ইতিহাস কি কথা বলে?
হ্যাঁ, বলে। শুধু কথা বলে না, কখনো-সখনো সে মায়াবিনী কূহকের মত আমাদের টেনে নিয়ে যায়, আমরা সব ভুলে তার মায়ায় কোন এক মোহে এবং রোমাঞ্চের উত্তেজনায় তার ফেলে আসা সরণি বেয়ে চলতে থাকি। এক মোহাবিষ্টের মত পেরিয়ে যাই শতক-সহস্র- নিযুত-লক্ষ কোটির সীমানা । চলতে থাকি সৃষ্টির সেই প্রথম সময়ের দিকে।
এও এক ভ্রমণ। কালের ফেলে আসা পথে ভ্রমণ। আর এই ভ্রমণ করতে গিয়ে দেখতে পাই সেই সময়কার সমাজ, নতুন অচেনা সব মানুষজন। যারা আমাদের পুর্বপুরুষ ছিল- তাদের ছোঁয়া পাই। দেখি তাদের জীবন-চর্চা, ঘর-কন্না, ঢুকে পড়ি তাদের হেঁসেলে- তাদের গুহায়। যেখানে তারা নিজেদের অজান্তেই ফেলে রেখে গেছে তাদের ব্যবহার্য্য জিনিস-পত্র, থালা-বাসন, আসবাব। ঢুকে পড়ি তাদের ঘরে- এও এক অন্য অনুভূতি। হাজার হাজার বছর আগে হয়তো আমারই কোন পূর্বপুরুষের ছোঁয়া লেগে আছে যার সর্বত্র।
বর্তমান সময়ে এই ২০২০ সালে আমি এখন গৃহ-বন্দী। চারিদিকে যানবাহন নেই, ট্রেন চলছে না, দোকান-বাজার বন্ধ- যেন সারা পৃথিবীর লোকেরাই আতঙ্কিত মুখে অসহায় ভাবে এক অবধ্য শত্রুর ভয়ে কুঁকড়ে গেছে। কেউ বাইরে বেরোচ্ছে না, বেরোচ্ছে তো মুখে মুখোস পরে সর্বাঙ্গ ঢেকে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে । এ আমরা কোথায় এলাম? ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এক মানব-নিধন যজ্ঞ। শুরু হয়েছে করোনা মহামারী। কিন্তু এর আগে কবে মহামারী হয়েছিল? তার কোন প্রমাণ আছে? এ সব জানার আগ্রহ বাড়ে- আর তাই আমরা ঢুকে পড়ি সেই আতীতের সময় সরনীতে।
ইতিহাসের এই সব নিদর্শন যে কোথায়, কোন গভীরে লুকিয়ে আছে আমরা তা জানি না। হঠাৎ কখনো অন্য কোন কাজ করতে গিয়ে আমরা তার হদিস পেয়ে যাই। তারপর তার পথ ধরে এগিয়ে গিয়ে আমরা দেখা পাই সেই হাজার হাজার বছরের পুরানো জীবনের। আর এ ভাবেই আমরা একদিন দেখা পেয়ে যাই হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর ঠিকানা। সেখানকার মানুষের ঘর-বাড়ী, তাদের থালা-বাসন আমাদের জানিয়ে দেয় তারা কেমন ভাবে থাকতো, কি করতো, কি ভাবে জীবন কাটাতো।
এই পুরানোর খোঁজ আসলে হয়তো আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের খোঁজ। সারা পৃথিবী জুড়ে কখনো অনুমানের ভিত্তিতে, কখনো হঠাৎ করে পাওয়া এক দু’টি পুরাতাত্বিক নিদর্শন আবিস্কারের পরে গুপ্তধন আবিষ্কারের মতো চলছে ইতিহাসকে জানার অনুসন্ধান। চলছে খোঁড়াখুড়ি। মাটির আস্তরন সরিয়ে দেখা মিলছে মণি-মাণিক্যের। কখনো আফ্রিকায়, কখনো ইউরোপে, কখনো ভারতবর্ষে, কখনো চীনে।
পৃথিবীতে প্রাণীর আবির্ভাব প্রায় ৭০ কোটি বছর আগে। সেই থেকে চলছে যুদ্ধ। এক জীবের সাথে আরেক জীবের, চলছে টিঁকে থাকার লড়াই। যে যতোটা পারে পৃথিবীতে তার আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে। দরকারে অন্য প্রজাতিকে মেরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে – এও সেই struggle for existence.
