এন্টালির বেঙ্গল পটারির কাছে প্যাঁচালো রাস্তার ধারে বাড়িটা।
পাশেই উজ্জ্বল সংঘ ক্লাব। ক্লাবের উৎপাতে মাঝে মাঝে এ বাড়িতে থাকাটা দায় হয়ে ওঠে। উৎপাত আরো বাড়ে যখন নীচের তলার ওরা চারটি মেয়ে ঘরে থাকে। ওরা চারজন এই বাড়িটার একতলায় মেস করে থাকে। ওরা মানে শিল্পী নিজে, আর সঙ্গে ইন্দ্রাণী, অলকা আর কাকলি । বেশীর ভাগ সময় কেউ না কেউ হাসপাতালে থাকে। ওরা সকলেই নার্স। কাছাকাছি হাসপাতালে কাজ করে। শিল্পী আর কাকলি এন আর এসে। ইন্দ্রাণী বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে। অলকা চিত্তরঞ্জনে। কোনো হাসপাতালই এখান থেকে খুব দূরে নয়। বাড়ি ভাড়াও অপেক্ষাকৃত সস্তা। আশেপাশে বাজারও আছে। পাড়াটা পুরোনো, রাস্তাগুলো অপরিষ্কার। কিছু করার নেই। ওদের মত আরো অনেক নার্স হাসপাতালে কোয়ার্টার না পেয়ে এই পাড়ায় ভাড়াবাড়িতে থাকে।
শিল্পীর বাড়ি নদীয়ার পায়রাডাঙায়। বাবার অ্যাজমা। আগে প্রাইভেট বাস চালাতো। বয়স হয়েছে, শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। এখন আর পারে না। দাদা দিল্লিতে চাকরি করে। মুলচাঁদে একটা হাসপাতালে ওটি বয়ের চাকরি। দিল্লিতে তো প্রায় দু সপ্তাহ ধরে কি ভয়ানক দাঙ্গা! বাড়িতে মা-বাবা খুব টেনশনে ছিল। বাজার করা আর চায়ের দোকানে বন্ধুদের আড্ডা ছাড়া কোথাও যায় না। পেনশন নেই। শিল্পী আর ওর দাদা-র আয়ে সংসার চলে। শিল্পী এন আর এসে হেমাটোলজি বিভাগে কাজ করে। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিটে। স্পেশালাইজড বিভাগে কাজ। তাই এখনই মেডিসিন ওয়ার্ড বা আই সি ইউ সিস্টারদের মত নিউমোনিয়া রুগী অ্যাটেন্ড করতে হচ্ছে না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ফিভার ক্লিনিক গুলোর ডাক্তার ও নার্সদের। ঢাল নেই তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার। পি পি ই গাউন, মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা-মায়ের খুব দুশ্চিন্তা ওদের দুই ভাই-বোনকে নিয়ে।
ওর চিন্তা ইন্দ্রাণীকে নিয়ে। ইন্দ্রাণী আই ডি হাসপাতালে কাজ করে। আই ডি তে আটজন করোনা রুগী ভর্তি আছে। তবে ইন্দ্রাণী অত চিন্তিত নয় । ওর অভ্যেস আছে। তাছাড়া আই ডি হাসপাতালে সব জিনিসপত্র সাপ্লাই আছে। ইন্দ্রাণী ঘরে ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করে তবে ঘরে ঢোকে। ওদের শিফ্টিং ডিউটি। কোনোদিন সকাল, কোনোদিন দুপুর, কোনোদিন রাত্রি। সন্ধ্যায় ওদের ঘরে আলো জ্বললেই পাশের ক্লাবের ক্যারমওয়ালাদের হুল্লোড় বেড়ে যায়। চারজনের কেউই এখনো বিয়ে করেনি। তাই ওরা অ্যাটেনশনটা উপভোগ করে। রাস্তায় মাঝে মাঝে টোন-টিটকিরি কাটলেও ছেলেগুলোকে খুব খারাপ বলে মনে হয় না। বাড়ির মালিক প্রণব বাবু প্রৌঢ়। দড়ির মত শুকনো চেহারা। শকুনে চোখ। দোতলায় থাকে। বৌ মারা গেছে। ঢোকা বেরোনোর সময় মেয়েগুলোর দিকে অসভ্য লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
রাত নটা। হাসপাতাল থেকে ফিরে শিল্পী স্নান করে বারান্দায় এসে বসেছে। এখন লক-ডাউনের জন্য আট ঘন্টার বদলে বারো ঘন্টার শিফট্ শুরু হয়েছে। অলকা রান্না করছে। কাজের লোকেদের ছেড়ে দিতে হয়েছে। তাই পালা করে নিজেদের রাঁধতে হচ্ছে। আজ অলকার পালা। সিঁড়ি দিয়ে কে নামছে? প্রণববাবু? শিল্পী ভাবলো বাইরে কোথাও বেরোচ্ছে বোধহয়। কিন্তু না। গেট খুলে এদিকেই এলো। কিন্তু কেন? এ মাসের ভাড়া তো মিটিয়ে দিয়েছে কবেই!
