আরজিকর কাণ্ডের পনের দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পর, আমার যেটুকু ব্যক্তিগত উপলব্ধি, তাতে মনে হয়, সেই রাত্রে ঠিক কীভাবে কী ঘটেছিল, তা কখনোই প্রকাশ্যে আসবে না। শুরুর দিনকয়েক কলকাতা পুলিশ যেভাবে সাফল্যের সঙ্গে ‘তদন্ত’ করেছে, তাতে শার্লক হোমস এরকুল পয়রো ব্যোমকেশ বক্সী একযোগে নামলেও সত্য উদঘাটনের সম্ভাবনা কম। জড়িত কেউ স্বীকারোক্তি জাতীয় কিছু দিলে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তেমন সম্ভাবনা তো কিছু দেখছি না।
অতএব, হয়ত ‘প্রমাণ’ হয়ে যাবে, যে, সঞ্জয়-ই একক অপরাধী। তার বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছে, ঘটনাস্থলে পাওয়া স্পেসিমেন-এর সঙ্গে তার ডিএনএ-ও নাকি মিলেছে, অতএব…
প্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়েকে মারধর করে খুন ও ধর্ষণ মদ খেয়ে চুর একজনের পক্ষে করা সম্ভব কিনা, এসব প্রশ্নও, হয়ত, প্রশ্ন-ই রয়ে যাবে। ধরে নিতে হবে, ধর্ষণ যদি সঞ্জয় করে থাকে (মেয়েটির জীবিত অবস্থায় বা মৃতদেহের উপর), তাহলে খুন-ও সে-ই করেছে। হয়ত সঞ্জয় সাজা পাবে, অথবা যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে গুরু দণ্ড কিছু পাবে না। এদেশে যেমন হয় আর কি!
এখানে পুলিশ অপরাধী ধরার চাইতে অপরাধের প্রমাণ লোপাট করার কাজে বেশি দক্ষ।
কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা, তাদেরও অপরাধী ধরার রেকর্ড তেমন ঈর্ষণীয় কিছু নয়।
মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত আগ বাড়িয়ে শুনানি করে পনের দিন বাদে বাকিটা শুনবেন বলেন।
এমতাবস্থায় আমজনতা যায় কোথায়? খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো, মোবাইল ফোনে ভেসে আসা অজস্র খবরের মধ্যে আশার আলো খোঁজেন। যে খবরের অনেকটাই কল্পিত। গুজব। খুব খুউব রাগ নিয়ে রাস্তায় নামেন। হাতে হাত রেখে লড়তে চান। প্রশ্ন করেন – এবারেও, এই এত বড় ঘটনার পরেও, কেউ ধরা পড়বে না? অনেকবার আশাহত হতে হলেও, আশায় থাকেন…
কোনও কোনও সাংবাদিক, দেখলাম, হয়ত শ্লেষের সুরেই তাঁদের প্রশ্ন করছেন – ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে তো মিছিল করছেন, তা জাস্টিস-টা কার কাছে চাইছেন? শুনতে বিরক্তিকর হলেও প্রশ্নটা কিন্তু ভ্যালিড। এমতাবস্থায় ন্যায় বলতে কী বুঝব? আর সেই ন্যায় কার কাছে চাইব??
দেখুন, ‘তিলোত্তমা’-র মৃত্যুরহস্যের সমাধান এখনও অব্দি না হলেও একটা বড় রহস্য কিন্তু প্রকাশ্যে চলে এসেছে। এবং ধর্ষক-খুনীর পরিচয় ততখানি স্পষ্ট না হলেও, এই রহস্যের কুশীলবদের নাম যথেষ্ট স্পষ্ট। সীমাহীন দুর্নীতি ও সেই দুর্নীতির কাণ্ডারীর নাম। নয়ই আগস্ট রাত্তিরের ঘটনা একা সঞ্জয়ের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা, সে নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকলেও এই দুর্নীতি যে একা সন্দীপ ঘোষের পক্ষে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, এবিষয়ে সকলেই নিঃসন্দেহ।
এবং এই দুর্নীতি – যা আরজিকর মেডিকেল কলেজে উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল অবশ্যই – কিন্তু তা কেবলমাত্র এই একটি মেডিকেল কলেজে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই কথাটা মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-অধ্যাপকদের সকলেই জানেন – জানতেন অনেকদিন ধরেই – তবে এখন হয়ত কেউ কেউ সেটা মুখে স্বীকার করতে পারবেন। আর ডাক্তারি-জগতের বাইরের লোকজন হয়ত কথাটা – দুর্নীতির এই লেভেলটা – সে বিষয়ে সদ্য জানলেন। মানে, বর্তমান আমলে দুর্নীতি যে কমবেশি সব জায়গায়ই চলে, এটা সবাই জানেন – কিন্তু চিকিৎসা-শিক্ষার দুনিয়ায় তা যে এই স্তরে পৌঁছেছে, সেটা এখন জানতে পারলেন।
