৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ অভয়া তিলোত্তমার বত্রিশতম জন্মদিন। ৯ অগাস্টের নির্মম নৃশংসতা ছিনিয়ে নিয়েছে তার জীবন, হত্যা করেছে পরিবার ও পরিজনের আশা স্বপ্ন। এই হিংস্র অপরাধের বিচারের দাবিতে বিগত ৬ মাসে বাংলা জুড়ে চলছে এক মরণপণ লড়াই। গতকাল তারই এক উত্তাল প্রবাহের সাক্ষী হয়ে রইল সারা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ।
এই নারকীয় অপরাধ ঘটার কালো দিনেই শুরু হয়েছিল আলোর দিকে যাত্রা- পাশবিকতার আকস্মিক আঘাতে স্তম্ভিত বিবেকবান মানুষ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে সমবেত হয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। আর জি কর হাসপাতালের ছাত্র-চিকিৎসকরা প্রথম প্রতিরোধ শুরু করেন, এই প্রতিরোধে যোগ দিতে ছুটে আসেন জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস এর সিনিয়র চিকিৎসকরা। কিছু পরে আসেন অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-ছাত্ররা এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মরদেহ নিয়ে এন আর এস হাসপাতালে আসা একটি রাজনৈতিক দলের যুবনেত্রী ও যুবনেতা। বিভিন্ন শিবির থেকে আসা ভিন্ন চিন্তার মানুষ শাসকের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক জোট হয়ে প্রতিবাদ করেন। সেদিন থ্রেট কালচারের পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে সংখ্যার লড়াইয়ে পেরে ওঠেন নি প্রতিবাদীরা, দ্বিতীয়বার ময়না তদন্তের দাবি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সক্রিয় তৎপরতায় দেহ পুড়িয়ে ফেলে কর্তৃপক্ষ। ভয়তন্ত্রের সাফল্য সেই পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু লড়াইটা শেষ হলনা, শুরু হল।
৬ মাস ধরে উপলবন্ধুর পথে দীর্ঘ লড়াইয়ের ভরবেগ এক ই থাকতে পারেনা, কিন্তু লড়াইটা জারি আছে আর এই অবিচ্ছিন্ন লড়াইয়ের একটা বিশেষ দিন ছিল গতকাল ৯ ফেব্রুয়ারি। আন্দোলনে ভাঁটার টান নিয়ে চর্চা চলছিল আন্দোলনের শত্রু মিত্র দুই শিবিরেই। আবার কলকাতায় হাজার হাজার মানুষের মিছিল দেখিয়ে দিল বারুদ যে কোন মুহূর্তে জ্বলে উঠতে পারে।
বত্রিশতম জন্মদিন আর মৃত্যুর বিচারহীন ৬ মাসের সমাপতন উপলক্ষে অভয়া মঞ্চ মহামিছিলের ডাক দিয়েছিল কলেজ স্কোয়ার থেকে আর জি কর হাসপাতাল পর্যন্ত। অভয়া মঞ্চের দাবি সনদের সঙ্গে সহমত সমস্ত প্রতিবাদী সুস্থ বিবেক সম্পন্ন মানুষকে দলমত নির্বিশেষে মিছিলে যোগ দিতে আহবান জানানো হয়েছিল। বিকেল সাড়ে তিনটের সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে এই ঐতিহাসিক মিছিলের আনুষ্ঠানিক সুচনা হয় মানবজমিন সংগঠনের মিউজিক্যাল টিম ‘গানপন্থী’র গান দিয়ে – ‘ যদি চাও বন্ধু একা নও বন্ধু/ আছে এক লড়াইয়ের মঞ্চ/ এক সাথে লড়বার দুর্নীতি দুর্বার প্রতিরোধের গণমঞ্চ/ অভয়া মঞ্চ অভয়ার মঞ্চ/ লড়ছে লড়বে অভয়া মঞ্চ …’।
