি আউটডোরের ক্যান্টিনে নাসিম বসে আছে। মুখ দেখেই বুঝলাম, মেজাজ তিরিক্কি। বললাম, “কী হল?”
এতই মেজাজ খারাপ, যে ভালো করে কথা বলা দূরস্থান, হাই–হ্যালোটুকুও বলল না। এমন সময় আউটডোরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল অরূপ। ক্যান্টিনের ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে হাঁক পেড়ে এক কাপ কফি চেয়ে যেই আবার ফিরেছে, নাসিম উঠে গেল। খানিকটা গিয়ে পেছন ফিরে বলল, “তোদের ওই অরূপকে বলে দিস, সিনিয়রদের সঙ্গে ভদ্রভাবে বিহেভ করাটা তোদের কাছ থেকে যেন শিখে নেয়।”
অরূপ নাসিমের ছেড়ে যাওয়া সিটে সবে বসতে যাচ্ছিল। থমকে গেল। ছেলেটা আমাদের চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোটো, কিন্তু বন্ধুস্থানীয়। কখনও মনে হয়নি যে সে সিনিয়রদের যথেষ্ট সম্মান দেয় না। আমরা একটু অবাক হয়েই ওর দিকে তাকালাম। নাসিম ততক্ষণে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। একটু অপেক্ষা করে অরূপ যখন বুঝল যে নাসিম ফিরে আসছে না, তখন বলল, “আজ নাসিমভাই মস্তো ঝামেলার হাত থেকে বেঁচে গেছে।”
কী হয়েছিল?
অরূপ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “আরে আর বলবেন না। আমি তো আজ ফিরেছি কলকাতা থেকে। হাতিয়া এক্সপ্রেস প্রচণ্ড লেট করেছে। টাটা পৌঁছেছে তখনই ভোর প্রায় পাঁচটা। আমি তাড়াতাড়ি নামছি। জাস্ট নামব, দেখি নাসিমভাই ট্রেনে উঠছে। আমাকে দেখে বলল, ‘অরূপ, তুই নেমে যাচ্ছিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। আজ গাড়ি বারোটার আগে রাঁচি পৌঁছবে না। বাসে যাব।’
“নাসিমভাই বলল, ‘ভেরি গুড। আমাকে চট্ করে তোর টিকিটটা দে। আমার টিকিটটা নিয়ে তুই চলে যা।’
“আমি অবাক! প্রথমে বুঝতেই পারিনি নাসিমভাই কী বলছে। বুঝিয়ে বলল, ‘আমি টাটানগর অবধি টিকিট কেটেছি। এখন আমাকে টিকিটটা এক্সটেন্ড করতে হবে। তার চেয়ে তুই আমার টিকিটটা নিয়ে চলে যা। তোর নাম নাসিম আলি। আর আমি তোর টিকিটটা নিয়ে অরূপ ঘোষ হয়ে চলে যাই। আমাকে আর ফালতু পয়সা খরচা করতে হবে না।’
“নাসিমভাই এসব বলছে, আর পেছনে টি.টি. উঠেছে। আমি কী বলব বুঝতে পারছি না, বলছি, ‘আরে আপ আইয়ে তো – নিচে প্ল্যাটফর্ম তক্ আইয়ে,’ নাসিমভাই তত রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘তোর টিকিট আমাকে দে, আমার টিকিটটা তুই নে – তুই নাসিম আলি হয়ে চলে যা, আমি অরূপ ঘোষ হয়ে চলে যাই। আমার তো রাঁচি পৌঁছন’র তাড়া নেই…’
“আর টি.টি.-টা ঠিক নাসিমভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে… আমি বলতেও পারছি না টি.টি. আছে… শেষে লোকটা বুঝে গেছে নাসিমভাই কী বলতে চাইছে… খপ করে কাঁধটা চেপে ধরেছে, ‘কেয়া জী, কিসকা টিকেট লেকে জানে কা মৎলব কর রহে হো?’”
ততক্ষণে আমরা হাসতে শুরু করেছি, আর সিনিয়রদের হাসি থেকে অরূপেরও একটু একটু হাসি এসেছে মুখে।
মেঘমন্দ্র জানতে চাইল, “তারপর?”
সাহস পেয়ে অরূপ ওর মতামতও মেলাতে শুরু করল।
“আরে দাদা, যা–ই বলো, নাসিমভাইও একটু আকাট আছে। দেখছিস টি.টি. বুঝে গেছে, তখন একটু সমঝে গেলেই হয়, তা নয়, ফট করে টি.টি.-র সঙ্গে তক্কো করতে লেগে গেছে। টি.টি.-ও খেপে গেছে, বলে ‘আপ চোর হো। আপকো ম্যায় ট্রেনসে উতারকে আর.পি.এফ.-কে হাওয়ালে কর দুঙ্গা।’ নাসিম ভাই–ও তেড়ে গেছে, ‘কেয়া চোরি কিয়া ম্যায়নে?’ টি.টি. নাসিমভাইকে টেনে প্ল্যাটফর্মে নামিয়েছে, আর.পি.এফ. ডাকে আরকি! তখন আমিই টি.টি.-কে ডেকে বললাম, ‘দেখুন, উনি তো চুরি কিছু করেননি। ওনার টিকিটও ওনার কাছে রয়েছে, আমারটাও আমার কাছেই। অন্যায়টা কী হয়েছে? কিন্তু ততক্ষণে আরও অনেক টি.টি. জমা হয়ে গেছে – আর টি.টি.-টাও তেমনই পাজি, সবাইকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে, ‘এই লোকটা অন্যের টিকিটে ট্র্যাভেল করার কথা ভাবছিল। আমি ধরে ফেলেছি, আবার এমন নির্লজ্জ, বলছে সে নাকি ডাক্তার। ভাবুন, ডাক্তাররা কী রকম বদমাশ হয়…’ সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা, সবাই নাসিমভাইয়ের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন চুরি করে ধরা পড়েছে… এর মধ্যে নাসিমভাই আবার অ্যাবাউট টার্ন হয়ে ট্রেনে উঠেছে… তখন টি.টি.-টা বলেছে, ‘আপ অগর ইস ট্রেন পে চড়া, তো আপকা টিকিট ম্যায় এক্সটেন্ড নেহি করুঙ্গা। আপকো উইদাউট টিকেট করকে পুলিশকা হাওয়ালে কর দুঙ্গা।’ সেই শুনে নাসিমভাই আবার স্টেশন থেকে বেরিয়ে টাটা–রাঁচি টিকিট কেটে ট্রেনে উঠল।”
কে একটা বলল, “এত কাণ্ড না করে তোর মতো বাসে করে এলেই হত?”
