************************
– এতক্ষণ ভোত্তি কোচ্ছি অ্যাখোনো স্লাইন চালায় নি? শুয়ারের বাচ্চা ডাক্তার টিটম্যান জানে?
ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে জনা দশেক লোকের জটলা। বছরের চল্লিশের মদ্যপ লোকটার গাল গড়িয়ে পান চেবানো থুতু নেমে আসছে.. মাস্ক-ফাস্কের বালাই নেই। সমানে গলা ফাটিয়ে যাচ্ছিল..
– সুদু চ্যালেঞ্জ করে রেখে কি নাটক হোচ্চে নাকি? পেশেন মোরে গ্যালে কিন্তু..
তারপর তিন-চার অক্ষরের সুললিত বাক্যবাণ। ভিড় ঠেলে জুনিয়র ডাক্তার ভেতরে আসতেই গালাগালির মাত্রা বাড়ল। ডাক্তার মিনমিন করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন..
– আসলে হার্ট ফেলিওয়ের পেশেন্ট তো.. এই শ্বাসকষ্টের ওপর বাড়তি স্যালাইন পড়লে..
– টিটম্যান শিখাবি নি.. (চার অক্ষর) দিব কানের গড়ায়..
***
না, আজ চিকিৎসক নিগ্রহের গল্প শোনাতে আসিনি। যদিও এ কথোপকথন আপাতদৃষ্টিতে কাল্পনিক তবু অবাস্তব মোটেই নয়। বহু মানুষের বিশ্বাস স্যালাইন না দিলে আর চিকিৎসা কী? চলুন, আজ সেই শিরায় তরল চালানোর গল্প বলি..
ইউরোপে মধ্যযুগ থেকেই রক্তকে জীবনের আধার বলে মনে করা হ’ত। ধরে নেওয়া হয় রক্ত বদলে দিয়ে কিংবা যুবকের রক্ত বৃদ্ধ শরীরে প্রবেশ করিয়ে অনন্ত যৌবন লাভ করা সম্ভব। সে বিশ্বাস এতটাই বজ্রআঁটুনি ছিল যে ১৪৯২ সালে পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট বয়সজনিত কারণে অসুস্থ ও অথর্ব হয়ে গেলে তাঁর শরীরে তিন যুবকের রক্ত প্রবেশ করানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বলাই বাহুল্য, সে যুগে আধুনিক চিকিৎসার বিজ্ঞানসম্মত ট্রায়াল সুদূরকল্পনা। বিশ্বাসের হঠকারী প্রয়োগের জন্য কারো অনুমতি নেওয়ার দরকার পড়ত না। ফলাফল- অন্যের রক্ত শরীরে প্রবেশ মাত্র পোপ মারা পড়েন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা পড়েন ওই তিন যুবকও।
আরেকটু এগিয়ে যাই। ষোড়শ শতক। তখন অক্সফোর্ডে অনেক তারার ভিড়। ফিজিওলজি ও রক্ত সংবহন বিদ্যার উইলিয়াম হার্ভে, ফিজিক্সের রবার্ট বয়েল, অ্যানাটমির থমাস মিলার সহ আরও অগণিত বিজ্ঞানী নতুন আবিষ্কারে মত্ত। যদিও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যতটা এগিয়েছে, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সে তুলনায় প্রায় গর্ভাবস্থায়। চিকিৎসা বলতে প্রায় হাতড়ে হাতড়ে বিভিন্ন প্রচলিত ঘরোয়া টোটকা আর রক্তমোক্ষণ। এই রক্ত বের করে দিয়ে শরীরের বিষ বের করে দেওয়ার বিশ্বাসে লাভ হয়েছে যত না, ক্ষতি হয়েছে তার বহুগুণ। বেশিরভাগ রোগী রক্তশূন্যতায় মারা যেত। এই সময়েই ঘটে গেল এক সাড়া জাগানো ঘটনা। যা সে সময় এক বহুল আলোচিত গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৬৫০ সাল। অক্সফোর্ডের স্যার থমাস রিডের বাড়ির পরিচারিকা হিসেবে কাজ করতেন অ্যানি গ্রিন। বয়স বাইশ। অবিবাহিতা। একদিন হঠাৎ জানা গেল অ্যানি গ্রিন অন্তঃসত্ত্বা! এবং সে তার সদ্যোজাত সন্তানকে কোনোরকম ঘরোয়া কায়দায় বের করে খুন করেছে! ব্যাস! আর যায় কোথায়.. ততদিনে অবৈধ সন্তানের জন্ম লুকিয়ে রাখা বে-আইনি ঘোষণা হয়ে গেছে। বিচারে অ্যানি গ্রিনের ফাঁসির নির্দেশ হ’ল। বেমালুম চেপে যাওয়া হ’ল থমাস রিডের গুণধর নাতির কীর্তি। ষোল বছরের ছেলেটিই যে নবজাতকের বাবা! অ্যানি গ্রিন বিচারালয়ে বারবার বলার চেষ্টা করলেন- পূর্ণ নবজাতক নয়, আসলে অপরিনত অবস্থায় তাঁর বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। তিনি মোটেই বাচ্চাকে খুন করেন নি। কিন্তু, কে শোনে কার কথা? নাতির দোষ ঢাকতে প্রতাপশালী দাদুকে এটুকু করতেই হ’ত..
