ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ সকালেই দিয়েছিলেন বইটি। চেম্বার টেম্বার শেষ করে বাড়ি ফিরে দুই মেয়েকে ঘুম পাড়ালাম। ওদের মায়ের হাসপাতালে নাইট ডিউটি। তারপর মাঝ রাতে বইটি খুললাম।
ইচ্ছা ছিল দুচার-পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঘুমিয়ে পড়ব।
কিন্তু ঘুম তো দূরের কথা, খানিকক্ষণের মধ্যে উঠে বসলাম। উত্তেজনায় আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
বইটি থ্রিলার নয়, অলৌকিক কোন কিছু নিয়ে নয়, কোনও দুঃসাহসিক অভিযানের নয়। বইটিতে একজন চিকিৎসক খুব সাধারণ ভাষায় লিখেছেন তার প্রথম পোস্টিং দক্ষিণ ২৪ পরগণার বেলপুকুর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের গল্প।
সেখানে নিজের চেষ্টায় তিনি শুরু করেছিলেন কিছু অপারেশন। প্রায় নেই রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে রোগীদের জীবন বাঁচানোর জন্য সেইসব অপারেশনের বর্ণনা পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম ডাক্তারবাবুর সাথে। কোনি বা স্ট্রাইকার যেমন শেষ পর্যন্ত খেলার উপন্যাস হয়ে থাকে না- অভাব, সীমাবদ্ধতার সাথে লড়ে জেতার গল্প হয়ে ওঠে; এই লেখাও শেষ পর্যন্ত একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা থাকে না, পাঠকও জিতে যায় ডাক্তারবাবুর সাথে।
পড়তে পড়তে কত স্মৃতি ভেসে এলো। শরতের শেষের দিকের এক সোনা ঝরা দিন, মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে দুর্গাপুজো হয়ে গেছে, ২৫ বছরের একটি ছেলে খড়গ্রাম গ্রামীণ হাসপাতালে মাথা নিচু করে বন্ধাত্বকরণের অপারেশন করে চলেছে। পরপর চারটে টেবিল। চারটে টেবিলে রোগিণীরা শুয়ে আছেন। রোগিণী বলা ভুল হল। যারা লাইগেশন করতে আসেন তাঁরা কেউই অসুস্থ নন।
ছেলেটি আজ একা। আর যারা অপারেশন করে, দীপালি দি বা সঞ্জীব দা, তারা কেউ নেই। পুজোর কদিন বন্যার জন্য ছুটি বাতিল ছিল। দুজনেই পুজোর পর বাড়ি গেছে। তাতে অসুবিধা নেই। ছেলেটির আত্মবিশ্বাস আছে। একটানা ষাট থেকে সত্তরটি অপারেশন সে একাই করতে পারে। একটাই সমস্যা মায়েদের ডায়াজিপাম আর ফোর্টউইন দিয়ে ঘুম পাড়ানো। আর পেটের কাটার জায়গাটুকু লোকাল আনাস্থেশিয়া দেওয়া। পেট ফুটো করলেই তাঁরা নড়ে উঠছেন। তখন ছেলেটির ভোকাল টনিক চলছে। ‘এইতো হয়ে গেছে। পুজোয় ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোথায় গেছিলে মা? পারুলিয়ার পুজো দেখতে গেছিলে?’
যন্ত্রের মতো দুই আঙুলের ফাঁকে উঠে আসছে ফ্যালোপিয়ান টিউব। দুপাশ সুতো দিয়ে বেঁধে কাঁচি দিয়ে কেটে দেওয়া হচ্ছে মাঝের অংশটি। প্রতি দশটি অপারেশন হওয়ার পর এক কাপ করে চা আসছে। তিন চুমুকে চা শেষ করে আবার অপারেশন।
ছেলেটি একটি মায়ের পেট খুলে চমকে গেল। বাঁদিকের ডিম্বাশয়ে প্রায় বাতাবি লেবুর সাইজের সিস্ট। আশেপাশের নাড়ি ভুঁড়ির সাথে জড়িয়ে গেছে।
পাশে সুকুমার দা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলো ফেলে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওটা কি বটে ডাক্তারবাবু?’
