দাদাকে কয়েকটা ওষুধ দেওয়ার ছিল। এয়ারপোর্ট স্টপেজে পৌঁছে দাদা ফোন করলে, আমি দমদম স্টেশনের নিচে এগিয়ে গেলাম। বাসগুলো যেখানে দাঁড়ায় সেখানেই আমার দাঁড়ানোর কথা। কিন্তু জায়গাটায় বেশ ভিড় দেখে একটু দূরে, সাবওয়ের ছায়ায় দাঁড়ালাম। ওখানে দাঁড়িয়ে বাস স্টপেজের দিকে লক্ষ্য রাখলাম।
এই সময়টায় ওখানে অনেক লোকের যাতায়াত। এক এক বার মনে হচ্ছিল, লোকে ধাক্কা দিয়ে যাবে। এক সময় দেখলাম, এক মহিলা আমার থেকে তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে হাতের ছোট ব্যাগ খুলে কিছু বের করছেন। একটা পাঁচ টাকার ভাঁজ করা নোট ওনার ব্যাগ থেকে রাস্তায় পড়ল। মনে হল উনি দেখেছেন। কিন্তু দেখলাম উনি টাকাটা না তুলেই হেঁটে চলে যাচ্ছেন। একবার ডাক দিলাম। বেশ লোকজনের চলাচল, তাছাড়া আমার মুখে ভালোকরে আটকানো মাস্ক। শুনতেই পেলেন না।
আমার ডাকাডাকি দেখে একটি কম বয়সি মেয়ে একবার ফিরে দেখে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যে, অন্তত কুড়ি জন লোক ঐ জায়গাটা দিয়ে হেঁটে গেল।
সবাই বেশ ব্যস্ত। তাহলে কি কারো চোখেই পড়েনি পড়ে থাকা টাকাটা? দু এক জনের চোখে নিশ্চয়ই পড়েছে। কিন্তু রাস্তা থেকে টাকা কুড়িয়ে নেওয়ার লোক আজকাল প্রায় দেখাই যায় না। আমি দূরে দাদা আসছে কি না লক্ষ্য রাখছিলাম। আর মাঝে মাঝে টাকাটার কি গতি হয় দেখছিলাম। এক একবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি কেউ জুতো দিয়ে মাড়িয়ে যাবে।
কদিন আগেই দেখেছি, ঐ সাবওয়ের নীচে দশ পনেরোটা অতি দরিদ্র পরিবার ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে বাস করছে। আজ আর তাদের কাউকে দেখলাম না। এদিকে দাদার আসার সময় হয়ে এসেছে, নির্দিষ্ট জায়গায় এবার যাওয়া দরকার। নানান রকমের চিন্তা করে টাকাটা তুলে নিয়ে, একটু এগিয়ে কোন ভিখারী পাই কি না দেখতে চাইলাম। পাঁচ সাত হাত এগিয়েই বাম দিকে, প্লাটফর্মে ওঠার সিঁড়ির মুখে দেখি একজন বৃদ্ধা হাত পেতে বসে আছেন। ওর হাতে টাকাটা দিয়ে ভারমুক্ত হলাম।
ওখান থেকে সাত হাত দূরে আমার নির্দিষ্ট জায়গাটিতে দাঁড়ালাম। মাথার ওপর দিয়ে পাঁচ নম্বর রেল লাইন চলে গেছে, তাই একটু ছায়া পাওয়া যায়। আমি দাঁড়ানোর প্রায় সাথে সাথেই একজন লোক এসে আমাকে একটু সরিয়ে, আমার মাথার কাছে একটি মন্দিরের বাক্সে একটা টাকা ফেলে গেলেন। আরও জন তিন- চার মহিলা পুরুষ এসে, আমাকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে ঐ মন্দিরে টাকা দিলেন। অন্তত দু’জন কম বয়সি মেয়ে, ঠাকুরের বাক্সে হাত না পেয়ে, পুরোহিতের হাতে টাকা দিলেন। এবার একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, মন্দিরে একটি কালী মূর্তি।
আমি যে মিনিট পাঁচেক ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, একটি লোককেও দেখলাম না, ঐ বৃদ্ধার হাতে কেউ কিছু দিলেন। হতে পারে আমি যখন মন্দিরে কি মূর্তি আছে দেখছিলাম, সে সময় কেউ ওনার হাতে পয়সা দিয়ে চলে গেছে, আমার চোখে পড়েনি। আমি ছায়ার জন্য মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু ঐ মহিলাকে বাধ্য হয়েই রোদে বসতে হয়েছে।
রোদ সোজা ওনার মুখে এসে পড়ছিল, তাই উনি গায়ের চাদরটা কপালের ওপর টেনে রোদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন। আমি ওনার মুখটা দেখতে পাই নি। এই রকম দু একজন মহিলাকে স্টেশনে বা রেল গাড়িতে ভিক্ষা করতে দেখেছি। কোনদিনই এদের জীবনের ইতিহাস জানার চেষ্টা করিনি। সাহস হয় নি।
একটু খোঁজ করলেই সমাজের এক দুঃখজনক দিক বেরিয়ে আসবে নিশ্চিত। হয়তো কেউ নিঃসন্তান, কিংবা কারো ছেলে বের করে দিয়েছে বাড়ী থেকে। আজ এই সামান্য দশ মিনিটে আমার দুটি কথা মনে এল। আমাদের স্কুল পাঠ্য একটি কবিতা ছিল, Somebody’s mother, এতো নিশ্চয়ই কারো মা ছিলেন।
এত মানুষের, মন্দিরের বাক্সে পয়সা ফেলা দেখে মনে এল নজরুলের গানের কলি; “খড়ের প্রতিমা পূজিস রে তোরা, মাকে তো তোরা পূজিস নে। প্রতি মার মাঝে প্রতিমা বিরাজে, হায় রে অন্ধ বুঝিস নে”।
মন্দিরের দেবীর লজ্জায় জিভ কাটার আসল কারণটা হঠাৎই বোধগম্য হলো। কবি লিখেছেন, “ভীরু সন্তানে হেরি লজ্জায়…………” । আমার কিন্তু মনে হল , ভক্তদের নির্বুদ্ধিতা দেখেই মা কালী লজ্জায় জিভ কেটেছেন।