১৪ ই ডিসেম্বর সকাল। বাইবেল ছুঁয়ে প্রার্থনার শেষে গ্রিনকে নিয়ে যাওয়া হ’ল বধ্যভূমিতে। নিপাট আনুষ্ঠানিকতায় গ্রিনকে ঝুলিয়ে দেওয়া হ’ল ফাঁসিকাঠে। ডাক্তার মৃত্যু নিশ্চিত করার পর কফিনে ভরে গ্রিনের দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হ’ল অ্যানাটমি বিভাগে। সেখানে গ্রিনের মৃত শরীর কাটাছেঁড়া করবেন ডাক্তারি ছাত্ররা। এবং, আবারও চমক! পরের কফিনের ঢাকনা খুলতেই দেখা গেল গ্রিনের তখনও ক্ষীণভাবে শ্বাস চলছে, দুর্বলভাবে চলছে নাড়ির স্পন্দনও। ব্যাস! ধরে নেওয়া হ’ল, যে ফাঁসিকাঠ থেকে জীবন্ত ফিরে আসতে পারে সে নিশ্চয়ই ঈশ্বরের দূত! ক্রিস্টোফার রিন ও অন্যান্য ডাক্তারি ছাত্ররা গ্রিনের চিকিৎসায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তামাকের ধোঁওয়া, জড়িবুটি প্রলেপ আর রক্তমোক্ষণ করিয়ে এক মহিলার সাথে জড়িয়ে বেঁধে দেওয়া হ’ল। মহিলার শরীরের গরমে ধীরে ধীরে অ্যানি সুস্থ হয়ে চোখ মেললেন। পরবর্তী এক মাসের মধ্যে অ্যানি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি তিন সন্তানের মা’ও হ’ন। যদিও এই ঘটনা নিয়ে তিনি আর কোনও উচ্চবাচ্য করেছিলেন বলে শোনা যায় না।
আরও আট বছর বাদে পাখির পালক আর শুকরের মুত্রথলি দিয়ে শিরায় তরল পাঠানোর ব্যবস্থা শুরু হয়। মদ, আফিম মেশানো তরল কুকুরের শিরায় ঢেলে পরীক্ষা চালানো হয়। যদিও ফলাফল মোটেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল না। এরপর আরও বড় ঝুঁকি নিলেন দর্শন ও গণিতের অধ্যাপক জঁ ব্যাপ্তিস্তে ডেনিস। এবার সরাসরি পশু থেকে মানুষে রক্ত সঞ্চালন। পরীক্ষার জন্য বেছে নিলেন কোনও এক মানসিক বিকারগ্রস্ত হতভাগ্যকে। ন’আউন্স ভেড়ার রক্ত প্রবেশ করানো হ’ল। ফলাফল তাঁর ভাষাতেই বলা যাক..