‘ফিরেছো তোমরা?’
‘হ্যাঁ, বলুন।’ শিল্পী বলল।
‘যা অবস্থা চারিদিকে! তা তোমাদের হাসপাতালের কি খবর?’
‘খবর সব ঠিক আছে। যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন। রান্নাঘরে যেতে হবে, কাজ আছে।’
‘তোমরা যেভাবে হাসপাতালে কাজ কর….তাছাড়া কি এক করোনা শুরু হয়েছে। ছোঁয়াচে রোগ। তাই বলছিলাম কাল সকালেই তোমরা এই বাড়ি ছেড়ে দাও। এত রাতে আর কোথায় যাবে? রাতটা না হয় এখানে থেকে গোছগাছ করে নাও।’
‘কেন, আমরা তো এ মাসের ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছি। আর তাছাড়া, ডিসেম্বর অবধি আমাদের চুক্তি আছে।’ ইন্দ্রাণী বলল। ইন্দ্রাণী এইমাত্র আই ডি হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছে।
‘আমরা সম্পূর্ণ সুরক্ষা মেনেই কাজ করি। আর তাছাড়া আপনার এবং আমাদের এন্ট্রান্স সম্পূর্ণ আলাদা।’ শিল্পী বলল।
‘শোনো,কালকে সকালে ছাড়তেই হবে। নইলে পুলিশ ডাকবো।’
‘ডাকুন। আমরাও যাব না কোথাও। দেখি, কি করতে পারেন আপনি!’
প্রণববাবু উঠে চলে গেল।
‘কি হবে রে শিল্পী? কোথায় যাব এখন?’
‘কোথাও যাব না। গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব। আমি দেখছি, ঘাটের মড়াটার কত ক্ষমতা!’
বাকিরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল। শিল্পী অনেকগুলো ফোন করল বিভিন্ন নম্বরে।
সকালে বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। একটা ভ্যানরিকশাও দাঁড়িয়ে । ক্লাবের ছেলেরা প্রণববাবু কে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু তার এক গোঁ। কালোমত, লম্বা, দাঁত উঁচু ছেলেটা- যে ওদের দেখে সবচেয়ে বেশী টোন কাটে- সে বলল, ‘কাকু করোনা ভাইরাসের জন্য নতুন আইন পাশ হয়েছে, ডাক্তার-নার্সদের বিরক্ত বা উৎখাত করলে জেলে যেতে হবে। আর তাছাড়া ওনারা কাজ না করলে আমরা তো বিনা চিকিৎসায় মারা পড়ব।’
‘আমি ওসব শুনতে চাই না। থানায় আমার বলা আছে। আমি এদের রাখব না। মরব নাকি?’
‘ঠিক আছে, আমি থানায় জানাচ্ছি। আমরাও বাড়ি ছাড়ব না’
‘জানাও, জানাও।’
এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এল। প্রণববাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু তিনি একগুঁয়ে। বাধ্য হয়ে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে ভ্যানে তুলল। ‘আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন দিদি। কোন অসুবিধা হলে জানাবেন।’ অল্পবয়স্ক অফিসারটি বলে গেল।
কাকলি বলল, ‘কি করে এসব করলি রে, তুই?’
‘কাল রাতে আর উপায় না দেখে আমাদের ইনচার্জ সবিতাদি-কে ফোন করলাম। উনি বললেন, প্রান্তর স্যারকে ফোন কর। প্রান্তর স্যার ছিল না? আমাদের হেমাটোলজি-র হেড, এখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন- ওনাকে ফোন করতেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। স্যার খুব হেল্পফুল- আর উপরমহলে ওনার অনেক যোগাযোগ। চল, এবার বেরোবার জন্য তৈরি হই।’
‘তুই যা। আমার নাইট ডিউটি শেষ। স্নান করে একটু ঘুম লাগাই।’
খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
Daroon laglo.
Khub bhalo laglo … Daroon…