জর্জ ওয়াশিংটন। আমেরিকার স্বাধীনতা-যুদ্ধের বীর। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা পেটানো শরীর। সাতষট্টি বছর বয়সেও তাঁর স্বাস্থ্য খুব ভাল ছিল। ছোটবেলায় গুটিবসন্ত হয়েছিল, কাবু করতে পারেনি। পরে প্রথমে যক্ষ্ণা ও তারপর ম্যালেরিয়া—সামলে নিয়েছিলেন দিব্যি। প্রবাদপ্রতিম জেনারেল—এক যুদ্ধে চারটে গুলি তাঁর শরীরে ঢুকেছিল, আর তাঁকে পিঠে নেওয়া চার-চারটে ঘোড়া একই যুদ্ধে মরে গিয়েছিল, ওয়াশিংটন কিন্তু দিব্যি বেঁচে ছিলেন। অথচ সামান্য ইনফ্লুয়েঞ্জায় মাত্র দুদিনের মধ্যে তাঁর মৃত্যু হল।
১৭৯৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর সকালে ওয়াশিংটনের সামান্য জ্বর আসে। প্রথমে তিনি ওষুধ খেতে চাননি, কিন্তু রাতে কষ্ট বাড়ল, ভোররাতে শ্বাসকষ্ট। ওয়াশিংটনের বাড়ির ম্যানেজার সাধ্যমতো চিকিৎসা করলেন। চিকিৎসা বলতে রক্তমোক্ষণ, বা শিরা কেটে রক্ত বের করা। সে সময়ে প্রায় সব রোগে খুব চালু চিকিৎসা ছিল এটা। সেদিন ভোরবেলা ওয়াশিংটনের আধ-লিটার রক্ত বের করা হল। পরদিন সকালে তিনজন নামী ডাক্তার তাঁর বাড়িতে সেখানে এসে পৌঁছলেন। আবার আধ-লিটার রক্ত বের করে দেওয়া হল, এবং বেলা ১১ টা নাগাদ ফের আধ-লিটার রক্ত! তাতে রোগের উপসর্গ খানিক কমল, কিন্তু রোগী নেতিয়ে গেলেন। বিকেলের দিকে ডাক্তারবাবুরা শিরা কেটে এক-লিটার রক্ত বের করে দিলেন। বেশ ভালো ফল হলো, ওয়াশিংটন আরাম পেলেন, একবার ঊঠেও বসলেন, কিন্তু তারপর খুব দুর্বল হয়ে শুয়ে পড়লেন। সন্ধ্যেবেলায় অবস্থা আরও খারাপ, ডাক্তারেরা আরও কিছু রক্ত বের করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু শরীর থেকে রক্ত আর বেরোতে চাইছে না। রাত হল। ডাক্তারদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও সবার সামনে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন শান্তভাবে মৃত্যুকে মেনে নিলেন।
আজ ক্লাস টেনের ছাত্রও জানে, শরীরে মোটামুটি ৫ লিটার রক্ত থাকে। ডাক্তারেরা আড়াই লিটার, মানে আর্ধেক রক্তই বের করে নিয়েছেন দেড়-দুদিনের মধ্যে। সুতরাং ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়, স্রেফ রক্তপাতের জন্যই রোগী দুর্বল হবেন, মারা যাবার সম্ভাবনা বাড়বে।
কিন্তু সেদিন পৃথিবীর তাবড় ডাক্তারেরা সেটা জানতেন না। বা বলা ভাল, পাশ্চাত্য চিকিৎসা, আজ যাকে ‘অ্যালোপ্যথি’ এই ভুল নামে ডাকা হয়, তাতে ঐ মেরে ফেলার কাজটিই চিকিৎসা বলে ভাবা হত। কিন্তু পাশ্চাত্যে প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছিল। ডাক্তারেরা কি রোগীকে বাঁচাচ্ছেন, নাকি তাঁদের মৃত্যু ডেকে আনছেন?
