এক দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের। প্রবীণ মানুষেরা যাঁরা সারাদিনের একটা বড়ো সময়ই গৃহবন্দি অবস্থায় কাটিয়ে দেন , স্বস্তিতে নেই তাঁরাও। চারপাশের ঘটনাক্রম , তা সে লাগামছাড়া বাজারদর হোক কিংবা ঘটমান দুনিয়ার খবরাখবর ব্যথিত , বিক্ষুব্ধ করে তাঁদের।গত বছরের আগস্ট মাস থেকে যার শুরু আজও তা বহাল রয়েছে। কেবল মুখ্য চরিত্রগুলো বদলে গেছে । আমার বাড়ির লাগোয়া রাস্তা দিয়ে সকাল সন্ধ্যায় বহু মানুষের যাতায়াত। এদের মধ্যে স্কুলের ছাত্র – ছাত্রী, অভিভাবক -অভিভাবিকা থেকে শুরু করে বেশ কিছু সংখ্যক মাস্টারমশাই দিদিমণিও থাকেন। থাকাটাই স্বাভাবিক কেননা রাস্তা আমাদের উত্তরণের দিশা দেয়, পথের কাছে সবাই পথিক। পথ পথচারী মানুষদের মধ্যে বিভেদের সীমারেখা টানেনা। পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে যে পথে হাঁটে পথ তারই।
সেদিন স্কুলের পথে চলা এক ছাত্রকে ডেকে প্রশ্ন করি নিছকই প্রশ্ন করার প্রবীণ বাতিক থেকেই – “হ্যাঁরে বাবা, তোমাদের স্কুল ঠিকঠাক হচ্ছে ? ক্লাস হচ্ছে?” প্রশ্ন শুনে একটু থতমত খেয়ে যায় ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেটি। তারপর সামান্য দাঁড়িয়ে ঘাড় নেড়ে বলে- “হ্যাঁ”। বুঝতে পারি আমার এমন প্রশ্নের জবাব হয়তো ওর কাছে অজ্ঞাত। আসলে এখন ওঁরা খাতাতেও এমন উত্তর লিখতে অভ্যস্ত। সংক্ষিপ্ত।
বিকেলের দিকে পেয়ে যাই এক পথচারী মাস্টারমশাইকে। আমার পরিচিত নন। হাতে ধরা মোবাইল ফোনের বিচিত্র চিত্রদর্শনে ব্যস্ত তিনি। সামান্য নমস্কার জানিয়ে জিগ্যেস করি – “স্যার, আপনাদের স্কুলে কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা তো”? একটু চুপ করে থেকে বললেন – “আমাদের দুজনের ঘাড়ে কোপ পড়েছে । এদের মধ্যে একজন অঙ্কের টিচার , মিউচ্যুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে এসেছিলেন। অন্যজন গ্রুপ ডি স্টাফ। কাজগুলো ভাগাভাগি করে করছি।” এইটুকু বলে ভদ্রলোক নিজের পথে পা বাড়ান।
সন্ধের ঠিক মুখে দেখা পাই এক ব্যস্ত অভিভাবিকার। মেয়ের ঢাউস সাইজের থলেটিকে মোটবাহকের মতো নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি কিছুটা ধীর পায়ে পথ চলছেন। খানিকটা আগে আগে মোবাইল হাতে চলেছে মেয়ে। বললাম – দিদি, মেয়ের স্কুল ঠিকঠাক হচ্ছে? ওর বোধহয় এবার ক্লাস নাইন হলো, তাইনা?
“না না ওদের স্কুলে কোনো সমস্যা নেই।ওতো সেইন্ট …… তে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়াম, দিল্লি বোর্ড। আজকাল বেঙ্গলি মিডিয়ামে কেউ পড়ে না। আর যা চলছে!” এগিয়ে যান তিনি।
মাননীয় পাঠকগণ, আমাকে মাফ করবেন। এখনো অবধি আমার বক্তব্য যথেষ্ট ঝাঁঝালো হয়নি বলে। কিন্তু এ কথার মানে তো এই নয় সবকিছু বিলকুল ঠিকঠাক চলছে বলে হাঁটা দেবো। সবকিছুকে মেনে নিয়ে নিরাসক্ত হয়ে বসে আছি ? যে পরিস্থিতিতে আমাদের সরকার পরিপোষিত শিক্ষায়তনের প্রায় ২৬০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীকে হঠাৎ করে বাতিল অযোগ্য বলে বরখাস্ত করা হলো , তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে কার বা কাদের চূড়ান্ত গাফিলতির জন্য? এই অব্যবস্থার দায় নেবেন কে? আজ প্রতিবাদীরা তাদের হৃত সম্মান , খুইয়ে যাওয়া কাজ ফিরে পেতে চাইলে তাঁদের ওপর পুলিশ আত্মরক্ষার নামে লাঠি আর লাথি চালাবে? এ কেমন শিষ্টাচারের উদাহরণ? অমুক রাজ্য হলে এই হতো, তমুক আমলে এই হয়েছে, এসব বলে নিজেদের অপকর্মকে চাপা দেবার অপচেষ্টাকে তীব্র কন্ঠে ধিক্কার জানাই।এটাই প্রথম এবং একমাত্র প্রতিক্রিয়া আমাদের সকলের।
