কিছুক্ষণ আগে একটা ফোন কল এল। কলার আইডিতে অচেনা নাম্বার। কিন্তু ফোন রিসিভ করতেই ওপার থেকে যে কন্ঠস্বরটা শুনলাম সেটা খুব চেনা।
-‘ডাক্তারবাবু আমাকে চিনতে পারছেন? আমি উমা দত্তের হাজব্যান্ড কথা বলছি।’
– উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ শঙ্করবাবু বলুন, আপনাকে চিনতে পারব না!’
কথাবার্তা শুরু হতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রায় নব্বই বছর বয়স্ক একজন ছোটখাটো চেহারার ভদ্রলোক। মাথায় ধবধবে সাদা চুল। জামার হাতা গোটানো। শরীর এতটুকু নুইয়ে পড়ে নি, এককালে শরীরচর্চা করতেন দেখেই বোঝা যায়। প্রথম আলাপ যখন ওনার স্ত্রীকে দেখাতে নিয়ে আসেন আমার কাছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য প্রায় বছর দশ-বারো। ওনাদের সময়ের রেওয়াজ মাফিক।
নিজের শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে জেনেও ছিয়াত্তুরে দিদিমার মধ্যে একটুও ভয় দেখিনি। নব্বইয়ের দরজায় কড়া নাড়া দাদুর হার্টের অপারেশন হয়ে গেছে আগেই, সিঁড়ি ভাঙতে হাঁফিয়ে ওঠেন। কিন্তু একটা জিনিসের লেশমাত্র নেই, সেটা হল ভয়। আর একটা জিনিসের কোন খামতিও নেই, সেটা হল ভালোবাসা।
এরপর চিকিৎসা শুরু হল। যখনই স্ত্রী ভর্তি হতেন শঙ্করবাবু এসে সারাদিন বসে থাকতেন। ওনার ছেলে বৌমারাও আসতেন কথা বলতেন। কিন্তু স্ত্রীর যাবতীয় চিকিৎসার দায়দায়িত্ব ওনাকেই পালন করতে দেখেছি বরাবর। কখনো বিরক্ত করতেন না, কখনো বিরক্ত হতেনও না। আস্তে আস্তে আমার রোগিণীর সাথে বন্ধুত্ব হল। পেশেন্ট থেকে হলেন দিদা। অপেক্ষা করে থাকতেন, কখন আসব আর উনি গল্পের ঝুলি খুলে বসবেন। কত গল্প, কত বিষয়ে তার কত জ্ঞান। শঙ্কর-উমা জুটি নিয়ে মাঝে মাঝে আমিও চিমটি কাটতাম। তখন নিজেদের ভালোবাসার গল্প বলতেন নিঃসংকোচে নির্দ্বিধায়। পুজোর পরে নাড়ু বানিয়ে নিয়ে এসেছিলেন একবার। হাতে দিয়ে চুপিচুপি বললেন, ‘এটা তোমার আর বউমার, অন্যদের দেবে না। ওদেরকে দিয়েছি আলাদা করে।’ আবার সাথে লজেন্স রাখতেন, তার থেকেও জুটত একটা দুটো রাউন্ডে গেলে।
একবার কলার আইডিতে দেখলাম ওনার নাম ফুটে উঠল, ‘মৈত্রেয়ী দিদা’। পরের দিন গিয়ে বললাম, ‘কি ব্যাপার মৈত্রেয়ী দিদা কি করছ?’ প্রথমে একপ্রস্থ জেরা চলল, আমি কি করে জানলাম তাই নিয়ে। তারপর আবার সেই পুরোনো দিনের গল্প, ‘বুঝলে আমার বাপের বাড়ির নাম মৈত্রেয়ী। কত সুন্দর আর আধুনিক নাম বলো। বিয়ের পরেও সবাই মৈত্রেয়ী বলত। তারপর তোমার দাদুর সাথে নাম মিলিয়ে নামটা বদলে করলাম উমা। আমাদের তো কম বয়সে বিয়ে তাই ঐ নাম।’ ভালোবাসার গভীরতা সেদিন আবার একবার টের পেলাম।
ক্যান্সারের লম্বা চিকিৎসায় বেশ কিছু চড়াই উতরাই থাকে। কিন্তু ওদের মধ্যে কোনদিন কোন ধৈর্য্যের অভাব দেখিনি। বরং ছিল একটা নীরব অনুরোধ, ‘আমাদের দুজনের বন্ধু আমরা দুজন, যেন বন্ধুকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি’। সেই নীরব অনুরোধে কাজ হত খুব বেশী, নিজেরই দুশ্চিন্তা হত, চেষ্টা করতাম তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলার। বন্ধুকে বন্ধুর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার।
