অনেকদিন হ’ল লেখালেখির পাঠ প্রায় চোকাতে হয়েছে। ডিউটি আর পড়াশোনা মিলিয়ে শুধু ছুটছি আর ছুটছি। এমনিতেও এসব ছাইপাঁশ লিখেটিখে কী হয়, সেটা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। তাই অল্প কিছু সময় ফুরসত পেলেও আর লিখতে ইচ্ছে করে না। কিছুদিন আগেও সময়গুলো কলমে বেঁধে রাখতে চাইতাম। এই যে কালান্তক অতিমারীর দিনেও কোমর বেঁধে এক-একটা দিন বেঁচে নেওয়া- তার প্রতিটি অনুপুঙ্খ বিবরণ রেখে দিতে চাইতাম। বেশ কিছু দশক পরের কোনও অলস বিকেলের জন্য। সময়ের দাবী মেনে সে ইচ্ছেয় এখন ভাটার টান।
সকাল অ্যালার্ম বাজার আগেই প্রায় খান দশেক কুকুরের সম্মিলিত আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। ওরা যদিও আমাদের খুব চেনে। শুধু বাইরের কেউ এলে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বাইরের কেউ আসেনি। তবে কি ওরাও স্বাধীনতা দিবস পালনের উৎসবে মেতেছে? কে জানে…
ঘুম যখন ভেঙেই গেল তখন সকালের আলসেমিটুকুর মায়া না করে উঠে পড়লাম। ইলেকট্রিক কেটলিতে গরম জল চাপিয়ে ব্রাশ মুখে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ব্রাশ করে আসার আগেই জল গরম হয়ে যাবে। তারপর চা-পাতার ওপর গরম জল ঢেলে দিলেই আমার মর্নিং টি রেডি। চিনি বা দুধের বালাই নেই। ছাঁকারও দরকার নেই। পাতাগুলো এমনিতেই নিচে থিতিয়ে যাবে। চা খেতে খেতে আধবোজা চোখ ফটাস করে খুলে যায়। তারপর বাদবাকি প্রাত্যহিক কাজকম্মো সেরে এক ছুট্টে ডিউটিতে। আইসিইউ-র ড্রেসটা গলিয়ে কাজ শুরু করলাম।
শেষ মাস দেড়েক সময়ে সম্ভাব্য কোভিড এমআইএসসি-র প্রায় খান কুড়ি বাচ্চা দেখা হয়ে গেল। অথচ এই একই সময়ে খুব বেশি কোভিড পজিটিভ রোগী পাইনি। যাঁরা কোভিড এমআইএসসি শুনে মাথা চুলকোচ্ছেন তাঁদের জন্য বলি- এটি কোভিড পরবর্তী মারাত্মক প্রদাহজনিত রোগ। যা শরীরের প্রায় সব অঙ্গকেই অকেজো করে দিতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না হ’লে মৃত্যুর সম্ভাবনাও অনেকটাই। খারাপ হয়ে যাওয়া কোভিড পরবর্তী জটিলতার রোগী পাচ্ছি অথচ প্রাথমিক করোনা সংক্রমণ কম দেখছি- প্রথম প্রথম এই ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। এখন বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার। জ্বর হ’লে কেউই আর এখন করোনা টেস্ট করাতে চাইছেন না। আগে টেস্ট করানোর অনেক জটিলতা ছিল। এখন সেটা অনেকটাই সহজ। টেস্ট করাতে বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। আগে আগে টেস্ট না করালে তেড়ে গালাগালি করতাম। এখন নিয়মমাফিক একবার বলে দিই। তারপর টেস্ট না করালে ‘চুলোয় যাক’ মোড অন করে খসখসিয়ে পেন চালাই। যারা কোভিড এমআইএসসি নিয়ে ভর্তি হচ্ছে তাদের সবারই প্রায় কিছুদিন আগে জ্বরের ইতিহাস আচ্ছে। কখনো বাড়িশুদ্ধ সবার জ্বর। তারপরও টেস্ট হয়নি। মিডিয়ার চিৎকার আর ঘন্টায় ঘন্টায় আপডেট মিইয়ে যেতে মাস্ক পরাও লাটে উঠেছে।
ক’দিন রাতে ছোট্টু ঘোষ (নাম পরিবর্তিত) মারা গেল। আট বছরের মোটাসোটা ছেলে। কোভিড এমআইএসসি। ভর্তি হওয়ার দিন পনেরো আগে জ্বর এসেছিল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ যথারীতি স্ক্রিপ্টমাফিক। ভেন্টিলেটরে ছিল। রক্তচাপ সাংঘাতিক ভাবে কমে গেল। নাক-মুখের টিউব দিয়ে গলগলিয়ে পিত্ত আর রক্ত মেশানো তরল উঠে এল। তারপর যেমন যা হয়… প্রফেশনাল দক্ষতা মেনে টেনে…
