লুই বুনুয়েল আমাদের অবচেতনা নিয়ে ছেলেখেলা করেছেন। আমাদের গোপন সন্তপ্ত যৌন আকাঙ্খাকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করেছেন। যাকে আমরা সরিয়ে রাখি দূরে, মনে করি স্বপ্নের বিকৃত রূপ তিনি তারই অনুসন্ধান করেছেন, তাকে প্রশ্ন করেছেন এবং আমাদেরকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ফ্রয়েডিয়ান অবদমিত চিন্তা, কামনা, পাপ তাঁর স্যুররিয়ালিস্টিক আর্টের ছোঁয়ায় অনবদ্য হয়ে উঠেছে।
বাস্তবের সাথে স্বপ্নকে তিনি এমনভাবে মিশিয়েছেন যে স্বপ্নকে আর স্বপ্ন বলে মনে হয় না। ‘বেল দ্য জুর’ দেখার পরে শেষ দৃশ্যে এসে আপনার মনে হবে আপনি এতক্ষণ যা দেখলেন পুরোটাই কি তবে নারীটির যৌনস্বপ্ন ছিল? ‘ত্রিস্তানা’ তে গির্জার ঘন্টাকে অবিকল পুরুষাঙ্গের মত দেখতে লাগার পর যখন সেখানে দন লোপের কাটা মুন্ড ভেসে ওঠে তখনও আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে এটা স্বপ্নই তো? কিংবা ‘ভিরিদিয়ানা’তে যখন নারীটি ঘুমের মধ্যে চোখ খুলে হেঁটে চলেছে তখন আপনার সন্দেহ হবে সে কি সত্যিই ঘুমন্ত? স্যুররিয়ালিস্ট বুনুয়েল তাঁর সকল সিনেমায় এভাবেই স্বপ্ন আর বাস্তবকে মিশিয়ে এক করে দিয়েছেন।
তাঁর আত্মজীবনী ‘শেষ দীর্ঘশ্বাস’-এ তিনি বলেছেন স্বপ্ন দেখার জন্যই তিনি বারবার ঘুমোতে চান। একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখার জন্য বারবার ঘুমোতেও তাঁর কোনো আপত্তি নেই।
‘আন্দালুশিয়ান কুকুর’ এর পরে বুনুয়েলের ছবিতে স্যুররিয়ালিজম খুব প্রকট হয়ে আসে নি। এসেছে বাস্তবের হাত ধরে। তাই তা আরও শিল্পিত হয়ে উঠেছে। বুনুয়েল যখন ‘আন্দালুশিয়ান কুকুর’ পারীতে প্রথম প্রদর্শন করান তখন পকেটে কিছু ইঁটের টুকরো রেখে দিয়েছিলেন। প্রদর্শনীতে এসেছিলেন তখনকার স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলনের দিকপালেরা। আন্দ্রে ব্রেঁতো, এল্যুয়ার প্রমুখ। তাই বুনুয়েল ঠিক করে রেখেছিলেন এঁরা সিনেমাটিকে নিয়ে গালাগালি করলে তিনি তাঁদের দিকে সেইসব পাথর ছুঁড়বেন। কিন্তু তার দরকার হয় নি। এই সিনেমার পরেই বুনুয়েল সেই যে পরাবাস্তবতার জগতে প্রবেশ করলেন তা সারাজীবন ধরেই তাঁর সাথে ছিল। স্যুররিয়ালিস্ট আন্দোলন শুরু হয়ে কবেই মিলিয়ে গেছে। বুনুয়েল তাঁর জগত ছেড়ে সরে আসেন নি।
শুধু পরাবাস্তবতা নয় আমাদের গোপন যৌন কামনা-বাসনা তাঁর স্টাডি। ভালোবাসা নয়, প্রেম নয়- কামনা। তিনি কামনার জয়গান গেছেন। ছিঁড়ে ফুঁড়ে দেখতে চেয়েছেন একজন স্যাডোম্যাসোচিস্টিক নারী বা পুরুষের মনোজগত। বেল দ্য জুরে নারীটি এক সম্পন্ন দাম্পত্যের ফাঁদে ফেসে গেছে। সে তার স্বামীর সাথে মিলনে আনন্দ পায় না। সে আঘাত পেতে চায়। চায় কঠিন পুরুষকে। তাই পাকেচক্রে পারীর এক অভিজাত পতিতালয়ে যাতায়াত শুরু করে। সেখানে বিত্তবান মানুষদের বিভিন্ন যৌন খেয়ালের সাক্ষী হয়। নিজে হয় সেই ‘বিকৃত’ মানুষগুলোর খেলার পুতুল। সারা সিনেমায় তার হাসিমুখ কোথাও নেই। শেষে এক মান্দারিন পুরুষের সাথে সঙ্গম করে যখন ক্যামেরা চারিদিকের অবিন্যস্ত বিছানা জামাকাপড় দেখাচ্ছে তখনই নগ্ন নারীটির হাসিভরা মুখ ফুটে ওঠে। আবহে ভেসে আসে বিড়ালের মিউ, টমটমের ‘টুং টুং’। এইসব আওয়াজ তার ভেতরের কামনা জারিয়ে তোলে বহুগুণ। অথচ তার স্বামী পিয়েরের সাথে তার ‘প্রেমের’ সম্পর্ক। দাম্পত্যের নিশ্চিত শেকল।