এক নির্ভীক তরুণী চিকিৎসকের হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠন, গোষ্ঠী এবং মতাদর্শের মানুষের যে সহাবস্থান দেখা গিয়েছিল ৯ অগাস্ট আর জি কর হাসপাতালে, ৬ মাস পর তার পরিণত রূপ দেখা গেল ৯ ফেব্রুয়ারির মহামিছিলে। এক ছাতার তলায় আবার সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে সব প্রতিবাদী কণ্ঠ, যেমন হয়েছিল রাত দখলের রাতে, যেমন হয়েছিল ১ বা ২ অক্টোবরের প্রতিবাদ-মিছিলে। মিছিল পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন অভয়া মঞ্চের তিন জন কনভেনর- ডঃ পুণ্যব্রত গুণ, ডঃ তমোনাশ চৌধুরি এবং মনীষা আদক। মিছিলের মুখ যখন বিবেকানন্দ রোড পেরোচ্ছে, মিছিলের শেষ তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে। অগণিত মানুষের সুশৃঙ্খল মিছিল এগিয়ে চলে আর জি কর হাসপাতালের উদ্দেশে। চলার পথে মিছিলে যোগ দেন অভয়ার মা বাবা। অপরিসীম যন্ত্রণা নিয়েও শিরদাঁড়া বিক্রিতে নারাজ মা বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য মিডিয়া র সাংবাদিকদের বাড়তি আগ্রহ এবং তার জন্য কিছুটা বিশৃঙ্খল হুড়োহুড়ি খুব অপ্রত্যাশিত নয়। স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে কনভেনররা অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।
আর জি কর হাসপাতালে চক্রব্যূহ নিরাপত্তা! যুদ্ধের প্রস্তুতি- বিনা অস্ত্রে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। পুলিশ পুলিশ আর পুলিশ। সামনে গার্ড রেল। হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। হ্যাঁ সেই হাসপাতালেই, যেখানে রাত বিরেতে সিভিক ভলান্টিয়ার সেমিনার রুমে চলে যেতে পারে বিনা বাধায়, যেখানে রাতে দুষ্কৃতিরা হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে প্রমাণ লোপাটের জন্য, দর্শক-পুলিশের চোখের সামনে। জুনিয়র ডাক্তাররা এগিয়ে আসেন- আস্ফাকুল্লা নাইয়া, অনিকেত মাহাতো, কিঞ্জল নন্দ, দেবাশিস হালদার। অভয়া মঞ্চের কনভেনরদের সঙ্গে তাঁরাও চেষ্টা করেন পুলিশকে বোঝানোর। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এসেছে জন্মদিনে শহীদ সম্মান জানাতে। পুলিশকে টলানো যায়নি, উপরতলার তাঁদের নির্দেশ ছিল যাঁরা সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদকে ভয় পান। বারুদ কখন যে লেলিহান শিখা হয়ে গ্রাস করে নেয় ক্ষমতার স্বর্ণ শিখর সে কথা কেউ জানে না!
অভয়া মঞ্চের অন্যতম আহবায়ক ডঃ তমোনাশ চৌধুরির অনুরোধে অন্য দুই আহবায়ক ডঃ পুণ্যব্রত গুণ আর মনীষা আদক হাসপাতালের ভিতরে প্রবেশ করে অভয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত ‘Cry of the hour’ আবক্ষের সামনে পুষ্প স্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আসেন। বিপুল জনতা রাস্তায় শৃঙ্খলা মেনে অপেক্ষা করে। প্রায় আধ ঘণ্টা যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয় কিন্তু ভিড় সরিয়ে প্রত্যেকটি অ্যাম্বুলেন্সের জায়গা করে দেয়া হয়। অনেক প্ররোচনা সত্ত্বেও,বিপুল জনবল থাকা সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ ভাবেই শেষ হয় জন্মদিনের মিছিল,আগামী দিনে তীব্র থেকে তীব্রতর প্রতিরোধ গড়ে তোলার শপথ নিয়ে-“গৌরী শৃঙ্গ তুলেছে শির/ বহিছে সিন্ধু গর্জমান”
ফেব্রুয়ারী ১০, ২০২৫
খুব সুন্দর লিখেছ গোপাদি। আমাদের এই আন্দোলন আরও দীর্ঘায়িত হোক। মহা সংগ্রামের রূপ নিক। আমাদের মন সেই দিন হবে শান্ত।
ক্রোধ অশ্রু ভালোবাসা ও প্রতিবাদের অনবদ্য প্রতিবেদন।
ক্রোধ অশ্রু ভালোবাসা ও প্রতিবাদের অনবদ্য প্রতিবেদন