সুপ্রিম কোর্টের শেষ শুনানির পর জনমনে একটাই প্রশ্ন, সুপ্রিম কোর্ট বলার পরেও এই বঙ্গদেশের এঁড়ে ডাক্তারেরা কেন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাচ্ছেনা- এই প্রশ্নটা যতটা না স্বতঃস্ফূর্ত, তার চেয়েও বেশি কিছু ব্যক্তি/সংস্থা দ্বারা জনমনে প্রোথিত। এর কারণ হিসেবে বলতে পারি, পড়ুয়া ডাক্তারেরা কর্মবিরতিতে থাকলেও সরকারি চাকরিরত ডাক্তারেরা অতিরিক্ত সময় কাজ করে জরুরি পরিষেবা এমনকি বহির্বিভাগও চালু রেখেছেন। একটা বড় সংখ্যার পড়ুয়াদের কর্মবিরতিতে থাকা দীর্ঘমেয়াদি রোগের রোগীদের চিকিৎসায় অন্তরায় হলেও, জরুরি পরিষেবায় ব্যাঘাত হওয়ার কথা নয় এবং তা ঘটেও নি। বরং এরই মাঝে মরণাপন্ন রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগীমৃত্যু হওয়ায়, খোদ পিজি হাসপাতালেই চিকিৎসক নিগ্রহের পুনরাবৃত্তি হয়েছে- সেকথা অনেকেরই অজানা। যাইহোক, সেসব কথা আলোচ্য বিষয়বস্তু নয়- লেখার বিষয়বস্তু সুপ্রিম কোর্টের আলোচনার মতো দিগভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার আগে মূলস্রোতে ফিরি।
প্রশ্ন হলো, কর্মবিরতি কেন? নিজেদের বিভাগীয় কংক্রীটের ছায়া ছেড়ে ত্রিপলের নীচে, রাজপথের তাপে, বৃষ্টিস্নাত হয়েও কর্মবিরতি কেন? নিজেদের সীমিত তিন বছরের প্রশিক্ষণকাল থেকে অমূল্য সময় ব্যয় করে কর্মবিরতি কেন? কর্মবিরতির উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার- ন্যায়বিচার করা আমাদের কাজ নয়, বিচারের দাবি আদায় করার জন্য সহিংস আন্দোলনও আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়- আমাদের হাতে শুধু একটাই ক্ষমতা ছিল সরকার তথা জনগণকে বার্তা দেওয়ার, সেটাই আমরা করেছি।
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদেছে- দিল্লিতে খোলা রাস্তায় বাসের মধ্যে ধর্ষণের কাণ্ডারীদের দিল্লি পুলিশ যে তৎপরতায় আটক করেছিল, ততোধিক তৎপরতার সাথে এরাজ্যে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করেছে রাষ্ট্রযন্ত্র- একথা আজ দিবালোকের মতো পরিষ্কার। অভয়ার পরিবারকে দেহ দেখতে বাধা, পড়িমরি ময়নাতদন্ত ও সৎকার, পরদিন সকাল থেকে উল্টোদিকের ঘরে ভাঙচুর, তারপর উন্মত্ত জনতার হাতে গোটা বিল্ডিংয়ে ধ্বংসলীলা- সব আমরা দেখলাম। শুনলাম সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পর্যবেক্ষণ- এরকম কার্যকলাপ গত ত্রিশ বছরে কেউ দেখেনি। সিবিআই-র তরফে জানানো হলো, তাঁরা হস্তান্তর পাওয়ার আগে সব কিছুই বদলে গেছিলো।
আজ দু’সপ্তাহ পেরিয়ে ‘আইন আইনের পথে চলছে’… আমাদের মধ্যে যারা একটু বাস্তববাদী তারা বেশ বুঝছে, অভয়ার ন্যায়বিচার এখন ঈশ্বরের হাতে। কোনো মিরাকল ছাড়া তা হয়তো আর সম্ভব নয়। পুলিশ বলবে, আমাদের হাতে কিছু নেই আর। সিবিআই বলবে, আমাদের হাতে আসার আগে সব পাল্টে গেছিলো। এর মাঝে সঞ্জয়-সন্দীপকে নিয়ে কিছু জলঘোলা হবে। তারপর আমরা জানবো “no one killed Abhaya”, ঠিক যেমন পাঁচ বছর আগে পরিবহর মাথা কে ফাটিয়েছিলো, সেটাও অজানা রয়ে গেছে।