‘টিউমার। এটা এখানে করা যাবে না। পেট বন্ধ করে কান্দিতে পাঠিয়ে দি।’
সুকুমার দা বলল, ‘এটা করে দেন ছার। ওরা বড় গরীব। আর কোথাও যেতে লারবে না।’
ছেলেটি বলল, ‘কি করে করব। জটিল অপারেশন। অনেক সময় লাগবে। পুরোপুরি অজ্ঞান করার ব্যবস্থা নেই। আমি বরঞ্চ ওর বাড়ির লোকের সাথে কথা বলি।’
মেয়েটির স্বামী ডাক্তারবাবুর কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর বলল, ‘এহানেই যা করার করি দেন। আমরা আর কনে যাব। তাতে উয়ার যা হয় হবে।’
‘এখানে এতো বড় অপারেশন করা মুশকিল।’
স্বামীর এক গোঁ। ‘এখানেই করি দেন।’
অগত্যা দুরুদুরু হৃদয়ে ছেলেটি অপারেশন শুরু করল। একজন সিস্টার সাহায্য করতে এসেছেন। খুব সাবধানে সিস্টটা আশে পাশের অন্ত্র থেকে ছাড়ানো হচ্ছে। লক্ষ একটাই যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস না কাটা পরে।
একবার সাহস করে শুরু করার পরে বাকিটা খুব সহজেই হয়ে গেলো। কেজি দুয়েকের ওভারিয়ান সিস্ট বার করে, সব জায়গায় রক্তপাত বন্ধ হয়েছে নিশ্চিত হয়ে পেট বন্ধ করা হল।
পরেরদিন সকালেই ছেলেটি দেখল রোগিণী ঈষৎ কুঁজো হয়ে সামনের মাঠে ধীরে ধীরে হাঁটছে। ছেলেটির সারা রাত জেগে থাকার ক্লান্তি চলে গেছে। এক ছুটে রোগিণীর পাশে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছো মা?’
এরকম হাজার হাজার স্মৃতি মাঝরাত্রে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। আমার প্রথম পোস্টিং খড়গ্রাম হাসপাতাল আর বেলপুকুর হাসপাতাল মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছিল।
“এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প” পড়তে পড়তে বারবার চোখ ভিজে উঠছিল। অপারেশনের বর্ণনা পড়ে চোখ ভিজে ওঠা এই প্রথম। এক হাত দিয়ে চোখ মুছে পরের পাতা উলটচ্ছিলাম। কে বলে আমাদের সামনে কোনও আদর্শ মানুষ নেই! আদর্শ মানুষ বহু আছেন। তাঁরা নীরবে কাজ করে যান। আমাদের ব্যর্থতা আমরা তাঁদের খুঁজে পাই না। বস্তুত আমরা তাঁদের খুঁজিও না।
এটি উপন্যাস নয়। ভাগ্যিস নয়। তাই শেষ পর্যন্ত ডাক্তারবাবু জিততে পারেন না। যথারীতি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোকজন ডাক্তারবাবুর পেছনে লেগে যান। ডাক্তারবাবু বেলপুকুর হাসপাতাল, হেলথ সার্ভিস ছেড়ে দেন। যোগ দিলেন WHO এর চাকরিতে।
প্রায় তিন ঘণ্টা লাগল ৮৬ পাতার চটি বইটিকে শেষ করতে। ঘড়িতে তখন ভোর চারটে। এবং ভোর চারটেতেই প্রথম পঙক্তি থেকে আবার পড়া শুরু করলাম।
এই বই শুধু চিকিৎসকদের নয়, সকলেরই অবশ্য পাঠ্য। অগ্নীশ্বররা এখনও আমাদের মধ্যেই রয়েছেন। আমাদেরই দেখার চোখ নেই। বাজারি পত্রিকা, যারা চিকিৎসক এবং বিরিয়ানির ডেলিভারি বয়কে এক করে দেখাতে চায়, সেই পত্রিকার পাতায় তাঁদের কোনও স্থান নেই। না ভুল হল। যদি ঝুঁকি নিতে গিয়ে তিনি কখনও ব্যর্থ হন, তখন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় খবর হয়।
মাত্র নব্বই টাকা খরচ করে সন্তানদের হাতে সকলে তুলে দিন এই অমূল্য সম্পদ। যা থেকে তাঁরা প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে লড়তে শিখবে। মানুষের জন্য লড়তে শিখবে।
এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প
লেখকঃ ডাঃ অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত
মূল্যঃ ৯০ টাকা।
প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯
He is our David
বইটা পড়ার সৌভাগ্য এখনো হয়নি… আপনার বর্ণনা শুনেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে…. পড়তে হবে নিশ্চই…
অসাধারণ! সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই ডা: অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত-কে। তবে বহু বছর আগে প্রত্যন্ত বেলপাহাড়ী ব্লকে বিডিওগিরি করার সূত্রে এইধরনের কিছু কিছু ঘটনার সাক্ষী আমাকে থাকতে হয়েছেে ।
বইমেলাতে অবশ্যই সংগ্রহ করব….
Kinboi