কন্নৌজ।
ইতিহাস বলে সেন আমলে বাঙালি বামুনরা সকলেই নাকি এসেছিল উত্তর প্রদেশের এই শহর থেকে। আজও এই বামুনদের রক্তে ৭২% আর্য রক্ত বইছে। একদা রাজা মিহিরভোজ ও হর্ষবর্ধনের রাজধানী এই কন্নৌজ বা পুরাকালের কন্যাকুব্জকে বলা হয় প্রাচ্যের গ্রেসি নগরী। অসামান্য আতর তৈরি হয় এখানে আজ কয়েক সহস্রবছর ধরে। বর্তমানে এর জনবসতি এক লাখেরও কম। আর নারীশিক্ষার হার, ৫৬%।
আসুন, আজ এই শহরের এক অতি সাধারণ মানুষের গল্প বলি।
একরত্তি মেয়েটা। বড় বড় চোখ; শ্যামলা গায়ের রং। পাঁচ ফুটও পুরো নয় বোধহয়। বছরখানেক আগে যখন প্রথম দেখেছিলাম, মনে শঙ্কা জেগেছিল, এ মেয়ে টিঁকে থাকতে পারবে তো? এম ডি মেডিসিন করার চাপ ভয়ঙ্কর। প্রতিবছর দু-একজন ছেড়ে চলে যায় অন্য কোনও স্ট্রিমে, যেখানে কাজ কিছুটা কম।
মুখটা দেখলে মনে হতো বড়জোর ষোলো-সতেরো বয়েস। মনে হতো, বড় গোল চশমাটা বোধহয় মায়ের কাছ থেকে এক ফাঁকে ধারে নেওয়া। সদাই গম্ভীর মুখ, অথচ দু’চোখে একটা ভ্যাবাচাকা খাওয়া চাহনি। এই চাহনিটা যদিও আমার চেনা, সব ফার্স্ট ইয়ার পিজির চোখেই দেখি প্রথম দু-এক মাস। মনে আছে, একদিন রাউন্ড শেষে লিফ্টে করে নামার সময় বলেছিলাম ওকে, তুই হাসিস না কেন রে?
শুনেই হেসে ফেলেছিল ও। এত স্বচ্ছ অমলীন হাসি আমি কমই দেখেছি।
একটু খুঁড়িয়ে হাঁটত ও। রাউন্ডে বারেবারে পিছিয়ে পড়ত। সরাসরি প্রশ্ন না করলে মুখ খুলত না। খুললেও, জবাব আসত খুব মৃদু কণ্ঠে, থেমে থেমে। ছ’মাস পরেও ওর কনফিডেন্স লেভেল বেশ কম ছিল। কিন্তু কাজে কোনও ভুল চোখে পড়েনি। কাজ ছাড়া দেখিনি কখনও। ক্লাসে কয়েকবার বকাঝকা খেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটাও স্পোর্টিংলি নিয়েছে প্রতিবার।
মুখে প্রসাধনের লেশমাত্র নেই, অতি সাধারণ জিনস্-টপ বা কুর্তি পরে, এক বেণী পিঠে দুলিয়ে দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছিল ও ততদিনে। যদিও চোখে পড়ার মতো কোনও দিক থেকেই আহামরি কিছু ছিল না ওর মধ্যে। হয়ত তাই বাকি স্টুডেন্টদের থেকে কিছুটা কমই ফোকাস থাকত আমার ওর প্রতি। হাসপাতালের ব্যস্ত চলচিত্রের নেপথ্যে – নিঃশব্দে আড়ম্বরহীনভাবে মিশে গেছিল ও।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে ওর একটা অপারেশন হলো। জানতে পারলাম কলেজে পড়ার সময় বড়সড় একটা দুর্ঘটনায় ডান পায়ে মারাত্মক চোট পেয়েছিল ও। হাঁটুর ওপরে ও নীচে দুটো ইস্পাতের রড লাগানো আছে। হাঁটতে পারে, কিন্তু অনেকটা জায়গা জুড়ে চামড়া উঠে যাওয়ায় বিশ্রী দাগ হয়ে গেছে। সেটার জন্যই প্লাস্টিক সার্জন স্কিন গ্রাফটিং করেছে। যাতে দাগটা আর না থাকে।
দু’সপ্তাহ ভর্তি ছিল ও। ওর মা এসে থাকত ওর সাথে। আমি রোজ রাউন্ড শেষ করে দলবল নিয়েই একবার যেতাম ওর ঘরে। প্রথম ক’দিন খুব কষ্ট পাচ্ছিল। কিন্তু প্রশ্ন করতেই জবাব পেতাম, ভালো আছি স্যার। এর পর আরও মাসখানেকের রেস্ট অ্যাডভাইজ করা হয়েছিল ওকে। মার্চের ৮ তারিখে ওরা বাড়ি চলে গেল। আর আমরা হঠাৎ করে জড়িয়ে পড়লাম করোনার এই মহামারীতে। এতকিছুর মধ্যে, ভুলেই গেছিলাম ওর কথা।
কিছুদিন আগে হঠাৎ ওর ফোন এল। বলল, ও এখন সুস্থ। কিন্তু লকডাউনে আটকে পড়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। ভেবেছিল লকডাউন উঠে গেলে ফিরবে। কী করবে ও এখন?