“আরে, আমি তো পেছন পেছন টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত গেছি! বললাম, ‘নাসিমভাই আপ চলিয়ে একসাথ বাস মে চলেঙ্গে।’ তখন বলল, ‘ম্যায় জাহান্নাম ভি তেরা সাথ নেহি জাউঙ্গা।’ আমি আর কী করি, চলে এলাম।”
আমরা খানিক মুখ তাকাতাকি করলাম। মেঘমন্দ্র বলল, “চল, নাসিমকে ধরি।” বলে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে বলল, “ওর বক্তব্যও তো শোনা উচিত।”
উচিত তো বটেই। কিন্তু নাসিম এখন কোথায়? ওর তো কোনও কাজ নেই – হাসপাতালের ভিতরে থাকবে না। হস্টেল চলে গেল নাকি? বেরিয়ে দেখি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যাবলার মতো।
আমরা যাওয়া মাত্র হেঁকে বলল, “ওই অরূপের মতো বদ ছেলে আর হয় না। দেখ, তোরা জানিস আমি কক্খনও বম্বে থেকে সোজা রাঁচির টিকিট কাটি না। কবে ট্রেন সময়মত পৌঁছবে না, টাটা এসে দেখব রাঁচির ট্রেন ছেড়ে গেছে, আবার গাঁটের পয়সা খরচা করে বাসের টিকিট কাটতে হয়। তাই বম্বে–টাটা টিকিট কাটি, পৌঁছে যদি দেখি হাতিয়া এক্সপ্রেস আসেনি, তখন প্ল্যাটফর্মে বসে থাকি, হাতিয়া এক্সপ্রেস এলে টি.টি.-কে বলি আমার টিকিটটা এক্সটেন্ড করে দিন। তিন বছর এই করছি – কোনও দিন অসুবিধে হয়নি। আজ সকালে হাতিয়া দেরি করে এসেছে। আমি ভাবছি, আজ তো আর গিয়ে ডিউটি দিতে হবে না। তারচেয়ে ট্রেনেই যাই, ৫–৬ ঘণ্টা আরামসে ঘুমোতে পারব। যেমনই উঠেছি, দেখি অরূপ নামছে। ও বাসে ফিরবে…”
মেঘমন্দ্র বলল, “তাই ওকে বললি ওর টিকিটটা নিয়ে নিবি?”
“হাঁ, ইয়ার! আরে, ও তো নেমেই যাচ্ছে। ওর টিকিটটা রাঁচি অবধিই। আমার পকেটে টাটার টিকিট – এক্সচেন্জ করে নিলেই হত, তা না, ব্যাটা কিছুতেই বের করল না টিকিটটা! খালি তাইরে নাইরে করছে, মাঝখান থেকে টি.টি. উঠে পড়েছে… সে ব্যাটা শুনে নিয়েছে… তারপরে কী লাফড়া… বলে আর.পি.এফ.-এ দেবে!”
“বাঁচলি কী করে?”
“আরে, কী করে আবার! অরূপ তো দিব্যি নিজের টিকিট নিয়ে বাস ধরতে চলে গেল। আমাকে আবার টাটা–রাঁচি টিকিট কাটতে হল।”
“বাসে এলেই পারতি।”
“ট্রেনে ঘুমোতে পারলাম সকাল দশটা অবধি?”
“বাসে এলে ছ’টার মধ্যে পৌঁছে যেতি – হস্টেলে আরামসে ১১টা অবধি ঘুম দিতি।”
“ধ্যেৎ,” বলে নাসিম চলে গেল।
নাসিমের বিলীয়মান চেহারাটা দেখতে দেখতে মেঘমন্দ্র বলল, “ব্যাটাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার।”
“কেন?”
“এ রকম রেলওয়ের টিকিট নিয়ে বেআইনি করতে চাওয়াটা কি উচিত?”
অবাক হয়ে তাকালাম মেঘমন্দ্রের দিকে। আইন কানুন নিয়ে কবে থেকে এত মাথা ঘামান’?
“তাছাড়া বম্বের গুজরাতি হয়ে কী বলে একটা বাঙালি ছেলের নামে গালি দেয়?”
এইবার বুঝলাম। বললাম, “চ’, ডাঃ সিনহা’র ঘরে যাই।”
“সিনহা’র ঘরে কেন?”
বললাম, “চল, গেলেই বুঝবি।”
গেলাম দুজনে ডাঃ সিনহার ঘরে। সিনহা জার্নাল বন্ধ করে বললেন, “কী ব্যাপার? টু মাস্কেটিয়ার্স কেন? থার্ড জন কোথায়? নাসিমের আজ ফেরার কথা ছিল না?”
বললাম, “ফিরেছে। আপনার কাছ থেকে একটা ‘অন ইন্ডিয়া গভমেন্ট সার্ভিস’ লেখা লেফাফা চাই। অনেকগুলো ব্যবহৃত খাম পড়ে আছে এদিক ওদিক, দেখতে পাচ্ছি। আমাকে দেওয়াটা বেআইনি না তো?”
“কী করবেন নিয়ে?” জিগেস করলেন ডাঃ সিনহা।
“নাসিমকে একটা শিক্ষা দেব। প্র্যাক্টিক্যাল জোক।”
ড্রয়ার খুলে একটা নতুন খাম বের করে আমাকে দিয়ে সিনহা বললেন, “এই রকম সৎ কাজে ব্যবহার করতে চাইলে মোটেই বেআইনি নয়।”
“সরকারি নোটিস জারি করার যে একটা পাতলা ফিনফিনে কাগজ হয়, সেরকম কাগজ আপনার কাছে আছে?”
ড্রয়ার ঘেঁটে মাথা নেড়ে ডাঃ সিনহা বললেন, “নেহি জি – ও তো নেহি হ্যায়।”
সিনহার অফিস থেকে বেরিয়ে চললাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসের দিকে। মেঘমন্দ্র উত্তেজনায় ছটফট করছে। বললাম, “শোন, তোকে প্ল্যানটা বলি। তুই জেনে রাখলে সুবিধে হবে। না হলে বরং ভেস্তে যেতে পারে।”
সবটা শুনে মেঘমন্দ্র খানিকক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপরে বলল, “তোর মাথায় এসব কী করে এত তাড়াতাড়ি আসে?”
তা আমিও জানি না। কিন্তু আসে। একবার ব্যাঙ্গালোরে গিরিজাকে ফোন করে বলতে চেয়েছিলাম, “তোর কাছে আমার যে লাইব্রেরি–বইটা আছে, ওটা আজ ফেরত দেবার দিন। আমি এখন আসব নিতে?”