আমাদের পূর্ব-পুরুষেরাও তেমনি তাদের বুদ্ধি এবং কৌশলে অনেক প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। আর এই মানব জাতিও বার বার অন্য প্রজাতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। কখনো তারা লাখে-লাখে মৃত্যূ বরণ করেছে, আবার কখনো কখনো লড়তে লড়তে টিঁকে গেছে। কিন্তু আক্রান্ত হয়েছে বার বার। বার বার নেমে এসেছে মড়ক, মহামারী। কখনো একটা দেশ জুড়ে, কখনো সারা বিশ্ব জুড়ে। মনুষ্য প্রজাতি বার বার এই মহামারীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে।
এই মহামারীর হদিস পেতে সময়ের সরণি বেয়ে চলুন আরেকবার পিছনে যাই। দেখে আসি সেখানে কোন চিহ্ন পাওয়া যায় কি না, মহামারীর কোন নিদর্শন দেখা যায় কি না!
প্রত্নতত্তবিদরাও এক ধরনের গোয়েন্দা। তারা দু’একটি কুড়িয়ে পাওয়া নিদর্শন দেখে তৈরি করে নেয় একটি সম্পূর্ণ ঘটনা, একটি সম্পূর্ণ ইতিহাস। সময় মাপার দাড়িপাল্লা কার্বন ডেটিং মেপে বলে দেয় এই ঘটনা কোন সময়কার – ঐ সময়ে কি ঘটেছিল সেখানে।
এমনি করেই একদিন পাওয়া গেল পৃথিবীর প্রথম মহামারীর নিদর্শন। না, কথাটা ঠিক নয় হয়তো, কারণ তার আগে নিশ্চয়ই আর মহামারী এসেছে, তবুও এর আগের আর কোন মহামারীর নিদর্শন এখনো পাওয়া যায়নি। এখনো পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের হিসাবে সেটাই হয়তো ছিল পৃথিবীর প্রথম মহামারী। এ যে সময়কার কথা, তখনো কোন লিপিও উদ্ভব হয়নি, তাই এর কোন লিখিত ইতিহাস নেই- যা পাওয়া গেছে তার উপর ভিত্তি করেই এই অনুমান।
এও সেই চীনে। আজ যে করোনা মহামারীর ভয়ে সারা পৃথিবী আতঙ্কিত সেই করোনার উৎপত্তিও চীনে।
চীনের উত্তর-পূর্বে “ইনার মঙ্গোলিয়া” প্রদেশে প্রথমে পাওয়া যায় নিওলিথিক যুগের কিছু বাসন-পত্র, এবং হাতিয়ার। যার থেকে মনে করা হয়, এখানে ছিল আগের কোন সভ্যতা।
তারপরে চীনের জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২০১১ সালে শুরু হয় অনুসন্ধান। শিবোটু শহরের কাছে হামিনমাংঘা (HaminMangha) নামন স্থানকে বেছে নিয়ে শুরু হয় খনন কার্য্য। ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্য্যন্ত খনন কার্য্য এবং অনুসন্ধান চলে। এখানেই পাওয়া যায় সাজিয়ে রাখা ইতিহাসকে।
হামিনমাংঘাকে মনে করা হয় একটি বিস্তীর্ণ সভ্যতার কেন্দ্র বিন্দু। সেই কন্দ্রের প্রায় ৩০০০০ বর্গ ফুট এলাকা জুড়ে খনন কার্য্য চালানো হয়। সেখানে পাওয়া যায় প্রায় ১০০ রকমের বাসন-পত্র, পাথরের হাতিয়ার, জীবজন্তুর সিং, তীর ও তীরের ফলা এবং বর্ম।