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় আছিস এখন, বাড়ি কোথায়?
বলল, কন্নৌজ।
কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপর বললাম, দেখ মা, এই দুঃসময়ে তুই না এলেও বিশেষ কিছু গণ্ডগোল হবে না। বড়জোর ডিগ্রিটা তিনমাস পিছিয়ে দেবে ইউনিভার্সিটি। আর এলে পরে কিন্তু ডিউটি পড়বে ওই করোনা ওয়ার্ডে। কিন্তু এটাও সত্যি, ভবিষ্যতে ডাক্তারদের কী চোখে দেখবে মানুষ তা’ অনেকটাই নির্ভর করবে আজ আমরা কী করছি তার ওপর। এবার তুই ভেবে ঠিক কর।
পরের দিন বিকেলে ও আবার ফোন করল। বলল, ওখানকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে দিল্লির সীমান্ত পর্যন্ত আসার পারমিট বার করে নিয়েছে ওর বাবা। কিন্তু সমস্যা হলো, দিল্লিতে ঢুকবে কী করে ও? গাড়ি নিয়ে যদি কোনরকমে ঢুকেও পড়ে, ফিরবে কী করে উত্তর প্রদেশে ওর বাবা আর ছোটকাকা?
বললাম, ভোর ভোর আমার বাড়ি চলে আয়। আমি তো নয়ডায় থাকি। তারপর কিঞ্চিৎ খেয়েদেয়ে যাওয়া যাবে হাসপাতালে দু’জনে মিলে। চেষ্টা কর সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছতে।
একঘন্টা পরে ফোন করে ও জানাল, ওরা আসছে। আমি লেগে পড়লাম রান্না করতে। রান্না করাটা আমার নেশা। আর এতো অতিথ! কতদিন পর কেউ আসছে আমাদের বাসায়।
পরদিন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটায় ওর ফোন এল – স্যার পৌঁছে গেছি।
মেথির পরোটা, ডিমের কষা, ঝাল ঝাল আলুর দম আর পাঞ্জাবি ছোলে সহকারে ওরা তিনজন ব্রেকফাস্ট করছিল। আর আমি ভাবছিলাম এই একরত্তি মেয়েটার সাহসের কথা। কী কী আলোচনা হয়েছিল ওর পরিবারে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে? ওর মা নিশ্চয়ই খুব কেঁদেছিল!
কিছুক্ষণ পর গাড়ির পেছনের সিটে ওর দুটো ব্যাগ রেখে আমরা চারজন একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। যা কিছু বলার, সবই না-বলা থেকে গেছিল। শুধু ওর বাবা বলেছিল, বহুৎ বহুৎ শুক্রিয়া ডক্টরসাব। আমি হেসে বলেছিলাম, শুক্রিয়া তো মুঝে আপকা অদা করনা চাহিয়ে খান সাহেব।
বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা হাসপাতালের পথে। আমিই মাঝেমধ্যে কথা বলছিলাম। ও ওর স্বভাবমত এক-দু’কথায় উত্তর দিচ্ছিল। হাতদুটো মুঠি করে কোলের কাছে ধরা। জানতে পারলাম নিউ দিল্লি কালীবাড়ির পাশেই একটা মেসে থাকে ও। একটা স্কুটি আছে। তাতেই আসা-যাওয়া করে।
রমজান মাস। কোথায় রোজা, কোথায় সেহরি! আমরা এগিয়ে চলেছিলাম মহামারির কবলে বন্দি দিল্লি শহরের প্রায় জনমানবশূন্য রাজপথ ধরে।
আর আমার ঠিক পাশে, দুর্জয় নিশ্চয়ে বুক বেঁধে এগিয়ে চলেছিল দেশের এক অনন্য সেনানী।
ইতিহাস বর্তমান সব অবলীলায় মুছে ফেলে, কন্নৌজের আতর আজ ইস্পাতে পরিণত হয়েছে।
করোনাব্দ, ০৫০৫২০২০।
One Response
দারুন। স্যালুট।