কেউ ফোন ধরেছে, ডাকতে গেছে। যতক্ষণে গিরিজা এসে ফোন ধরেছে ততক্ষণে আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেছে। গিরিজার সঙ্গে প্রায় আধঘণ্টা ধরে নানা কথা বলে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক জার্নালিস্ট একটা ইনটারভিউয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে। একেবারে খাঁটি দক্ষিণ ভারতীয় ইংরেজিতে কথা বলা জার্নালিস্ট। ইনটারভিউয়ের দিনক্ষণ স্থির হবার পরে সেই জার্নালিস্ট হঠাৎ বলেছে, “ম্যাডাম, একটা রিকোয়েস্ট আছে, বলব?” আধঘণ্টা ধরে জার্নালিস্টের নানা আবদারে বিরক্ত গিরিজা যেই বলেছে, “হোয়াট?” ওমনি জার্নালিস্ট (অনিরুদ্ধ দেবের গলায়) বলেছে, “আপনার কাছে আমার লাইব্রেরির যে ওমুক বইটা আছে, সেটা নিয়ে আপনি যদি এখন আসেন, তাহলে আমি সেটা লাইব্রেরিতে ফেরতও দিতে পারি, আপনাকে একটা কফিও খাওয়াতে পারি। খানিকক্ষণ নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতার পরে চিল চিৎকার ভেসে এসেছিল, “আ–আ–আ–আ–আ–আ–আ–আ–নিরুধ দেব, জাস্ট দাঁড়াও, একবার হাতে পাই তোমাকে!”
বম্বের নাসিম আলি তো আমার বাঁ হাতের খেল।
অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসে এসে দেখি নাসিম তখনও দাঁড়িয়ে আছে অফিসের বারান্দায়। নানারকম অফিশিয়াল কাজ শেষ করা রাঁচিতে একটা বিরাট কঠিন কাজ। মেঘমন্দ্রকে বললাম, “তুই ওকে আটকে রাখ – আমি হেড–ক্লার্ক মেহেন্দির কাছ থেকে একটা কাগজ জোগাড় করি। যেন দেখতে না পায় আমি কী কাগজ নিচ্ছি।”
মেঘমন্দ্র নাসিমের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করল, আমি ভিতরে ঢুকলাম। সব ক্লার্কই তাদের নিজেদের টেবিলে বসে আছে। টেবিলে থাকাকালীন কাগজ চাইলে সাধারণ কাগজ পাব। সরকারি নোটিসের পাতলা ফিনফিনে কাগজটা হাতে পাওয়া মুশকিল। এদিক ওদিক দেখছি, কী করা যায়, মেহেন্দি ঘরের দূরের কোনা থেকে জিজ্ঞেস করেছে, “কেয়া, ডাকসাব, কেয়া চাহি?”
এমন সময় ঝা–জি টেবিল ছেড়ে ঘরের অন্য দিকে যেতে শুরু করেছেন, আমি চট্ করে কাছে গিয়ে বললাম, “ঝা–জি, একটা সাদা কাগজ নেব? ডিরেকটরের কাছে একটা অ্যাপ্লিকেশন দেব।”
ঝা ততক্ষণে আলমারি খুলে ফেলেছেন। বললেন, “হাঁ, হাঁ, লিজিয়ে না, লিজিয়ে না।”
ঝা–জি খোলা আলমারির দরজার আড়ালে গিয়েছেন, আর আমিও ওঁর টেবিল থেকে একটা পাতলা ফিনফিনে কাগজ নিয়েছি একটা বড়ো খাতার ভেতরে লুকিয়ে, আর দেখান’র জন্য একটা সাদা কাগজ হাতে করে বেরিয়েছি।
বারান্দায় নাসিম গজগজ করছে, চশালা, বম্বে যাবার আগে সব নো–অবজেকশন জমা দিয়ে গিয়েছি। এক সপ্তাহ ঝা সেটাকে নিয়ে হাঁ করে বসে আছে। কোনও কাজ করেনি। আমি তিনদিনের জন্য এসেছি শেষ মাসের স্যালারি, সার্টিফিকেট সব নিয়ে যাব – কী করে কী হবে, কে জানে।”
“তিনদিন!” আর্তনাদ করল মেঘমন্দ্র। “তিনদিনে কী হবে?”
নাসিম হতাশ সুরে বলল, “জানি না। বিদ্যুৎ বলেছিল ইউনিভারসিটি থেকে সার্টিফিকেট বের করে রাখবে, কিছুই করেনি। এখন বলছে, ‘আপ ওয়াপস জাও বস, ম্যায় ভেজ দুঙ্গা।’ সব শালা ঝুট্ বলে, যত দু’নম্বরি।”
এমন সময় ঝা বেরিয়ে এল একটা ফাইল নিয়ে। বলল, “নাসিম স্যার, আপনারই ফাইল নিয়ে ডিরেকটর সাহেবের কাছে যাচ্ছি। শুধু ওনার সইটাই বাকি। ওটা হলে আপনি এখনই আপনার স্যালারি পেয়ে যাবেন। দেব–স্যার, আপনি যে বললেন ডিরেকটরের কাছে যাবেন?”
আমি বললাম, “যাব। আগে দরখাস্তটা তো লিখি।” বলে পালাচ্ছি, নাসিম বলল, “ঝা–জী, চলুন, আমি আপনার সঙ্গে ডিরেকটরের কাছে যাই।”
ক্যান্টিন পৌঁছে মেঘমন্দ্র বলল, “এবার কী? একটা টাইপরাইটার না হলে তো চলবে না।”
আমি বললাম, “টাইপরাইটার তো তোর আছে।”
“সে তো পোর্টেবল টাইপরাইটার। ছোট্টো। অক্ষরের সাইজগুলো এইটুকু–টুকু। ধরে ফেলবে তো।”
“কাঁচকলা ফেলবে। আর রাত্তিরেই লিখে ফেলব।”
“তারপরে?” মেঘমন্দ্রের শঙ্কা যায় না। “ডাকে দিলে ক’ দিন লাগবে পৌঁছতে কে জানে!”
“ডাকে দেব?” আমার চশমা কপালে উঠে গেল। “অন ইন্ডিয়া গভমেন্ট সার্ভিস লেখা খাম কে নিয়ে পোস্ট অফিসে জমা দেবে? তুই, না আমি? হাতে হাতে দেব।”
“হাতে কী করে দিবি?”
“দেখতে পাবি।”
পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ নাসিম অফিসে আসবে জানি, তাই সেরকম সময়েই বেরোলাম হাসপাতাল থেকে। দেখি নাসিম অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বাগানের ফুলের শোভা দেখছে।
বললাম, “এই, সকাল থেকে কোথায় ছিলি?”
বলল, “হস্টেলেই ছিলাম। আর কোথায় যাব?”
বললাম, “তাহলে তোর চিঠি নিয়ে যে লোকটা এসেছিল, সে তোকে না পেয়ে আমাকে চিঠি দিয়ে গেল কেন?”
বলে বিশাল হলদে খামটা বের করে দিলাম।
“বাপরে! ইয়ে কেয়া হ্যায়?” বলে নাসিম হাতে নিল। “ডাঃ নাসিম আলি, সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অফ সাইকিয়াট্রি, কাঁকে, রাঁচি ৮৩৪০০৬।” বলে নাসিম দেখল নিচে লেখা আছে, ‘ডেসপ্যাচার’, কিন্তু তার নিচে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
আউটডোরের ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছিল মেঘমন্দ্র। আমাকে নাসিমের সঙ্গে কথা বলতে দেখে উঠে এসেছে। বলল, “কী ওটা?”
গলাটাকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, “নাসিমের জন্য একটা চিঠি এসেছে।”
নাসিম তখনও খোলেনি খামটা। আমাকে বলল, “লেকিন কাহাঁসে আয়া হ্যায়?”
“আরে, কাহাঁসে আয়া সে কি দাড়ি জানে নাকি?” খেঁকিয়ে উঠল মেঘমন্দ্র। “খুললেই তো বোঝা যাবে।”
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “সকালে আমি হাসপাতালে আসছি আটটার সময়, একটা লোক – খাকি পোশাক, কিন্তু পুলিশ নয় – বাইকে করে এসে আমাকে ওভারটেক করে বলল, ‘ডাক্তারলোগদের কোথায় পাব?’ লোকটাকে ঠিক পেশেন্ট মনে হলো না, তা–ও বললাম, ‘আউটডোর মে নাম লিখানা পড়েগা।’ লোকটা বলল, ‘না, আমি চিঠি ডেলিভারি করতে এসেছি।’ চিঠিটা দেখাল। নাসিমের নাম দেখে আমি ওকে বলে দিলাম হস্টেল কোন দিকে। তারপরে আমি হাসপাতালে ঢুকে গেছি – খানিক বাদে লোকটা দেখি ওয়ার্ডের সামনে। বলল, ‘আমি ডাঃ নাসিমকে খুঁজে পাচ্ছি না। সব ওয়ার্ডে ঘুরেছি, হোস্টেল গিয়েছি… আপনি ওনাকে চেনেন, এই চিট্ঠিটা ওনাকে বলবেন হেড পোস্ট অফিস থেকে তুলে নিতে।’
“আমি ভাবলাম নাসিম এই দু দিনের মধ্যে কখন হেড পোস্ট অফিস যাবে? তাই বললাম, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে, আপনি আমাকে দিয়ে যেতে পারেন।’”
আমি এ সব বলছি, আর নাসিম খাম খুলে চিঠি বের করছে, ভাঁজ খুলছে, গোটা কাগজটায় চোখ বোলাচ্ছে, তারপর চোখ বিস্ফারিত করে পড়তে শুরু করেছে, প্রথম চার লাইন পড়েই বলেছে, “আবে, ইয়ে তো সামন্স হ্যায়!”
মেঘমন্দ্র বলেছে, “সামন্স?”
আমি বলেছি, “কেয়া?”
নাসিমের হাত থেকে খাম পড়ে গেছে, আমি ওটা কুড়িয়ে নিয়েছি, নাসিম আরও মন দিয়ে পুরোটা পড়েছে, তারপর মেঘমন্দ্রর হাতে দিয়েছে, মেঘমন্দ্রও হাঁ করে (নইলে হাসি চাপতে পারছিল না) পড়ছে… আমি বলেছি, “এখান থেকে চলে চল, ক্যান্টিনে গিয়ে বসি আগে।”
ক্যান্টিনে অনেক লোকের ভীড়, কিন্তু তার মধ্যে ডাঃ মাসুদ আছেন। তিনি আইন–টাইনের ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন, অনেক উকিল–টুকিল চেনেন, আর রয়েছেন ডাঃ কুজুর। তিনি সব বিষয়েই অনেক কিছু জানেন বলেই লোককে বলে বেড়ান।
আমরা প্রথমেই চেয়ার টেনে ভীড় থেকে একটু দূরে বসলাম। তিনজনে মিলে আবার পড়লাম চিঠিটা। এক পাতার চিঠি – ঠিক যেমন সরকারি চিঠি হয়, তেমনই – পাতলা ফিনফিনে কাগজে টাইপ করা। চিঠির বয়ান হল এই, যে সরকারি রেলওয়ে কোর্ট থেকে নাসিম আলিকে জানানো হচ্ছে যে গত ওমুক তারিখে তিনি বেআইনিভাবে অন্যের টিকিট নিয়ে ট্রেনে যাবার চেষ্টা করছিলেন। এই মর্মে একটা আইনি শুনানিতে আদালত নাসিম আলির নামে সমন জারি করেছেন। তিনি যেন আগামী ওমুক তারিখে সেই শুনানিতে হাজির থাকেন চক্রধরপুরের রেলওয়ে আদালতে। অন্যথায় নাসিম আলির নামে পরোয়ানা জারি হবে। এই চিঠির অন্য একটি কপি নিম্নলিখিত ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। ডাঃ নাসিম আলি, প্রযত্নে – নাসিমের বাবার নাম, ঠিকানা – নাসিমের বম্বের ঠিকানা।
চিঠি পড়ে আমরা তিনজনেই খানিকক্ষণ ভোম হয়ে বসে রইলাম। নাসিম শুধু বিড়বিড় করে বলছে, “ইয়ে ক্যাইসে হো সকতা হ্যায়…” তারপর বলছে, “উসকো পতা ক্যায়সে চলা?” এই সব… এমন সময় আমাদের মুখের ভাব প্রথম লক্ষ করলেন ডাঃ মাসুদ। ক্যান্টিনের ওদিক থেকে হেঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেয়া, ভাই? কেয়া হো রহা হ্যায়? ইৎনা পরেশান কিউঁ দিখ্ রহে হো?” মাসুদ আমাদের ভালোবেসে কখনও তুমি বা কখনও তুই বলতেন, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে বলতেন আপনি।
নাসিম ফিস্ফিস্ করে বলছে, “মৎ বোল্, মৎ বোল্!” কিন্তু বলতে না পারলে মজা কোথায়? মেঘমন্দ্র বলল, “আরে ওরা সিনিয়র লোক, ওরাই বলতে পারবে…”
আমি তখন উঠে গিয়ে ডাঃ মাসুদকে বলেছি, “বস্ আপ ইস তরফ আইয়েগা?”
সবাই গণ্ডগোল বুঝে চুপ করে গেছেন। মাসুদ নিজের ফোল্ডিং চেয়ারটা তুলে নিয়ে উঠে এসেছেন আমাদের কাছে। মেঘমন্দ্র চিঠিটা হাতে দিয়ে বলল, “এটা পড়ে দেখুন।”
মাসুদ সরকারি চিঠি পড়তে অভ্যস্ত। এক লহমায় পড়ে শেষ করে বললেন, “কেয়া কিয়া থা, রে?”