তখন সভ্যতার শুরু। মানুষ তখন ছোট ছোট দল বেঁধে থাকতো। তারা ফসল ফলাতো, শিকার করতো। তাদের জীবন ধারাও যথেষ্ট উন্নত ছিল। হামিনমাংঘার নিদর্শন দেখে সহজেই তা অনুমান করা যায়।
কি পাওয়া গেল হামিনমাংঘাতে? পাওয়া গেল আস্ত একটি গ্রাম -পাশাপাশি তৈরি ২৯টি বাড়ি। আর তার আশে পাশে পাওয়া গেল ১০টি ছাইগাদা, ৩টি সমাধি, এবং গ্রামের চারপাশে পরিখা। বাড়ীগুলির সবচেয়ে ছোটটি ৭২ বর্গ-ফুটের এক কামরার আর বড়টি তার পাঁচ গুন, সেখানে অনেক কামরা। প্রতিটি বাড়ির একটি ঢোকার দরজা ছিল, বিশেষ শৈলীতে তৈরি কাঠের চালাও ছিল। বাড়ির মধ্যে ছিল রান্নার জন্য আগুনের ব্যবস্থা।
কিন্তু একটি বাড়িতে খনন কার্য্য চালিয়ে সবাই চমকে গেল। F40 নামের সেই বাড়ির মধ্যে পাওয়া গেল ৯৭টি মানুষের কঙ্কাল। ওই অল্প জায়গার মধ্যে ৯৭টি এলোমেলো ছড়ানো কঙ্কাল! শুধু তাই নয়, কোন কোন কঙ্কালের শরীর আধপোড়া। কোথাও পাওয়া গেল আধপোড়া বাড়ির চালার অংশ।
বিজ্ঞানীরা ধাঁধায় পড়লেন, কি হতে পারে? এটা কি কোন বলি-প্রথার মতো সামাজিক কুসংস্কার? না কি অন্য কিছু?
তার কঙ্কালগুলোকে আগে পরীক্ষা করলেন। দেখলেন কঙ্কালগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে রাখা। কোথাও একটার উপরে একটা পাঁজা করে রাখা হয়েছে। কোন কোন কঙ্কাল আস্ত আবার কোথাও শুধু কঙ্কালের মাথা, কোথাও শুধু বাকী অংশ। এবং তাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৫, গড় বয়স ২৭। এর মধ্যে কোন কোন কঙ্কালের হাড় আংশিক পোড়া। উপত থেকে ঘরের চালার পোড়া কাঠ পড়ে কারো কারো হাত-পা আংশিক ভেঙ্গে গেছে।
এটা নিশ্চিত হওয়া গেল, এতগুলো লোক একসাথে ছিল এবং ঘরে আগুন লেগেছিল। আগুন এমনি লেগেছিল, না মৃত মানুষকে রেখে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল?
এলোমেলো আবিন্যস্ত কঙ্কাল দেখে মনে হয় ছূড়ে ফেলা হয়েছিল দেহগুলো।
পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষন করে জিলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই সিদ্বান্তে আসেন, তখন কোন মড়ক লেগেছিল। মহামারী হয়েছিল।
গ্রামের মাত্র ২৯টি বাড়িতে কতোজন লোক থাকতে পারে? তার মধ্যে ৯৭ জনের দেহ এখানে থাকলে আর ক’জন বাকী থাকে?
আর এখানে যাদের পাওয়া গেল, তারা মাঝ বয়সী। বাকী বয়স্করা কোথায় গেল?