অনেকে হয়ত বলবেন, লাগামছাড়া এই দুর্নীতির শুরু ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই। হতেও পারে। হতেই পারে। কিন্তু, বর্তমান শাসকদলের একান্ত বিরোধী হয়েও বলি, আমার তেমনটা মনে হয় না। মানে, দুর্নীতি অবশ্যই ছিল – কিন্তু ব্যাপারটা এই স্তরে পৌঁছেছে গত কয়েক বছরে। মোটামুটি বলতে পারি, বিগত মেডিকেল কাউন্সিল নির্বাচনটি পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সে নির্বাচনে ঢালাও দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটেছিল – সে আর কোন নির্বাচনে ঘটে না!! – কিন্তু সেই নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শাসকদলের যে গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, তাঁরা অন্যস্তরের মানুষ। চিকিৎসার নৈতিকতার দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিকেল কাউন্সিলের হর্তাকর্তা হয়ে বসলেন এমন নীতিবোধহীন কিছু ‘চিকিৎসক’, সেই দুর্ভাগ্যজনক সত্যির বাইরে আরও বড় সত্যি – এঁদের ক্ষমতা স্রেফ মেডিকেল কাউন্সিলে সীমাবদ্ধ রইল না। মেডিকেল কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ থেকে ডিন, সর্বত্র নিযুক্ত হতে থাকলেন এঁদের পছন্দের লোক – সবাই ধামাধরা, এমন বলব না – কিন্তু অধিকাংশই তেমনই – স্বাস্থ্যশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিতদের ক্ষেত্রেও তা-ই। দেখুন, আরজিকর মেডিকেল কলেজের ঘটনায় মেডিকেল কাউন্সিলের এক কর্ণধার চটজলদি সেখানে হাজির হন, কাউন্সিলের আরও কিছু তরুণ সদস্যদের নিয়ে। মেয়েটির বাবা-মাকে আত্মহত্যার খবর জানানো হলেও, সেই একই সময়ে (বা তার আগেই) তিনি জেনেছিলেন ধর্ষণ ও খুনের খবর – একথা তিনি নিজেই মিডিয়াকে জানান। তিনি কেন এলেন? তিনি কেন ধর্ষণ খুনের ঘটনা বিষয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলেন? মেডিকেল কাউন্সিলের হর্তাকর্তারা স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নাক গলাচ্ছেন, এমন এর আগে ঘটেনি।
মেডিকেল ছাত্র-রাজনীতিতেও একটা বড় বদল এসেছে এঁদের কল্যাণে। স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নির্বাচন তুলে দেওয়ার সুবাদে ছাত্র-রাজনীতি বলতে মূলত দাদাগিরি – তোলাবাজি ইত্যাদি – ও পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানো কমানো। শাসক-ঘনিষ্ঠ ছাত্র-রাজনীতি ও শাসক-ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক-রাজনীতি যোগাযোগ রক্ষা করে চললেও দুইয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব ছিল – বর্তমানে সেটি মুছে গেছে। ছাত্র-নেতারা অধ্যাপকদের ‘চমকায়’ – অধ্যাপকরাও তাদের তোয়াজ করে চলেন, কেননা বদলি থেকে পদোন্নতি, সবই তরুণ তুর্কীদের হাতে।
তো পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা, এই মুহূর্তে, শাসকদলের যে গোষ্ঠীর দ্বারা যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার খোলনলচে না বদলালে কিছুই কাজের কাজ হবে না।
জাস্টিস চাই, বলতে – অন্তত এটুকু হোক।
সরকারি কর্মী হিসেবে এবং রাজ্যের একজন নাগরিক হিসেবে, আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার সেই জাস্টিস-এর দাবী। একজন চিকিৎসক হিসেবে এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক হিসেবে দাবি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছেও।
সিবিআই তদন্ত করতেই পারে – মহামান্য আদালত বিভিন্ন আকর্ষণীয় ‘অবজারভেশন’-এর পর পরবর্তী শুনানির তারিখ শোনাতেই পারেন – কিন্তু নিজের দলের সীমিত কয়েকজন গোষ্ঠীবদ্ধ মাফিয়া সিন্ডিকেট গোছের কিছু চালিয়ে গেলে তা শুধরানোর দায় সেই দলের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের। সব জানার পরেও – বিশেষত সব প্রকাশ্যে আসার পরেও – না শুধরাতে চাইলে ধরে নিতে হবে, এই অনাচার চলে এসেছে (এবং চলতে দেওয়া হবে) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মতিতে।
তো স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুলিশমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ জাতীয় কিছু দাবি আমার এখুনি নেই – গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারকে সরাতে গেলে ভোটের মাধ্যমেই সরাতে হবে – কিন্তু, জাস্টিস চাই বলতে আমি চাই রাজ্য স্বাস্থ্য-প্রশাসনের খোলনলচে বদল। প্রকাশ্যে যে মুখগুলো রয়েছে – চিকিৎসক-প্রশাসক থেকে শুরু করে আমলা অব্দি সকলেই – এবং আড়াল থেকে যারা কলকাঠি নাড়ছে, বদল এখুনি জরুরি। এবং যে মেডিকেল কাউন্সিলের দায় চিকিৎসার নৈতিকতার দেখভাল, সেই কাউন্সিলের শীর্ষ সদস্যদের নাম যখন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায়, তখন সেই কাউন্সিলকে যে বরখাস্ত করা জরুরি, সে তো বলা-ই বাহুল্য।
এটুকু-তে সর্বজনস্বীকৃত জাস্টিস হবে কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু এটুকু না হলে যে স্বাস্থ্য-প্রশাসন ও সামগ্রিকভাবে প্রশাসনের উপর মানুষের আস্থা ফিরবে না, সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।