মাসুদকে টাটানগর স্টেশনের ঘটনাটা বলা হল। উনি ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলে কাগজটার দিকে। অস্ফূটে বললেন, “কালকের ঘটনা, আজই শমন এসে গেল” তারপরে মুখ তুলে হেঁকে বললেন, “এ, কুজুর, একবার ইধার আও।”
ক্যান্টিনের ওদিক থেকে সবাই আমাদের দিকে চেয়েই ছিলেন। ডাঃ কুজুর নিজের চেয়ার নিয়ে উঠে আসাতে এক এক করে সবাই উঠে এল। ডাঃ মাসুদ চিঠিটা কুজুরের হাতে দিয়ে বললেন, “দেখো জরা, নাসিমকো সামন্স মিলা হ্যায়।”
সবাই হতবাক! কিসের সমন? সবাই শুনল। অরূপও ছিল। ওর–ও মুখ শুকিয়ে আমসি। “বস্, আমার নামেও আসেনি তো?”
নাসিমের প্রথম উদ্বেগ হল, “আমার তো পরশু টিকিট কাটা আছে। বম্বে চলে যাব। আগামী সপ্তাহে কী করে চক্রধরপুরে যাব?”
হা হা করে হেসে কুজুর বললেন, “তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, ভাই? কোর্টের শমন অগ্রাহ্য করা যাবে না। টিকিট ক্যানসেল করো।”
তখন মাসুদ (তখনও ভুরু কোঁচকান’) বললেন, “কুজুর, একটু ভেবে দেখো। কাল ভোরে যে ঘটনা ঘটেছে ৫টা নাগাদ, আজ সকালে তার শমন এসে গেল? তিরিশ ঘণ্টার মধ্যে? ব্যাপারটা একটু আশ্চর্য না?”
কুজুর তো প্রায় সবই জানেন। হাত নেড়ে সন্দেহটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “না, না। এগুলো কী হয়, রোজই কেস লিস্ট তৈরি হয় না। রোজ কেস রিপোর্ট হয়। আর সপ্তাহে এক দিন বা দু’দিন কোর্ট থেকে কেস লিস্ট তৈরি করে। তার মানে কাল সকালেই টি.টি. রিপোর্ট করে দিয়েছে, আর কাল যে কেস লিস্ট তৈরি হয়েছে, তাতে নাসিমের কেস উঠে গেছে। আজ শমন জারি হয়েছে। রেলওয়ে কোর্টের শমন আমি দেখেছি। এরকমই হয়।”
ব্যস। যতটুকু সন্দেহ ছিল, তাও নিরসন হয়ে গেল।
এখন কী করে নাসিম?
একজন উকিল ঠিক করতে হবে কি?
আমি বললাম, “এখানে তো বলেনি কী জন্য ডেকেছে। যদি শুধু সাক্ষী হিসেবে হয়, তাহলে উকিল নিয়ে কী লাভ?”
মেঘমন্দ্র বলল, “কিন্তু ওখানে গিয়ে যদি দেখে যে আসামী হয়েই এসেছে, তাহলে তখন কোথায় উকিল খুঁজবে? তার চেয়ে এখনই জিজ্ঞেস করা ভালো।”
কে বলল, “না গেলে কী হয়? নাসিমভাই তো বম্বে চলে যাবে।”
নাসিম উৎসাহিত হয়ে বলল, “ঠিক। আমি তো পরশু চলেই যাব। কেউ জিজ্ঞেস করলে পরে বলব – আমি পাইনি।”
আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম! “না না! তাতে আমি বিপদে পড়ব। ওই কাগজে আমার সই আছে যে!”
মাসুদ ভুরু কুঁচকে বললেন, “আপকা সিগনেচার? ক্যায়সে?”
আবার মোটরসাইকেলারোহীকে নিয়ে আসতে হল সিনে!
মাসুদ মানতে রাজি নন। “একজনের নামে শমন আর একজনকে দিয়ে চলে গেল? এ আমি জীবনে শুনিনি বাপু!”
কুজুর আবার অজান্তেই আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “আরে দিয়ে যখন দিয়েছে তখন তো আর কিছু করার নেই। কিন্তু ডাঃ দেব, আপনি নিজের নাম সই করলেন কেন? নাসিম আলি লিখনা চাহিয়ে থা না?”
আমি খুব হতাশ সুরে বললাম, “তা কী করে লিখব? আমি তো লোকটাকে বলেই দিয়েছি, আমি নাসিম আলি না। আর ও–ও বলল, ‘আপনা নাম লিখিয়ে, ফর নাসিম আলি।’ আমিও তাই করলাম – তা–ই তো দস্তুর, না কী?”
নাসিম হঠাৎ খুব রেগে গেল। “তুই পাকামি মেরে নিলি কেন চিঠিটা? বললেই পারতি, আমি নাসিম আলি নই। এ চিঠি আমি অ্যাক্সেপ্ট করব না। যা খুশি করুন।”
“অ্যাক্সেপ্ট করব না কী আবার? ও তো আমায় জোর করে দেয়নি। আমিই তোর ভালোর জন্য চেয়ে নিয়েছি। আমি কী করে জানব ওটা শমন? গভমেন্ট সার্ভিস দেখে ভাবলাম জরুরি চিঠি, তোর ভালো চেয়ে নিয়ে নিয়েছি। এই জন্যই তোর মতো বন্ধুর জন্য কিছু করতে নেই…”
“যা যা! আমার মতো বন্ধু! তোর মতো বন্ধু দিয়ে কী লাভ হল আমার? কোথায় এখন ফাইনাল প্যাকিং করে কেটে পড়ব, তা না, এখন কোথায় শমন, কোথায় উকিল…”
ডাঃ মাসুদ আমাদের ঝগড়ার মাঝে বাধা দিলেন। “এক মিনিট, এক মিনিট… ডাঃ নাসিম, তুম বেকার রুঠ্ রহে হো। ডাঃ দেবের ওপর রাগ করে লাভ নেই। দেখুন, এই চিঠির কপি গিয়েছে বম্বেতেও। আপনার বাবার কাছে। সুতরাং ডাঃ দেব না নিলেও শমন আপনাকে নিতেই হত।”
“আমি এক্ষুনি গিয়ে বাবাকে ফোন করে বলছি এরকম চিঠি এলে অ্যাক্সেপ্ট না করতে।” লাফ মেরে উঠল নাসিম।
“আরে ধ্যাৎ,” বিরক্ত স্বরে কথাটা বলে মেঘমন্দ্র ওকে টান মেরে বসিয়ে দিল আবার। “এখন বম্বেরটা না নিলেই বা কী? এটা তো নেওয়াই হয়ে গেছে।”
আমি বললাম, “তা ছাড়া বলাই আছে, এটা অ্যাটেন্ড না করলে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আসবে।”
“হাঁ! ও ভি সোচ লিজিয়ে ডাকতার সাব! তারপরে আপনি যখন বম্বেতে, তখন ওয়ারেন্ট গেলে আবার আপনাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসবে কিন্তু বিহারে সেটা খুব অপমানজনক হবে।”
তখনও বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড আর বিহার দুই হয়নি।
নাসিম সাহস করে বলল, “আমি তো মাসের শেষে দুবাই পালাচ্ছি। কে ধরতে যাবে আমাকে দুবাইতে?”