গবেষকরা এই সিদ্বান্তে আসেন, মহামারীর মড়কে মৃত বয়স্কদের হয়তো পুড়িয়ে দেওয়া হয়, বা অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে সমাহিত করা হয়।
এমনও হতে পারে, বয়স্করা আগে মারা যায়, তাদের বাকীরা অন্যত্র নিয়ে সমাহিত করার সুযোগ পায়- এবং যখন বেশীর ভাগ লোকই মারা যায়, তখন আর দেহকে দূরে নিয়ে যাবার মতো কোন লোকই অবশিষ্ট ছিলনা। দু’চারজন যারা জীবিত ছিল, তারা মৃতদেহগুলি একটি ঘরের মধ্যে একত্র করে। লোকের অভাবে বা তাড়াহুড়ো করে তাদের একজনের উপরে আরেক জনকে রাখা হয়। এলো-মেলো ভাবে হয়তো ছুঁড়ে ফেলা হয়।
গবেষকরা এটাও ভাবতে থাকেন, মহামারী তো একটি গ্রামে আসবে না- অন্য জায়গায়ও তার প্রমাণ পাওয়া যাওয়া উচিত। চলে অনুসন্ধান। এর পরেই সন্ধান পাওয়া যায় মিয়াওজিগোউ (Miaozigou) এলাকার। এও চীনের ওই উত্তর-পূর্ব এলাকায়, এবং একই সময়কার। সেখানেও মহামারীর নিদর্শন মেলে। এ ছাড়াও ওই এলাকার অন্য দু’একটি জায়গায়ও এই ধরনের প্রমাণ মেলে।
এর পরেই গবেষকরা নিশ্চিত ধারণায় আসেন, আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে এই এলাকায় সত্যিই এক মহামারী নেমে এসেছিল- যার ফলে বেশীর ভাগ লোকেই মারা যায়। প্রথমে বয়স্করা মারা যায়, তাদের অন্য জায়গায় নিয়ে সমাহিত করা হয়। তারপরে যখন মড়ক তীব্র আকার ধারণ করে, তখন অন্যরাও আক্রান্ত হতে থাকে এবং বেশীরভাগই মারা যায়। যারা তখনো পর্যন্ত্ বেঁচে ছিল, তাদের ক্ষমতা ছিল না সবাইকে সমাহিত করার- তাই তারা সমস্ত মৃতদেহ জড় করে একটি ঘরের মধ্যে, এবং তারপর সেই ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তারা স্থান ত্যাগ করে। স্থান ত্যাগ না করলে তাদের মৃতদেহও এখানে-সেখানে পাওয়া যেত। তার পরে তারা আর ফিরে আসেনি। শুধু হামিনমাংঘা নয়, ওই এলাকা জুড়েই তখন মহামারীর মড়ক লেগেছিল।
যখন লিপি ছিলনা, কোন তথ্য লিখে রাখার কোন ব্যবস্থা ছিলনা, তখন থেকেই চলে আসছে মহামারীর তান্ডব। এখনো পর্যন্ত্য পাওয়া প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায়- এটাই পৃথিবীর প্রথম মহামারী।
এখন করোনা মহামারী চলছে। ২০১৯ সালে শুরু হয়েছে চীনের উহান প্রদেশে। তারপর এখন সারা বিশ্ব জুড়ে চলছে তার করাল গ্রাস। সে দখল করে নিয়েছে সারা পৃথিবীকে। আমাদের জীবন-যাত্রা অচল করে দিয়েছে। এ কবে যাবে, কতদিন থাকবে, কত জীবন নেবে আমরা জানি না। কিন্তু এই আতঙ্কের সময়ে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে দেখলে আমরা হামিনমাংঘা এবং তারপরেও এমন অনেক মহামারী দেখতে পাই, যেখানে মানুষ বার বার তার অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন হয়েছে- কিন্তু বারবারই আবার স্ব-মহিমায় ফিরে এসেছে।
এবারও মানুষ করোনা মহামারীকে জয় করবে- শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমরা তাই সেই জয়ের প্রতীক্ষা করছি।
৪.৭.২০
ভালো লেখা।