এরপর একদিন সুখবর দেওয়ার পালা এল। রিপোর্ট বলছে ক্যান্সার নিরাময় হয়েছে। আমার সাথেও উমা-শঙ্করের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যেত, যদি না ওনাকে অন্য নানা শারীরিক সমস্যায় বারবার হাসপাতালে ভর্তি না হতে হত। আর সব সময়ই দেখতাম শঙ্করবাবু হাসপাতালের কোথাও না কোথাও বসে আছেন। ভদ্রলোক বোধহয় এয়ার ফোর্সে চাকরি করতেন, তাই দেখা হলেই কপালে হাত দিয়ে স্যালুট করতেন। অস্বস্তি হত, বারন করেছি বহুবার, শোনেন নি। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সপ্তাহের যেকোন দিন সকাল হোক বা সন্ধ্যা, নব্বইয়ের যুবকের ভালোবাসা মাঝে মাঝে ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠত।
শেষ দেখা হল এই কোভিড প্যান্ডেমিকের মধ্যেই। অন্য রোগীকে দেখতে গিয়ে। যখন সারা পৃথিবী করোনার ভয়ে থরথরিকম্প। কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। হাসপাতালে ডাক্তার নার্সরা মুখে মাস্ক বা পিপিই পরে ঘুরছেন। ঠিক সেই সময় ভয়ডরহীন শঙ্করবাবু স্ত্রীর কেবিনের বাইরে একটা টুলে বসে আছেন। দেখা হতেই একটা স্যালুট ঠুকে বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব, একবার আমার স্ত্রীকে দেখে যাবেন’। আমি একরকম বকে ওনাকে নীচে পাঠালাম। একগাদা জ্বরের রোগীর মধ্যে ওনার শারীরিক সুরক্ষা বিষয়ে চিন্তা হচ্ছিল।
একটু আগে শঙ্করবাবুর ফোনটা পেলাম, ‘আপনার রোগী উমা দত্ত কাল রাত দশটায় ইহলোক ত্যাগ করেছেন। আপনাকে আমরা খুব ভালবাসতাম তাই খবরটা দিলাম। প্রার্থনা করুন উনি যেখানে গেছেন সেখানে যেন ভালো থাকেন।’
ওনাকে নিজের শরীরের খেয়াল রাখতে বলায় বললেন, ‘বুঝলেন তো ষাট বছরের ওপরে একসাথে থাকা, এতবছরের দাম্পত্য, এত বছরের বন্ধুত্ব। তবে চেষ্টা করব নিজের খেয়াল রাখতে’।
অদ্ভুত শান্ত মার্জিত অবিচল স্বরে যে শোকবার্তা দিলেন তার প্রত্যুত্তরে কি সান্ত্বনা দেব মাথায় আসছিল না। কিন্তু জীবনের সায়াহ্নে এসে সারাজীবনের সবচেয়ে কাছের সবচেয়ে ভরসার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বিচ্ছেদের কষ্টটা কোথাও যেন ফোনের ঈথার তরঙ্গ ওপাশ থেকে এপাশে পৌঁছে দিচ্ছিল।
আমরা ভালোবাসার কত রকম সংজ্ঞা দিই। নানা বয়সে, নানা আঙ্গিকে। কখনো সেটা ভ্যালেন্টাইনস-ডে, কখনো বসন্তোৎসব। কখনো কোচিং কখনো কলেজের অডিটোরিয়াম। কখনো বেড়াতে গিয়ে আনন্দে, আবার কখনো শ্মশানে জ্বলন্ত চিতার সামনে কাঁধে মাথা রেখে। কিন্তু ভালোবাসা সবচেয়ে বেশী করে মানুষ বোধহয় বুঝতে পারে যখন জীবনের অনেক কটা বছর কেটে যায়। আস্তে আস্তে আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব সবাই সরে যায়। আর পড়ে থাকে শুধু একজন মানুষের জন্য আরেক জন মানুষ। সুখে- দুঃখে, আনন্দে-শোকে, ঠাট্টায়-ঝগড়ায়, সুস্থ চায়ের পেয়ালায় অথবা অসুস্থতায় হাসপাতালের বেডের পাশে।
সেই ভালোবাসা, একজন চলে যাওয়ার পরেও তার সুস্থতা কামনা করে। আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যায় ভালোবাসার সংজ্ঞা, আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যায় বন্ধুত্বের প্রকৃত অর্থ।
ভালো থেকো মৈত্রেয়ী দিদা। ভালো থাকবেন শঙ্করবাবু। অটুট থাকুক আপনাদের বন্ধুত্ব।
(নাম পরিবর্তিত)
অনুভূতি।
ভালবাসা আমাকে স্তব্ধ করে । এখনও ।