আমি একটু রেগেই এবার বললাম, “বাজে বকিস না। কালই ধরা পড়ে আজকেই শমন এল। বাড়ি গিয়ে দেখবি বম্বেতে রেলপুলিশ থানা গেড়ে বসে আছে তোকে ধরবার জন্য।”
হা হা করে হেসে কুজুর বললেন, “তার চেয়েও ভালো হবে আপনি যদি ট্রেন থেকে টাটা স্টেশনে নেমে দেখেন ওখানেই অপেক্ষা করছে। আপনার মালপত্র আপনি ব্রেক ভ্যান থেকে নামাতে পারলেন না – সে চলে গেল হাওড়া! আর আপনি রেলওয়ে লক–আপে ঢুকলেন।”
এমন সময় ক্যান্টিনের পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন ডাঃ সিনহা।
“কী ব্যাপার? সবাই এত সোরগোল করছে কেন? আউটডোরে বসে পেশেন্ট দেখতে পারছি না।”
সবাই হই–হই করে ব্যাপারটা ডাঃ সিনহাকে বুঝিয়ে দিল।
“শমন? বাপরে! দেখি,” বলে সিনহা নাসিমের হাত থেকে খামটা নিয়ে টেনে টেনে পড়লেন, “অন ইন্ডিয়া–আ–আ–আ গভমে–এ–এ–এন্ট সার্ভিস… আরেব্বাস!” বলে একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি তখন চায়ে চুমুক দিতে ব্যস্ত।
চিঠি পড়ে ডাঃ সিনহার হাসি আর থামে না। সকলে অবাক! ডাঃ কুজুর বললেন, “আপনি এত হাসবেন না। ডাঃ নাসিম কিন্তু খুব বিপদে পড়েছেন। রেলওয়ে কোর্টের ক্ষমতা সাংঘাতিক! এর ফল মারাত্মক হতে পারে।”
ডাঃ সিনহা হাসি থামিয়ে বললেন, “কী হতে পারে? পালিয়ে গেলেই হল।”
নাসিম জিজ্ঞেস করল, “আর যদি টাটা স্টেশনে ধরে?”
ডাঃ সিনহা অবাক! “ধরলেই হল? কী করে ধরবে? ছবি টাঙানো আছে? ফেরারি আসামি নাকি? হা–হা–হা!”
ডাঃ কুজুর মানবেন না। “টিকিট তো কাটা আছে। আজকাল স–অ–অ–ব কম্পিউটারাইজড হয়ে গেছে। ডাঃ নাসিমের সব অ্যাড্রেস দেখুন ওই শমনেই আছে। ট্রেনেই টি.টি. ধরবে।”
সিনহা আর একবার শমনটায় চোখ বুলিয়ে বললেন, “আপনার বাবার নাম, বম্বের ঠিকানা – সব কী করে জানল রেলওয়ে?”
নাসিম বলল, “তা আমি কী করে জানব?”
আমি বললাম, “কেন, তুই কাল যে ফিরলি, বম্বে টাটা টিকিটটা কোত্থেকে কেটেছিলি? রাঁচি, না বম্বে?”
“আমি কাটিনি। বম্বে থেকে বাবা কেটে রেখেছিলেন।”
আমি বললাম, “ব্যস, তবে তো হয়েই গেল। তোর বাবা নিশ্চয়ই নিজের নাম দিয়ে, নিজের ঠিকানা দিয়েই কেটেছিলেন?”
মাসুদের ভুরু আবার কুঁচকে গেল। “তাহলে এখানকার ঠিকানা কোত্থেকে পেল?”
আমার সম্বন্ধে মেডিক্যাল কলেজে প্রফেসর বসু বলেছিলেন, “অনিরুদ্ধর সাংঘাতিক প্রেজেনস অফ মাইন্ড।” সেটা আবার কাজে এল।
বললাম, “আমার ধারণা ওর জন্য নাসিম নিজেই দায়ী। কাল টি.টি.-র সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে বলেছিল, আমি সি.আই.পি.-র ডাক্তার।”
“আমি মোটেই বলিনি এ সব,” তেড়ে উঠল নাসিম।
“হাঁ, হাঁ বস,” অনেকক্ষণ পরে মুখ খুলল অরূপ। “আপ বোলা থা। তখনই তো টি.টি. চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখিয়ে সবলোগ, ইয়ে ডাগদর লোগ কেইসা চোর হোতে হ্যায়।’”
নাসিম চুপ! সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ভাবখানা, চুরিও করতে গেলি, গিয়ে ধরাও পড়লি। তা ধরা পড়লি, পড়লি। তার সঙ্গে ডাক্তারদের নাম ডুবিয়ে এলি? শেষে নাসিম আর সহ্য না করতে পেরে উঠে পড়ল। বলল, “আমি অফিস থেকে সার্টিফিকেটগুলো তুলতে যাই। ডাঃ মাসুদ, আপনি আজ সন্ধেবেলা কোনও ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলে রাখবেন? আমি কাল সকালেই আপনার কাছ থেকে অ্যাড্রেস নিয়ে গিয়ে কথা বলে নেব।”
মাসুদ চলে গেলেন। অন্যান্যরাও সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে রওয়ানা দিল যে যার কাজে। রয়ে গেলাম ডাঃ সিনহা, মেঘমন্দ্র আর আমি।
“এ নিশ্চয়ই আপনাদের কাজ?” জানতে চাইলেন সিনহা।
বললাম, “একদম।”
“মাথায়ও আসে বটে। শমনের বয়ানটা কার লেখা?”
মেঘমন্দ্র বলল, “দেব–এর।”
“আর খামের কোনে ‘ডেসপ্যাচার’ লেখা স্ট্যাম্পটা কোত্থেকে জোগাড় হল?”
“আরে ওটা আমাদের অফিসের ডেসপ্যাচারের স্ট্যাম্প। কাল আমরা গেছি ডেসপ্যাচার অফিসে। দেব কেয়ামৎকে বলেছে, ‘আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট চিঠি আসার ছিল কলকাতা থেকে – ইনকাম ট্যাক্সের। আমার বাবা খবর নিয়েছেন, চিঠি পাঠান’ হয়েছে অফিশিয়াল অ্যাড্রেসে। এখনও আসেনি। একটু দেখবেন, এখানে পড়ে আছে কি না?’ বলে কেয়ামৎকে টেনে নিয়ে গেছে অফিসের পেছনে – যেখানে হাজার হাজার চিঠি পড়ে থাকে বছরের পর বছর। কেয়ামৎ তো আর ওকে হাত লাগাতে দেবে না। তাই কেয়ামৎই খুঁজছে, আর দেব দেখাচ্ছে, ‘ওটা কী? আর ও–ও–ইগুলো?’ আর ততক্ষণে আমি ডেসপ্যাচারের স্ট্যাম্পটা নিয়ে নিচের কোনে লাগিয়ে নিয়েছি। এমনভাবে লাগাতে হয়েছে, যাতে ডেসপ্যাচার শব্দটা পড়া যায়, কিন্তু সি–আই–পি নয়। ভাবতে পারেন – ওপরের লাইন পড়া যাবে, কিন্তু নিচের লাইন নয়! দেব আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আমি একটু আস্তে করে করেছি বলে খুব মন দিয়ে দেখলে পড়া যাচ্ছে – সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অফ সাইকিয়াট্রি। যাই হোক, এখনও সেটা কেউ দেখেনি।”
সিনহা জিজ্ঞেস করলেন, “এবার? কখন বলবেন যে কীর্তিটা আপনাদের?”