এদেশে শিক্ষা, বিশেষত পাবলিক বা আম আদমির শিক্ষা আগাগোড়াই অবহেলিত। এই ক্ষেত্রটিকে দুর্বল, ভঙ্গুর করে ফেলতে পারলে , সেই খিড়কির পথ বেয়ে বেসরকারি বিনিয়োগের বেনো জল ঢুকবে হুড়মুড় করে। এর মধ্যেই গ্রামে গ্রামে ঢুকে পড়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিসেবিত স্কুল। তাদের চটক বেশি। ঠাটবাট আরও বেশি। দলে দলে সেখানে হাজির হচ্ছেন পকেটভারী নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তানরা।দিনের পর দিন এসব দেখেও আমরা সদাশিব হয়ে অচঞ্চল থেকেছি। নব্বইয়ের ফেলে আসা দশকে যেদিন স্কুলে স্কুলে দলে দলে আংশিক সময়ের শিক্ষকদের পাঠানো হলো, সেদিনই প্রমাদ গুনেছিলাম এক নতুন বিভাজনের পর্ব শুরু হলো বলে। আর আজ? শিক্ষক নিয়োগের গোটা ব্যবস্থাটাই নানান স্তর উপস্তরে দীর্ণ। যেদিন কানে এসেছিল – “আমি হায়ার সেকেন্ডারি সেকশনের জন্য অ্যাপয়েন্টটেড। আমি ফাইভ সিক্সের ক্লাসে যাবো না।” সেদিনই বুঝেছিলাম এক গহীন অন্ধকার, মন্দ্র মন্থর গতিতে গ্রাস করতে চলেছে আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রটিকে। ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাচ্ছে দেখে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেছে।
আমরা কেউই ভালো নেই, স্বস্তিতে নেই, শান্তিতে নেই । থাকা যায় না। আমাদের শিক্ষক শিক্ষিকাদের একটা অংশ আজ পথে। অথচ অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা একটা নতুন সামাজিক লড়াইয়ে সামিল হবেন বলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। যাঁদের অপদার্থতা ও মতলবী কাজের জন্য এতোগুলো মানুষের এই হাল তাঁদের প্রতি আবারো তীব্র ধিক্কার জানাই। পথে নামা বন্ধুরা,আপনাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। এই পথ এক বন্ধনহীন গ্রন্থিতে বেঁধে রাখুক আমাদের। এই ঘোলা জল আবার নতুন করে কবে পরিচ্ছন্ন হবে তার অপেক্ষায় রইলাম। নতুন বাংলা বছরের আগাম শুভকামনা রইলো সকলের জন্য। ধন্যবাদ।
নীলষষ্ঠী। ২০২৫.০৪.১৩.
যেভাবে ক্রমাগত অন্যায় ঢাকা দিতে নতুন করে অন্যায় করা হয়েছে ,সংশোধনের চেষ্টা না করে বিচারপতি, আইনজীবী এদেরকে দোষারোপ করা হচ্ছে তা খুবই হতাশজনক। সাধারণ বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি তুলে দেওয়ার যে চক্রান্ত চলছে বলে শোনা যায় তা নিতান্তই কষ্ট কল্পনা নয় বলেই মনে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্রমাগত শিক্ষা ক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য বেড়েই চলেছে। সুসময় আসবে এমন আশা করি না।
সৌমেন রায় মশাইকে অনেক ধন্যবাদ মন খুলে কথালাপ করার জন্য। যে পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এনে ফেলেছি তা কখনোই সংবেদনশীল কোনো মানুষকে সামান্যতম স্বস্তি দেয়না, দিতে পারেনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাকটি আমাকে তীব্র ধাক্কা দেয় — এ আমার তোমার পাপ। শিক্ষা নিয়ে আমাদের সার্বিক অবহেলা আজকের এই ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির জন্য দায়ী। আমাদের সবথেকে বড়ো মুশকিল হলো আমাদের কাছে মানুষের মানুষী পরিচয়ের তুলনায় তাঁর বা তাঁদের ভিন্নতর পরিচয় ক্রমাগত বড়ো হয়ে উঠছে। ফলে বাড়ছে সংঘাত, বাড়ছে বৈষম্য। একসময় তথাকথিত প্যারা টিচারদের বসানো হতো আলাদা ঘরে। নতুন বিধিনিয়মের সৌজন্যে যোগদান করা মানুষেরা নিজেদের স্বতন্ত্র রাখতেই ব্যস্ত রইলেন দীর্ঘদিন । তাঁদের মূল যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে। এসব কথা বলছি মানে এই নয় যে এমন মর্মান্তিক পরিণতি যথার্থ হয়েছে। অপদার্থ , স্বার্থান্বেষী, অপরিণামদর্শী যেসব মানুষের জন্য এতোগুলো মানুষের জীবন এমন সহসা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লো তাঁদের প্রতি জানাই তীব্র ধিক্কার। জানি একথায় তাঁদের অবস্থার সামান্য উন্নতি হবে না।
ভালো থাকবেন সৌমেন বাবু । এইকথা লেখার জন্য আবারো ধন্যবাদ জানাই।