লাল ইঁটের রাস্তাটার উপর পিচ পড়ছিল ধোঁয়া উড়িয়ে। ক্রমশই সরু সাপের মতন আঁকাবাঁকা মোরাম এগিয়ে যাচ্ছিল কালিনারায়ণপুর স্টেশন থেকে রাধানগর বাসস্ট্যান্ডের দিকে। হাফ প্যান্ট আর হাফ প্যাডেলে আমরা কয়েকজন সাইকেলটা ডাবল স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ভাবছিলাম আর কদিন। তারপর রেস হবে। যে জিতবে ঝিনুকদি তার।
ঝিনুকদি এলাকার ডানাকাটা পরী। ভিন্ পাড়া থেকে তাঁর বাড়ির সামনে বেল বাজায় ক্লাস টেন, ক্লাস টুয়েলভ। এপাড়ায় ওপাড়ায় ঝিনুকদি ভাগ হয় অজান্তেই। আমাদের সাইকেলে তখন স্পোকে লাগানো রঙিন প্লাস্টিকের বল্টু টাইপ অসংখ্য বুটকি। বাই বাই ঘুরলে রঙিন আলোর মত লাগে। চেন পড়লে তুলতে হয় প্যাডেল ঘুরিয়ে। আমরা মানে আমি,অবনী, ফটিক, বান্টি স্কুল মাঠে লাট্টু ঘোড়াই, সুতোর টানে চেটোতে তুলেনিই ফটাকসে। শোলের ডায়লগ ঝাড়ি , এক্ এক্কো চুন চুনকে মারুঙ্গা। চুন চুঙ্কে..সন্ধ্যা নাবলে নুঙ্কু বের করে কালো পিচের উপর হিসু দিয়ে লিখি ঝিনুকদি।
ঝিনুকদি এক্ ক্লাস উপরের। ফ্রক পরে দুপাশে বিনুনী ঝুলিয়ে হাঁটলে তার ফর্সা ঘাড়ে অগোছালো চুল দেখা যায়। ভয়ঙ্কর সাদা সেই ঘাড়ের কথা ভাবতে ভাবতে আমরা কামড় বসাই লম্বুতে। হাতের চেটোতে লম্বুর গুঁড়ো আর চিনি চাটতে চাঁটতে অপার্থিব সব সিনেমায় ডুবে যাই অহরহ। গোলপোস্টের বাঁশ ধরে হাত বাড়াই, সিমরণের দিকে.. যেন এক্ষুনি ঝিনুকদির গুঁফো বাবা বলবে, বলতে বাধ্য হবে, যা সিমরণ যা, জী লে আপনি জিন্দেগি…। কিন্তু সেসব হয় না বলেই রাগে রাগে ক্যাম্বিসের বল মিড অন দিয়ে সপাটে উড়িয়ে দিই ঝিনুকদিদের কোয়ার্টারের দিকে। সেখানে তখন সন্ধ্যাবেলা ঘাড়ের কাছে পাউডার মেখে গান শিখছে ঝিনুকদি। আগুনের পরশমণি.. টেরিকাটা গানের মাস্টার ওর হাতের আঙ্গুল ধরে ধরে হারমোনিয়ামের রিড চাপছে। সামনে চায়ের কাপ। মালটাকে পরদিন শিওর সাইকেল বাঁধিয়ে ফেলে দেব। শালা শুয়ার কী আওলাদ….
অথচ সে এসব দেখেও দেখে না। বিকেল বেলা মায়ের সাথে পড়তে যায়। ফেরার সময় অঙ্ক স্যারের বাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অমরেস্পুরী। বালটাকে একদিন ঠিক ঢিল মারবো, ঠিক।
সেই ঝিনুকদি সেদিন এল। চেম্বারে। বর মারা গেছে। করোনাতে। ঝিনুকদির মেয়েটার জ্বর। মাথা ব্যথা। অবিকল সেই ছোটবেলার ঝিনুকদি।
কিরে কোন ক্লাস?
ক্লাস সেভেন, স্যর।
কনভেন্ট সম্ভবত। উচ্চারণ সেরকমই। ডেঙ্গু করতে দিয়ে, জিজ্ঞেস করি: কেমন আছো ঝিনুকদি!
সে হাসে। যে হাসিতে খিলখিল রোদ উঠতো, ফিল্ডার বল ধরতে ভুলে যেত, হার্ট বিট বেড়ে যেত আমাদের, সেখানে আজ অদ্ভুত শূন্যতা।
ফেলে আসা রাস্তার উপর চকচকে মোড়াম ঢেকে দিয়েছে কত কিছু।
যাকগে যাক। সেসব কাহানি থাক। তার চেয়ে আসুন একটা অনুরোধ করি। দুটো বন্ধুর ছেলেবেলা আর বন্ধুত্বের গল্প নিয়ে তৈরী ‘দোস্তজী’ দেখে আসুন। আগামী শুক্রবার কল্যাণী সঙ্গমে। আর রিলেট করুন নিজেদের বন্ধুত্বের দিনগুলির সাথে।