“কোনও দিন না,” বলল মেঘমন্দ্র। “ভুগুক ব্যাটা।”
আমি মাথা নাড়লাম। “না। কাল বলে দেব। না হলে মজাটা জমবে না। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কথা, আজ বিকেলে মাসুদ বেরোন’র আগে ওনাকে জানিয়ে দিতে হবে। নইলে উনি আবার গিয়ে উকিলের সঙ্গে কথা বললে হাস্যাস্পদ হবেন।”
সিনহা হা–হা করে হাসলেন আবার। বললেন, “কুজুর আবার বেশি ওস্তাদ!”
“হ্যাঁ। নাসিমের পরে উনিই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছেন।”
সারাদিন কাটল নানা লোকের কৌতুহল নিরসন করতে। নাসিমের কী হয়েছে, কোত্থেকে শমন? কেন? এবার কী হবে, ইত্যাদি। নাসিম দুপুরের মধ্যে অফিসের কাজ শেষ করে হস্টেলে গেছে। সেখানেও ওর অনেক গোছগাছ। তিন বছরের সম্পত্তি বাক্সবন্দি করতে হবে। খানিকক্ষণ ওকে সাহস দিলাম। ভাবিস না। কিচ্ছু হবে না। ডাঃ মাসুদ আজ ল’ইয়ারের সঙ্গে কথা বলবেন। উনি হয়ত বলবেন, কিচ্ছু করতে হবে না। নিজে যেতে হবে না। ল’ইয়ারই গিয়ে রিপ্রেজেন্ট করবেন। আর শাস্তি কী হবে? তুই তো আর অন্যের টিকিটে ট্র্যাভেল করিসনি। করতে চেয়েছিস। তাতে কী হবে? জেল তো হবে না। বড়োজোর ফাইন হবে… ইত্যাদি।
তারপর আমাদের তো হাসপাতাল ফিরতে হবে। নাসিমের কোর্স শেষ, ওর কাজ শেষ। আমাদের তো তা নয়। ফিরেই ডাঃ মাসুদকে বললাম উনি যেন সন্ধেবেলা কোনও উকিলের পরামর্শ নিতে না যান। উনি শুনে খানিকক্ষণ হাঁ করে রইলেন, তারপরে হা–হা করে হাসতে হাসতে বাড়ি গেলেন।
পরদিন মেঘমন্দ্র আর আমি সকাল থেকেই নাসিমের সঙ্গে ঘুরছি। লোকজন এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে সব ঠিক আছে কি না – কেউ কেউ আবার নাসিমকে বলে যাচ্ছে, সকাল থেকে ডাঃ মাসুদ খোঁজ করছেন।
আমি বললাম, “মাসুদের সঙ্গে তাহলে দেখা করা উচিত নয় কি?”
নাসিম বলল, “হ্যাঁ। মেহেন্দি আসুক, ওকে দিয়ে আজকের কাজটা শুরু করিয়ে দিয়েই যাব।”
খানিক বাদে হেলতে দুলতে এল মেহেন্দি। নাসিমকে দেখে বলল, “সালাম আলেইকুম ডাক’সাব। কেয়া হুয়া? সুনা আপকা কুছ লফড়া হুয়া?”
তাকেও গল্পটা বলতে হল। নাসিমের দুঃখে দুঃখী হয়ে মেহেন্দি তাড়াতাড়ি ওর সার্টিফিকেট তৈরি করতে বসে গেল। আমরা গেলাম ডাঃ মাসুদের সঙ্গে দেখা করতে।
মাসুদ কার সঙ্গে যেন বসে গল্প করছিলেন, আর খুব হাসছিলেন। নাসিমকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন। নাসিম বলল, “আপনি আমার খোঁজ করছিলেন?”
ওপর নিচে মাথা নাড়লেন মাসুদ। “কাল গিয়েছিলাম উকিলের সঙ্গে কথা বলতে। সমস্যা আছে। এখানকার উকিল দিয়ে হবে না।”
শুনে আমিও চমৎকৃত! এ আবার কী মজা শুরু?
নাসিমের মুখ শুকিয়ে গেছে। বলল, “কেয়া মতলব? কী করতে হবে?”
“মতলব, এটা স্পেশাল রেলওয়ে কোর্টের মামলা। এখানে কোনও উইটনেস নেই। অর্থাৎ আপনাকে ডাকা মানেই আপনি আসামী। রেলওয়ের উইটনেস হল টি.টি.। আপনি যদি মনে করেন তাহলে আপনি আপনার পক্ষে উইটনেস নিয়ে যেতেই পারেন, তবে তাতে সময় লাগবে বেশি, ঝঞ্ঝাটা বাড়বে বই কমবে না। অর্থাৎ, আপনাকে যেতেই হবে, ফাইন দিতেই হবে – না হলে জেল হবেই হবে। এই হল সামারি।”
নাসিম অবাক হয়ে বলল, “বিচার হবার আগেই আসামী ঠিক হয়ে গেল, শুনানির রেজাল্ট পাক্কা? তাহলে এরকম কোর্ট দিয়ে কী লাভ?”
মাসুদ বুঝলেন বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। বললেন, “নেহি, ঠিক অ্যাইসা নেহি, মতলব, হাইকোর্ট মে অ্যাপিল করনে কা প্রোভিজন হ্যায়…”
নাসিম হতাশ হয়ে বলল, “সে তো আরও সময় লাগবে।”
ঠোঁট ওলটালেন মাসুদ। “কোর্টে কিছু হলে সময় কম লাগে কবে?”
নাসিম বলল, “তাহলে আমার কালকের টিকিট ক্যানসেল করে দিই?”
“তাই ভালো।”
এমন সময়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন কুজুর। “কেয়া হুয়া ডাঃ নাসিম?”