‘দ্যাট অবস্কিওর অবজেক্ট অফ ডিজায়ার’-এ এক বৃদ্ধ প্রেমে পড়েছেন তাঁরই এক যুবতী পরিচারিকার। প্রেম নয় সম্পর্ক সম্পূর্ণ কামজ। মেয়েটি তাকে সমানে লেজে খেলাচ্ছে। বারবার তাঁর থেকে সরে যাচ্ছে কিন্তু ঘটনার মোচড়ে আবার তাদের দেখা হয়ে যাচ্ছে। এই সিনেমাটিতে বুনুয়েল একটি অসাধ্যসাধন করেছেন। একটি বহু আলোচিত মাস্টার স্ট্রোক। কনচিতার চরিত্রে একই সাথে দুজন নায়িকাকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন। একই নারীর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ, খেয়াল, লাস্য, মুড বোঝাতে তিনি এই যে কাজটি করেছেন সেটির মাধ্যমে কনচিতার চরিত্রটিকে আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন। আমাদের বিশ্বাস আদায় করা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। সার্বিকভাবে তাঁর স্যুররিয়ালিস্ট আইডিয়াকে আমাদের মাথায় পুঁতে দিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করাই তার লক্ষ্য এবং তাতে তিনি সাঙ্ঘাতিক সফল হয়েছেন।
কনচিতার গায়ে যখন ট্রেনের কামরা থেকে জল ঢেলে দিচ্ছেন বৃদ্ধটি এবং শেষে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বৃদ্ধটির মাথায় একইভাবে বালতি দিয়ে সে জল ঢেলে দিচ্ছে এবং এত জ্বালার পরও তারা আবার একই সাথে হাত ধরে গাড়িতে উঠছে এসব দেখতে দেখতে অন্য কোনো পরিচালক হলে আপনি হল ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন কিন্তু বুনুয়েল বুনুয়েল তার উইটের জন্য। তাই আপনি অবলীলায় তাকে জাস্টিফাই করে ফেলবেন।
ত্রিস্তানা সিনেমার বিষয়ও খানিকটা এক। এক বৃদ্ধ যিনি এক মহিলার মৃত্যুর পরে তার মেয়ের ভরনপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন পিতা হিসেবে মেয়েটি যুবতী হলে তার সাথে জোর করে সহবাস করেন। তাঁর যুক্তি খুব সোজা। তিনি তাকে বোঝান ত্রিস্তানার ভাগ্য ভালো যে সে তাঁর বাড়িতে আছে। পথে নামতে হলে তার অবস্থা আরো খারাপ হত। ত্রিস্তানা শেষে এক শিল্পীর সাথে প্রেম করে চলে যায়। দুবছর বাদে ফিরে আসে পায়ে গ্যাংগ্রিন নিয়ে। তার একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়। এরপরই তার চরিত্রের টোনালিটি আমূল বদলে যায়। তার প্রেমিককে সে প্রত্যাখ্যান করে পালিত পিতার বাড়িতেই রয়ে যায়।
যদিও সে শেষে তার পিতাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় এবং কঠোরভাবে সহবাস প্রত্যাখ্যান করে। ত্রিস্তানায় যখন বৃদ্ধটি চার্চের যাজকদের সাথে ঘরে খানাপিনা করছেন তখন বাইরে করিডোরে তার ক্রমাগত ক্রাচ নিয়ে হাঁটাকে দেখে আপনার মনে হবে এ যেন কোনো স্বপ্নদৃশ্য। সেদিন রাতেই তার স্বামীর যখন হার্ট অ্যাটাক হয় তখন ডাক্তার না ডেকে সে মধুর প্রতিশোধ নেয়। জানালা খুলে দ্যায় যখন বাইরে প্রবল তুষারপাত হয়ে চলেছে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই সে জানালা বন্ধ করে।
বুনুয়েল আপনাকে বিরক্ত করবে। আপনাকে লজ্জিত করবে। একই সাথে জাস্টিফাই করবে আপনার কামনাকে, পাপকে। অন্য সবাই যাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে বুনুয়েল তাকেই গ্রহণ করেছেন। যৌনতাকে তাঁর মত করে আর কেউ দেখাতে পারেন নি। স্বয়ং গোদার পর্যন্ত এই কথা বলেছেন। যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত মনোবিকলনকেও তাঁর মতো করে কেউ দেখাতে পারেন নি। তিনি আদ্যন্ত ফ্রয়েডিয়ান। কখনো সরাসরি। বোবা ছেলেটিকে যখন ত্রিস্তানা ব্যালকনি থেকে তার খোলা বুক দেখাচ্ছে তখন সে ঝোপের দিকে ভয়ে সরে যায়। এসব সরাসরি প্রক্ষেপ। তবে বুনুয়েলের মাস্টারি এখানেই যে আপনি তাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন।
অন্য পরিচালকেরা যেসব বিষয় নিয়ে হয় পর্নোগ্রাফি বা মেলোড্রামা করবেন বুনুয়েল তাকে নিয়ে শিল্প করেছেন। তিনি আর্টিস্ট। পাঁকে পদ্মফুল ফুটিয়েছেন। বুনুয়েলের সব সিনেমাই দেখুন। তবে ‘দ্যাট অবসকিওর অবজেক্ট অফ ডিজায়ার’, ‘বেল দ্য জুর’ আর ‘ত্রিস্তানা’ পরপর দেখুন। প্রথমটি বুনুয়েলের শেষ ছবি। তাঁর এই ইরোটিক ট্রিলজির মাধ্যমে আপনি বুনুয়েলের একটি সার্বিক পরিচিতি পেয়ে যাবেন।