কুয়াশার দিন এল। বড় মায়াবী এইসব দিন। কুয়াশার আবছায়ায় কেমন যেন অব্যক্ত মনকেমন। দূরের ধোঁওয়া ধোঁওয়া দিগন্তে নারকেল-সুপুরি গাছের সারি। সন্ধ্যের লাল সূর্য হাল্কা হতে হতে ঝুপ করে হারিয়ে যায়। সে সূর্যে গনগনে দর্প নেই। সে সূর্য আটপৌরে জীবন, সে সূর্য ডাল-ভাত, সে সূর্য মায়ের আঁচল। শেষ উষ্ণতাটুকু সরে গেলে গভীর, শীতল রাত নামে.. নিস্তব্ধতা নিবিড় হ’লে আমি পেছনে পথ হাঁটি.. আমার একান্ত অতীতবিলাস..
প্রায় দেড় দশক আগে গ্রামের স্কুলে উচ্চ-মাধ্যমিক। তখনও লোকে স্কুল বলতে বাংলা মিডিয়ামই বুঝতো। তখনও বাচ্চারা হিসির বদলে পটি করতে শেখে নি। তখনও ‘রোবিন্দোরনাথজী’-র আবির্ভাব হয়নি। তখনও ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে তুমুল ঝগড়া হ’ত। আইপিএল-আইএসএল ভবিষ্যতের গর্ভে। এরকম একটা সময়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে টেক্সট বইয়ের বাইরে বাড়তি বই কিনে ফেলা মানে বিলাসিতা। ‘এমসিকিউ’-র পুরো নাম ক্লাস ইলেভেনের তিন মাস কেটে যাওয়ার পরে জানতে পেরেছিলাম। শীতের ভোর সাড়ে চারটের উঠে সাইকেলে তিন কিলোমিটার উজিয়ে টিউশন পড়তে গেলে চোখের পাতায় গুঁড়ো গুঁড়ো কুয়াশা, হাত ঠান্ডায় বাঁকা। ভালো ফুল সোয়েটার নেই। ছোট হয়ে যাওয়া গেঞ্জিগুলো (তখনও টি-শার্ট বলতে শিখিনি) ভেতরে, ওপরে তুলনায় চলনসই ঢিলে জামা- যার মধ্যে অনায়াসে দু’খানা ‘আমি’ ঢুকে যেতে পারি। কাঁপতে, কাঁপতে পেরিয়ে যাচ্ছি গ্রামের রেলস্টেশন, স্কুলের মাঠ, খালের ধার.. মনে মনে বিড়বিড় করছি পর্যায় সারণী, ইলেকট্রনের কক্ষপথ, জারণ-বিজারণ..
বহু শিক্ষক দিনের পর দিন বিনে পয়সায় পড়িয়েছেন। হাতে ধরে ভুলগুলো শুধরে দিয়েছেন। আর ব্রণময় গালের অস্থিচর্মসার ঢ্যাঙা ছেলে শ্রমের কাছে আগাগোড়া সৎ থাকার চেষ্টা করে গেছে। কঠিন অঙ্ক কষে ফেলার পর কিংবা নির্ভুল বানানে দশপাতা লিখে ফেলার পর তাঁদের চোখে তৃপ্তির হাসি দেখেছি। নিঃশব্দ উচ্চারণে তাঁদের চোখের ভাষা বলে দিয়েছে, “অরিন্দম.. এর মানে তুই উন্নতি করবি।”
ঘাম আর শ্রমের দাম পেয়েছিলাম। প্রথমবারেই রাজ্যের এক নম্বর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ। আমার সেই শিক্ষকদের কাছে আমি চিরনত, চিরঋণী।
**
আট নম্বর ওয়ার্ডের বছর পাঁচেকের বাচ্চার হিসি দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে যায়। গোটা শরীর ফুলে গেছে। রক্তে ইনফেকশন। এমনিতেই হাত-পা ফুলে গিয়ে শিরা দেখা যায় না, তার ওপর বারবার হাত নাড়িয়ে দেওয়ায় কিছুতেই চ্যানেল করা যাচ্ছিল না। তিনবার ফুটিয়েও হ’ল না। চারবারের বেলা বাচ্চার মা বললেন..
– বাবু, তুমি না ডাক্তার হবে? একটু কষ্ট না করলে ডাক্তার হবে কী করে? দাও দাও.. হাতটা দাও..
বাচ্চাটা কী যেন ভেবে চুপ করে যায়। চ্যানেলও হয়ে যায়। এই অসময়েও কেউ ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে? স্বপ্ন দেখে স্টেথো কাঁধে যন্ত্রণা ছুঁয়ে দেখার?
দশের বাচ্চার বুকের থলি ভর্তি পুঁজ। ফুসফুস কুরে খেয়েছে জীবাণুর দল। আগ্রাসী আক্রমণে বুকের দফারফা। ফুসফুস ফুলিয়ে রাখার ব্যায়াম করতে হয়। একটা নল দিয়ে জোরে হাওয়া টেনে নিলে সামনের রঙিন বল ভেসে ওঠে। যত বেশি জোরে হাওয়া টানা যায়, বল তত ওঠে। বারবার চেষ্টা করতে করতে ছেলেটা আজ বলটা পুরো তুলে ফেলেছে! তার মানে ফুসফুস আবার আগের জায়গায় ফিরে আসছে!
সাত নম্বরের লিকলিকে মেয়েটা টিবির ওষুধ খেয়ে অনেকটা জোর ফিরে পেয়েছে। জ্বর নেই। ঝুঁটি করে চুল বেঁধে মোমরঙে আঁকতে বসেছে পাহাড়.. নদী.. ঝর্নার জল.. সাত ভাই চম্পা.. লালকমল-নীলকমল..
আইসিইউর বাচ্চার নার্ভের রোগ। পা অবশ। হাঁটতে পারে না ভালোভাবে। দুটো দামী ইঞ্জেকশন আর তিন সপ্তাহ ফিজিওথেরাপির পর আজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেছে!
মায়েদের মুখে জয়ের হাসি!
***
আমি তাদের সবার শক্ত চোয়াল দেখেছি। জয়ের অদম্য স্পৃহা দেখেছি। তাদের সবাইকে মনে মনে বলেছি.. “অরিন্দম.. এর মানে তুই উন্নতি করবি..”
জীবনের সেটে কেউ সামনে টেবিল সাজিয়ে রাখে না। চাপড়ানোরও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু বহুদূর দিগন্ত ছাপিয়ে পাথর কাটার আওয়াজ আসে.. ঠং! খুন্তি ধরার আওয়াজ আসে.. ঘষ! সুখতলা ক্ষয়ে যাওয়া জুতোর আওয়াজ আসে.. চট! কলম পেষার আওয়াজ আসে.. খস!
তারপর তাদের ফোকলা-আধো-পাকা-মিহি সমবেত কন্ঠস্বর গর্জে ওঠে..
“আলবাৎ করবো। আই’ল গো টু দ্য টপ! দ্য টপ! দ্য টপ!”