সেদিন চিকিৎসার পদ্ধতিগুলি খতিয়ে দেখার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ব্যক্তি-চিকিৎসকের ধারনা ও অভিজ্ঞতা, আর বিখ্যাত চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা-লব্ধ জ্ঞানের সঞ্চয় কিছু পুস্তক, এ থেকেই চিকিৎসার ওষুধ ও পদ্ধতি স্থির হত। সমস্ত চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি তখনও আসেনি। তাই যখন ওয়াশিংটন রক্তমোক্ষণ চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, সেই ১৭৯৯ সালেই আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়ার আদালত রক্তমোক্ষণের পক্ষে রায় দিচ্ছেন।
পেনসিলভ্যানিয়ার আদালতে একটি জমজমাট কেস চলছিল। ডাক্তার বেঞ্জামিন রাশ বনাম সাংবাদিক উইলিয়াম কবেট। বেঞ্জামিন রাশ ছিলেন সে সময় আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার, আমেরিকার বিজ্ঞানজগতের উচ্চতম সোপানের মানুষ, ‘পেনসিলভ্যানিয়ার হিপোক্রেটাস’। আবার বেঞ্জামিন রাশ আমেরিকার রাজনৈতিক জগতে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন—ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেস এর অন্যতম স্বাক্ষরকারী।
এহেন ডাক্তার বেঞ্জামিন রাশ রক্তমোক্ষণ-চিকিৎসায় খুব ভালো ফল পেতেন। আমেরিকায় রক্তমোক্ষণ চিকিৎসা যে এত চালু হয়েছিল, তার পেছনে ডাক্তার রাশের প্রভাব খুবই কাজ করেছিল। এনার সঙ্গে টক্কর দিতে গেলেন উইলিয়াম কবেট নামক এক নেহাত চুনোপুঁটি, এক অখ্যাত সাংবাদিক। সে সময় মেডিক্যাল সাংবাদিকতা কথাটা চালু হয় নি, কিন্তু উইলিয়াম কবেট সেটাই করার চেষ্টা করতেন। তিনি নানা রোগীর মৃত্যু নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে দেখলেন, ডা. রাশ আর তাঁর সহযোগীরা রক্তমোক্ষণের সাহায্যে চিকিৎসা করলে রোগী বেশি মারা যাচ্ছে। কবেটের সাহসের অভাব ছিল না, ১৭৯৭ সালে তিনি লিখলেন, ডা. রাশের পদ্ধতি ‘পৃথিবীর জনসংখ্যা কমাতে সাহায্য করছে’। এহেন ব্যাঙ্গে ডা. রাশ রেগে আগুন হয়ে কবেটের নামে মানহানির মামলা ঠুকলেন। দু’বছর পরে ১৭৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে পেনসিলভ্যানিয়া আদালতে মামলার রায় বেরোল। ঠিক তখনই জর্জ ওয়াশিংটন ডাক্তারের হাতে রক্তমোক্ষণের ফলে মারা যাচ্ছেন। আদালত রায় দিল, রক্তমোক্ষণ সঠিক চিকিৎসা। সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে ডা. রাশ রোগীর ক্ষতি করছেন–-একথা বলে শ্রীযুক্ত কবেট ডাক্তার রাশের মানহানি করেছেন। কবেটকে মোটা টাকা জরিমানা দিতে হল।
তাহলে কি আদালতের ভুল? না, কথাটা তাও নয়। আদালতের বিচারক তো সর্বজ্ঞ নন, চিকিৎসার কোন্ পদ্ধতি ঠিক আর কোনটা বেঠিক, সেটা বিচার করতে আদালতকে চিকিৎসকদের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। তখন চিকিৎসকদের সবার জ্ঞান যেটুকু ছিল আদালত ততটুকুই বুঝেছিল। কোনও চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিক না ভুল সেটা বলার জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রের নিজস্ব বিচারপদ্ধতি তখন ভুল ছিল।
কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের বিচারপদ্ধতি তখন ভুল ছিল, এটাও বোধ করি ঠিক বলা হল না। আসলে ওয়াশিংটনের মৃত্যুর ৫২ বছর আগে চিকিৎসাশাস্ত্রের সঠিক বিচারপদ্ধতি কেমন হওয়া উচিৎ তার মূলসূত্র আবিষ্কার করে বসেছিলেন ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর এক নেহাত সাধারণ ছোকরা ডাক্তার। তার নাম জেমস লিন্ড। কিন্তু সে কথা তখনও কেউ জানেই না।
পরে কোনো একদিন আসা যাবে এই জেমস লিন্ডের গল্পে।
চিত্র পরিচিতি
১। জর্জ ওয়াশিংটন
২। ডা. বেঞ্জামিন রাশ
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
ভারতের যুক্তিবাদী সমিতি
তথ্যসূত্র
- Trick or Treatment: Alternative Medicine on Trial. Simon Singh & Edzard Ernst. Corgi Books, 2009.
- Snake Oil Science: The Truth About Complementary and Alternative Medicine. R. Barker Bausell. Oxford University Press; 2009
জানছ। ?
অনেক কিছু জানছি। ?