নাসিম বলল, “স্যার, আপনি আপনার ঘরে যান, আমি ওখানে যাচ্ছি। আলোচনা আছে।”
কুজুর চলে গেলে নাসিম আমাদের বলল, “আমি কুজুরকে গিয়ে বলি। ওনার কয়েকজন রেলওয়ে ক্লার্কের সঙ্গে চেনাজানা আছে। এখানকার স্টাফরাও কুজুরকে মান্যি করে। যদি কাউকে পাঠিয়ে টিকিটটা ক্যানসেল করা যায়…”
নাসিম চলে গেল, মাসুদ আমাদের বললেন, “যান, যান। পিছনে যান। টিকিট না ক্যানসেল করতে পাঠিয়ে দেয়।”
আমরা দুজনে দৌড়লাম। কুজুর তখন মন দিয়ে আবার শমনটা পড়ছেন। আমরা ঢুকে নিঃশব্দে দুটো চেয়ারে বসলাম।
কুজুর নাসিমকে বোঝাচ্ছেন। “দেখিয়ে, ইয়ে ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট ফার্স্ট ক্লাস (রেলওয়ে) কা কোর্ট হ্যায়।” হ্যায় তো বটেই – সে নামই তো লিখেছিলাম। “খুব উঁচু পোস্ট। এই সব সিচুয়েশনে ঝামেলায় না যাওয়াই ভালো। কত আর ফাইন হবে? হাজার–দুহাজার টাকার বেশি নয়। মিটিয়ে নিন। আপনি আপনার টিকিটটা দিন, আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি স্টেশনে। দেখি কম খরচে চেঞ্জ করে নেওয়া যায় কি না।”
এসব বলছেন, আর আমি অন ইন্ডিয়া গভমেন্ট সার্ভিস লেখা খামটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। নাসিম পকেট থেকে ট্রেনের টিকিট বের করছে, আর আমি মেঘমন্দ্রকে বলছি, “একটা স্ট্যাম্পও ঠিক করে লাগাতে পারিস না। সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অফ সাইকিয়াট্রি নামটা পুরোটা পড়া যাচ্ছে।”
মেঘমন্দ্র বেশ রাগতস্বরে বলল, “বাজে বকিস না। তাড়াহুড়ো করে মারা – তাও কী সুন্দর মেরেছি! কেউ ধরতে পারেনি।”
নাসিম থমকে গেল। বলল, “কোথায় সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অফ সাইকিয়াট্রি পড়া যাচ্ছে?”
আমি বললাম, “এই তো। দেখ না। খামে – ডেসপ্যাচারের নিচে।”
ছোঁ মেরে খামটা নিয়ে ডাঃ কুজুর বললেন, “হ্যাঁ, ওই রকমই লাগছে বটে! কিন্তু পরিষ্কার নয়। সরকারি সিল। ছাপাটা অস্পষ্ট। কিন্তু ভেতরে তো লেখাই আছে ফ্রম দ্য কোর্ট অফ ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট ফার্স্ট ক্লাস – রেলওয়ে, চক্রধরপুর।”
ততক্ষণে নাসিম খামটা নিয়ে নিয়েছে। “না, ডাঃ কুজুর, ভালো করে দেখুন, একটু ঘষা আছে বটে, কিন্তু পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে। সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অফ সাইকিয়াট্রি। ইয়ে কেয়া তুম দোনো কা কাম হ্যায়?”
হাম দোনো, অর্থাৎ, মেঘমন্দ্র আর আমি ওদের কথা শুনতেই পাচ্ছি না। মেঘমন্দ্রর পালা এবার। বলল, “আমি তো এক সেকেন্ডের মধ্যে, কেয়ামৎ দেখে ফেলতে পারে এমন রিস্ক নিয়ে স্ট্যাম্প মেরেছি। তুই কী করেছিস? বাড়িতে বসে, জল দিয়ে কালি ফিকে করে করে একশোবার প্র্যাকটিস করে সইয়ের নিচে স্ট্যাম্প মেরেছিস, ওতেও আমার নামটা একটু চেষ্টা করলেই পড়া যাচ্ছে।”
আমি খুব উত্তেজিত হয়ে গেলাম। বললাম, “যা যা, বাজে বকিস না। কাল থেকে অন্তত একশো জন ওটা দেখেছে। ক’জন পড়েছে রে? ওটা তোর নামের স্ট্যাম্প! হুঁঃ!”
কুজুর চিঠিটা চোখের কাছে নিয়ে এসেছেন। বললেন, “মাই গড! এ তো সাফ নয়, কিন্তু তবু পড়া যাচ্ছে – ডাঃ মেঘমন্দর চকরবত্তি, ডিপিএম, এমডি, কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট! কেয়াবাৎ! কাল থেকে দেখছি, চোখেই পড়েনি!”
নাসিম হাত বাড়িয়ে কুজুরের হাত থেকে কাগজটা নিয়ে চেয়ে রইল। জলে ভেজানো, কালি প্রায় নেই এমন একটা ছাপ, কিন্তু মেঘমন্দ্রের স্ট্যাম্পটা নতুন, তাই বেশি কষ্ট না করেই পড়া যাচ্ছে ওর নাম।
“কী? টিকিট চেঞ্জ হল?” বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন ডাঃ মাসুদ।
“আরে না, এটা শমনই নয়…” বলতে শুরু করে মাসুদের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন কুজুর। “আপনি জানতেন?”
“কাল ডাঃ দেব বলে গেলেন বিকেলে। নইলে আমিও উকিলের কাছে গিয়ে অপদস্থ হতাম।”
“ডাঃ নাসিম, রেলওয়ে পোলিস কা দো অফিসার আপকো বাহার ঢুন্ড রহা হ্যায়…” বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন ডাঃ সিনহা।
কুজুর অবাক! উনি ছাড়া আর কে কে জানত? বললেন, “আপনিও জানতেন? কেয়াবাৎ!”
“ও, বলে দেওয়া হয়েছে?” বলে চেয়ার টেনে বসলেন সিনহা। আমরা বোঝালাম যে নইলে নাসিমের টিকিট ক্যানসেল করতে পাঠান হচ্ছিল প্রায়।
তারপর আর কী, নাসিম আমাদের ওপর সাংঘাতিক রেগে গেল। বার বার বলতে থাকল, তোদের মতো বন্ধু থাকলে লোকের শত্রুর কী প্রয়োজন, তোদের দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে… না, পাগলা ষাঁড়ের গুঁতো মেরে মেরে ফেলা উচিত, ইত্যাদি। লোকজন এসে এসে জিজ্ঞেস করতে লাগল, নাসিমভাই, আপকা সামন্স জরা দিখাইয়ে… এই সব, কিন্তু তামাশাটা যে জব্বর হয়েছে, সেটা মানতে নাসিমও বাধ্য হল। কুজুরও বললেন, “বঢ়িয়া মজাক থা। আমিও ধরতে পারিনি শমনটা আসল না। মানতেই হবে, দারুণ দিয়েছেন।”
পরে অবশ্য জুনিয়র ডাক্তার আর ক্লার্কদের বলে বেরিয়েছিলেন, “আরে, আমি তো দেখেই বুঝেছি ওটা নকল। শমন কখনও ওরকম হয়? আমার চোখে ধুলো দেওয়া অতই সোজা? নেহাত বাচ্চা ছেলেগুলো একটু রগড় করছিল, তাই ওদের সঙ্গ দিয়েছিলাম।”
????