নিয়মিত শরীরচর্চা করা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই জরুরী। প্রতিদিন কমপক্ষে একটানা ত্রিশ মিনিট জোরে জোরে হাঁটা প্রয়োজন। এবং সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন এভাবে হাঁটা প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে দৈনন্দিন কাজ ছাড়াও অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটা প্রয়োজন।
ব্যায়াম জিনিসটা বেশ কষ্টকর। ফলে কিছু ডায়াবেটিস রোগীর মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন আমি নিয়মিত সময় নষ্ট করে ব্যায়াম করব বা হাঁটব। তার চেয়ে ওষুধের মাত্রা সামান্য বাড়িয়ে দিলেই তো দিব্যি রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। একটা অতিরিক্ত ট্যাবলেট চট করে গিলে ফেলা নিয়মিত ব্যায়াম করার চাইতে অনেক বেশি সুবিধাজনক।
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা ছাড়াও নিয়মিত ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস রোগীদের আরও অনেক উপকার হয়।
ডায়াবেটিসে ব্যায়ামে যেসব উপকার হয়ঃ
- ব্যায়ামে শক্তি খরচ হয়, ফলে শরীরের ওজন কম থাকে ও শরীরে চর্বি কমে।
- ব্যায়ামের মাধ্যমে প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল থেকে ইনসুলিন তৈরি বৃদ্ধি পায়।
- ব্যায়াম ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। ফলে শরীরে অল্প যা ইনসুলিন তৈরি হয়, তাতেই রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে।
- ব্যায়ামের ফলে শরীরের রক্ত সঞ্চালন বাড়ে।
- ব্যায়াম রক্তের ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায় এবং খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমায়।
- ব্যায়াম উচ্চ রক্তচাপ কমায়।
- ব্যায়াম দুশ্চিন্তা দূর করে মনকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখে।
- ঘুম ভালো হয়।
- হাড় ও হৃৎপিণ্ডকে শক্তিশালী করে।
- অস্থি সন্ধিগুলি সচল রাখে।
- বৃদ্ধ বয়সে হাড়ভাঙার একটা প্রধান কারণ অস্টিওপোরসিস বা হাড় ক্ষয়ে যাওয়া। ব্যায়াম হাড়ক্ষয়ের পরিমাণ কমায়।
- ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- যাঁরা নিয়মিত ব্যায়াম করেন, তাঁদের একই বয়সের লোকদের থেকে কম বয়স্ক দেখায়।
- নিয়মিত ব্যায়াম যৌনক্ষমতা অটুট রাখে।
- ব্যায়াম ডায়াবেটিস রোগ প্রতিরোধে উপকারী। নিয়মিত ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিসের আশঙ্কা কমে যায়।
বিভিন্ন রকমের ব্যায়ামঃ
১। অ্যারোবিক ব্যায়াম
২। স্ট্রেংথেনিং ব্যায়াম
৩। স্ট্রেচিং ব্যায়াম
৪। ব্যালান্সিং ব্যায়াম
অ্যারোবিক ব্যায়াম
হাঁটা, দৌড়ানো, জগিং, বাইসাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা ইত্যাদি। এই ব্যায়ামে শরীরের অনেকগুলো মাংসপেশি অনেকক্ষণ ধরে কাজ করে, ফলে শক্তি ক্ষয় হয়। এই ব্যায়ামে নাড়ির গতি, শ্বাসপ্রশ্বাস বাড়ে। ডায়াবেটিসে এই ধরণের ব্যায়াম সবচেয়ে উপযোগী।
স্ট্রেংথেনিং ব্যায়াম
মাংসপেশির শক্তি বাড়ানোর জন্য এই ধরনের ব্যায়াম। যেমন, ওজন তোলা বা স্প্রিং টানা ইত্যাদি।
স্ট্রেচিং ব্যায়াম
মাংসপেশি এবং অস্থি সন্ধির জড়তা কাটিয়ে সচল করাই হলো এই ব্যায়ামের উদ্দেশ্য। অ্যারোবিক ব্যায়াম শুরু করার আগে স্ট্রেচিং করা উচিত।
ব্যালান্সিং ব্যায়াম
ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এই ব্যায়াম। যেমনঃ এক পায়ের ওপর দাঁড়ানো। এই ব্যায়াম চলাচল করতে সাহায্য করে এবং পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া থেকে রক্ষা করে।
ব্যায়াম করার সময় কিছু বিষয় লক্ষ্য করা উচিৎঃ
জোরে জোরে হাঁটা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ব্যায়াম। তবে কিছু জিনিস মাথায় রাখা ভালো।
- যেমন হাঁটুতে যদি অস্টিওয়ারথ্রাইটিস (এই বয়সে সাধারণত থাকে) থাকে, বা নার্ভের ক্ষতির কারণে পায়ে অনুভূতি কম থাকে তখন হাঁটলে হাটুর ব্যথা বাড়তে পারে বা পায়ে ফোসকা পড়ে ঘা হতে পারে।
- হাঁটার সময় মাপসই আরামদায়ক জুতো এবং সুতির মোজা ব্যবহার করবেন। হাঁটার পর সব সময় পা পরীক্ষা করে দেখবেন। যখনই পায়ে ফোসকা, কাটা, ব্যথা বা পা লাল হওয়া দেখবেন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।
- খাওয়ার পরপরই ব্যায়াম করবেন না।
- আমাদের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তাপমাত্রাও মাথায় রাখতে হবে। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে ব্যায়াম করবেন না, কারণ অতিরিক্ত তাপমাত্রাতে শরীর থেকে জল বেরিয়ে জলশূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাই ভোরে বা সন্ধ্যায় ব্যায়াম করা উচিৎ।
- অতিরিক্ত ব্যায়ামের ফলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। বিশেষত যারা ইনসুলিন নেন। তাই অনেকক্ষণ খালি পেটে থেকেও ব্যায়াম করা উচিৎ নয়। হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলি হলো মাথা ঘোরা, নাড়ির গতি বেড়ে যাওয়া, ক্ষুধা লাগা, দুর্বল লাগা বা ক্লান্তি অনুভব করা, ঘাম হওয়া, মাথা ধরা ইত্যাদি। রক্তের গ্লুকোজ খুব বেশি কমে গেলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
সপ্তাহে কতদিন ও কতক্ষণ ব্যায়াম করবেন?
সপ্তাহের অধিকাংশ দিন (কমপক্ষে পাঁচদিন) এবং দিনে ৩০ মিনিট অ্যারোবিক ব্যায়াম অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনে। একনাগাড়ে ৩০ মিনিট ব্যায়াম না করতে পারলে ১০ মিনিট করে দিনে তিনবার ব্যায়াম করলেও হবে। প্রতিদিন তিনবার খাওয়ার আগে ১০ মিনিট করে ব্যায়াম করা যেতে পারে।
একথা মনে রাখতে হবে একদিন বা দুদিন ব্যায়াম করে বিশেষ সুফল পাওয়া যাবে না। দীর্ঘদীন ধরে নিয়মিত ব্যায়াম করলেই তবেই এর সুফল পাওয়া যাবে।