মৃত্যুসংবাদ শোনার পরেই ছোট্টুর মা অজ্ঞান। বাড়ির অন্য দুজনের অবস্থাও তথৈবচ। এবার বাচ্চা সামলাই না বাড়ির লোককে দেখি? অনেকদিন হ’ল বড়দের চিকিৎসা করি না। আমাদের হাসপাতালে শুধু শিশুদেরই চিকিৎসা হয়। দু-আড়াই কিলোমিটার মতো গেলেই শহরের একটি নামকরা মেডিক্যাল কলেজ পড়বে। বড়দের কিছু অসুবিধে হ’লে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু এই অবস্থায় পাঠাবোই বা কার সাথে? বাড়ির বাকি দুজনও তো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। আট বছরের বাচ্চা! আট বছরের টান! সেসব নিমেষে কাটিয়ে ফেলার অভিঘাত তো বড় সোজা কথা নয়… অগত্যা পুরোনো বিদ্যা অল্পস্বল্প কিছু কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। ততক্ষণে ছোট্টুর মা’র রক্তচাপ ১৬০/৯০। অল্প শ্বাসকষ্টও শুরু হয়েছে। প্রায় ঘন্টাদুয়েক বাদে শারীরিক অবস্থার স্বাভাবিক করা গেল। কিন্তু যদি এর মধ্যেই বাচ্চার মায়েরও খারাপ কিছু হয়ে যেত? তারপর যদি প্রশ্ন উঠতো, কেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ না থাকা সত্ত্বেও আগেই পাঠিয়ে দিই নি? তখন হয়তো মিনমিনিয়ে বলতাম, “আসলে আমার মনে হয়েছিল, ওরা তখন ঠিক নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। তাই, একটু চেষ্টা করে দেখছিলাম।” নির্ঘাৎ উল্টোদিক থেকে উত্তর আসতো, “এত ভাবতে আপনাকে কে বলেছিল? আপনার কাজ পাঠিয়ে দেওয়া। সেটা করেন নি কেন?” সে প্রশ্নের কোনও উত্তর আমার কাছে থাকতো না। আজ ডাক্তাররা একটু খারাপ রোগীকেও হাত দিতে ভয় পান। বেশিরভাগ সময় তার কারণ প্রফেশনাল দক্ষতার অভাব নয়। খাঁড়ার ভয়। অতয়েব মুখ নিচু করে নিক্তিমেপে কাজ করে যেতে হয়। উদ্যত বেয়নেটের সামনে বসে কোনোদিন তুলির আঁচড় দিতে পেরেছেন কেউ? চাবুকের সামনে এসরাজে ঝড় উঠেছে কোনোদিন? দিনের শেষে ডাক্তারিটা তো ঠিক সম্পূর্ণ অঙ্কমাপা বিষয় নয়। তার মধ্যে চিকিৎসকের কল্পনা মিশে থাকে অনেকখানি। ভয়ের অ্যাড্রিনালিন চিকিৎসকের কল্পনা আর কাজের ইচ্ছেগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। তবু বোকা বোকা ঝুঁকি নিয়ে ফেলি। আরও চার ঘন্টা বাদে আইসিইউ থেকে ছোট্ট ঘোষের শক্ত, ঠান্ডা শরীর কাচে ঢাকা গাড়িতে উঠে যায়। কান্নার আওয়াজ বহুদিনই বেশ গা সওয়া হয়ে গেছে। নইলে কবেই এ হাহাকারে ভোরের আকাশ ছিঁড়েখুঁড়ে যাওয়ার কথা।
পুরো সময়টা জুড়ে ছোট্টুর মা’কে সামলে রেখেছিল আর এক বাচ্চার মা। ‘মা’ না বলে তাকেও বাচ্চাই বলা চলে। বয়স সবে সতেরো। তেরো বছর বয়সে বিয়ে। চোদ্দ বছরে বাচ্চার মা। সারাক্ষণ বকবক লেগেই আছে। কথায় কথায় বলেছে, “জানেন স্যার, আমি ত বিয়ে কত্তেই চাই নি। মা দিয়ে দিল আর কী বলব… পথম পথম ত সোসুরবাড়িতে গিয়া বাচ্চাদের সাথে ছুটাছুটি খেলতি… ” সত্যিই তো, তার এখন খেলে-পড়ে দিন কাটানোরই বয়স। তার বদলে সে এখন অসুস্থ সন্তান আগলে বসে আছে। তাও প্রায় মাস দুয়েক হ’তে চললো। মাথার টিবি। গলার কাছে ফুটো করে নল পরানো। মাথায় জল জমেছে।
এরকম অগুনতি অল্পবয়সী মা দেখেছি। স্কুলের ফ্রক ছোটো হওয়ার আগেই যাদের কোনও একদিন ঝুপ করে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয়। তখন আমার ক্লাস এইট। স্কুলে আমাদের সাথে পড়তো মেয়েটা। নাম না হয় নাই বা বললাম। হঠাৎ একদিন শোনা গেল, তার বিয়ে হয়ে গেছে। আর স্কুলে আসবে না। তার বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। আমাদেরই কারোরই আর কোনোদিন যোগাযোগ করা হয়ে ওঠে নি। ভিন্ন আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে আমরা বিভিন্ন দিকে ছিটকে গিয়ে নিজেদের মতো গুছিয়ে নিয়েছি। এসব ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম অল্পবয়সী মেয়েটির বাড়ির লোকেদের নিরঙ্কুশভাবে ভিলেন বানিয়ে ফেলতাম। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখছি পৃথিবীর সাদা-কালোর সহজ সমাধান কখনোই সম্ভব নয়। আরও আরও শিক্ষা আসুক, স্বাস্থ্য আসুক, গলায় শব্দ আসুক। কোনও এক স্বাধীনতা দিবসে ওরা ডানা পাক। এক আকাশ মুক্তি আসুক…