তাহলে কর্মবিরতি কেন? অন্তত যে রাষ্ট্রযন্ত্র একটা রাজনৈতিক খুনকে ঢাকা দিতে বদ্ধপরিকর, তাকে সবার সামনে নগ্ন করা। আজ ডাক্তারেরা এই আন্দোলন না গড়ে তুললে অভয়া ‘আত্মঘাতী’ই থাকতো। যদি বা খুনের কথাটা সামনে আসতো, আরজিকরের প্রিন্সিপালের পোষ্য ডাক্তারেরা এটাকে আরজিকরের ‘অভ্যন্তরীণ’ ঘটনা বলে চেপে দিত। আজ এত কথা বাইরে এসেছে, ভয় কাটিয়ে বিভিন্ন কলেজে ছাত্রছাত্রী এমনকি অধ্যাপকেরাও অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তুলতে পারছে- সেটাই কম কী! কিন্তু এই আন্দোলন এখানেই থেমে যেতে পারেনা, এখনো অনেক পথ চলা বাকী, অনেক কেউটে স্বাস্থ্যব্যবস্থার গভীরে লুকিয়ে আছে- আজ তাদের বাইরে না বের করে আনতে পারলে এদের সাহস আরো বাড়বে, আগামী দিনে আরো অভয়ারা বলি হবে… সরকারি হাসপাতালের গণ্ডির মধ্যে একজন কর্তব্যরত ডাক্তারের জীবনহানি ও ধর্ষণ হলে, আজ এই রাজ্যে একজন প্রান্তিক মানুষের জীবনের কী গ্যারান্টি থাকলো!!
তাই আজ জানা দরকার ধর্ষকদের বাঁচাতে সরকারের এত তৎপরতা কীসের! এত নির্লজ্জভাবে অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হলো কেন! এই নিয়ে আলোচনা আজ দরকার। আর এই প্রশ্ন শুধু আমাদের কতিপয় ডাক্তারের নয়, গোটা সমাজের। তাইতো আজও দু’সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও মানুষ পথে নামছে, নতুনভাবে নামছে, আবার নামছে, শাসককে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করছে- আর তাতে শাসক এতটাই অস্বস্তিতে পড়ছে যে কপিল সিব্বল সুপ্রিম কোর্টে হাতজোড় করছেন, এই প্রতিবাদে লাগাম লাগানোর জন্য, হেড মাস্টারকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে স্কুলের পক্ষ থেকে মিছিল বন্ধ করার জন্য।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে এই নিয়ে বিশদ আলোচনা হচ্ছে না। তাদের আলোচ্য বিষয়বস্তু ডাক্তারদের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা নিয়ে আমরা কোনোদিন ভাবিনি। উন্মত্ত জনরোষের মুখেও কাজ করেছি, করোনার সময় নিম্নমানের পিপিই এবং চরম অব্যবস্থার মধ্যেও কাজ করেছি- জনস্বার্থে করেছি। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেদেশে রামমন্দির স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু- সেদেশে স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তা না কোনদিন ছিল, না থাকবে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সমান্তরালে চিকিৎসকনিগ্রহ চলেছে, মহামান্য আদালতের কাছে সেই খতিয়ান হয়তো নেই। কিন্তু আমরা নিরাপত্তা চাইনি, বিচার চেয়েছি। একজন প্রকৃত অপরাধীর যথাযথ শাস্তিই আমাদের ভবিষ্যতের একটা বড় নিরাপত্তা হতো। কিন্তু আইনের তো চোখ বাঁধা, সে নিজের পথেই চলছে- দু’সপ্তাহ পর তাঁদের শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে। এর মাঝে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে আরো শত শত নারীনিগ্রহ- তারিখের অপেক্ষায় থেকে যাচ্ছে বিচার, অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বুক ফুলিয়ে।
আজ সত্যি আমরা বাকরুদ্ধ- শাসনযন্ত্রের পরতে পরতে জমে থাকা আবর্জনা এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের সেই আবর্জনা সরিয়ে ফেলতে অনীহা আমাদের বিস্মিত করেছে, হতাশ করেছে, ক্রুদ্ধ করেছে, কিন্তু পরাস্ত করতে পারেনি। আমরা এখনো বিশ্বাস রাখি আরজিকরের কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে স্থানীয় থানা, কলকাতা পুলিশ, সিবিআই, স্বাস্থ্যভবন, নবান্ন, সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত- এখনো নিশ্চয়ই কিছু বিবেকবান মানুষ রয়েছেন। আমরা আশা রাখি তাঁরা সকলেই রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এই দুষ্টচক্রকে ভেদ করতে আগ্রহী হবেন এবং আমাদের রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার শাপমোচন করবেন- ততদিন আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।