“শিরায় ভেড়ার রক্ত যেতেই সে হাতে, বগলে উত্তাপ অনুভব করলো। নাড়ির স্পন্দন বেড়ে গেল এবং ঘামতে শুরু করলো। নাড়ির গতি দ্রুত ওঠানামা করতে শুরু করলো। বৃক্কের জায়গায় পিঠের দিকে এবং পাকস্থলীর ওপরে পেটে ব্যথা শুরু হ’ল। তারপর কুচকুচে কালো পেচ্ছাব শুরু হ’ল”
মিল না হওয়া রক্ত প্রবেশ করালে যা যা উপসর্গ হয় তার সব আধুনিক জ্ঞানের সাথেই এ বর্ননা মিলে যায়। এ ঘটনার পরে পরেই ব্রিটিশ রয়্যাল স্যোসাইটি এবং ভ্যাটিকান শিরায় তরল প্রবেশ করানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরবর্তী ১০০ বছরে আর কেউ এ বিষয়ে পরীক্ষা করার সাহস করেন নি।
তারপর, ১৭৯৫ সালে আমেরিকান বিজ্ঞান ফিলিপ স্যান ফিজিক প্রথমবার মানুষ থেকে মানুষে রক্ত সঞ্চালন করার চেষ্টা করেন। এবং, আশ্চর্যজনকভাবে ব্যর্থ হন! জেমস ব্ল্যানডেল প্রায় দশজনের শরীরে অন্যের রক্ত প্রবেশ করিয়ে দেখেন কেউ কেউ সহ্য করতে পারছে অথচ বাকিরা পারছে না। ১৯০১ সালে কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারের আগে অব্দি এ প্রশ্ন অমীমাংসিত ছিল।
এর মধ্যে ১৮৩১-৩২ সালে প্যারিসে সাংঘাতিক কলেরা শুরু হ’ল। সে যুগে কলেরা এক ভয়ানক রোগ। বারবার পায়খানা, বমি হয়ে জলশূন্যতা এবং অবধারিত মৃত্যু! তখনও বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার গড়ে ওঠে নি। এদিকে ওদিকে মলমূত্র ছুঁড়ে ফেলাই দস্তুর। নর্দমা উপচে মলমূত্র বাড়ির উঠোন ছাপিয়ে যেত। সেখানেই বাস এবং আহার। ফলত, কলেরা জীবাণুর সোনায় সোহাগা। ১৮৩২ সালে প্যারিসে আঠারো হাজার মানুষ মারা যান। তখনকার দিনের চলতি চিকিৎসা আফিম, মদ বা রক্তমোক্ষণে কাজের কাজ কিছুই হ’ল না। বরং, রক্তমোক্ষণে মৃত্যু আরও তরান্বিত হ’ল। এর মধ্যেই দেখা গেল হাল্কা গরম জলে নুন আর ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে শিরায় দিয়ে কোনও কোনও রোগীকে সুস্থ করা যাচ্ছে! এমনকি প্রায় মৃত্যু অবধারিত এমন রোগীও এ চিকিৎসায় সুস্থ হলেন!
এরপর বিজ্ঞান আর থেমে থাকে নি। ১৮৭৬ সালে ডা. সিডনি রিঙ্গার সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ক্লোরাইড মেশানো শিরায় দেওয়ার তরল আবিষ্কার করলেন। যার উপাদান প্রায় রক্তরসের কাছাকাছি। এখান থেকেই শিরা-তরল আবিষ্কারের মোড় ঘুরে গেল। প্রায় দেড়শো বছর পেরিয়ে রিঙ্গারের তরল আজও আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় বহুল ব্যবহৃত। রক্তের গ্রুপ আবিষ্কারের পর ১৯০৮ সালে জানা গেল রক্তের গ্রুপ জন্মগতভাবে অপরিবর্তনীয়। ১৯১৫ সালে বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড রবার্টসন রক্ততঞ্চন রোধ করার জন্য সাইট্রেট ব্যবহার শুরু করেন। শুরু হ’ল রক্ত জমিয়ে রাখার সূচনাকাল। ১৯৩৩ সালে ব্যাক্সটার কোম্পানি শিরা-তরল রাখার বিশেষ বোতল তৈরি করলে শিরা-তরল সঞ্চালন সম্পর্কিত সংক্রমণের হার কমে এল। ১৯৫০ সালে এল শিরায় ঢোকানোর প্লাস্টিক ক্যাথেটার। ১৯৬৪ সালে অ্যাঞ্জিওক্যাথ নিয়ে এল আধুনিক ইন্ট্রাভেনাস ক্যানুলা। ১৯৭০ সালে শিরা-তরলের প্লাস্টিক ব্যাগ। তারপর, ক্রমশ আরও আরও আধুনিক হয়েছে সংবহন বিজ্ঞান এবং চিকিৎসা সামগ্রী।
হাসপাতালে গেলেই দেখা যায় বিভিন্ন রঙের ইন্ট্রাভেনাস ক্যানুলা। যাকে আমরা চলতি কথায় চ্যানেল বলি। রঙ অনুযায়ী ক্যানুলার আকারের হেরফের হয়। একদম নবজাতকের খুব সরু ক্যানুলা থেকে বড়দের জন্য মোটা ক্যানুলা। যদিও সবারই কাজ করার মূল নীতি একই।
আসলে ইতিহাস আমাদের নত হতে শেখায়। এক একটা ছোট আবিষ্কারের পেছনেও লুকিয়ে থাকে বহু বছরের, বহু মানুষের শ্রম। তাই, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের উত্তরাধিকার কার হাতে থাকবে সেটাও বুঝে নেওয়া খুব জরুরি। ইতিহাস আর আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কহীন হাতে আধুনিক চিকিৎসার অধিকার তুলে দিলে জনস্বাস্থ্য টালমাটাল হয় তো বটেই, সেই সাথে অগণিত বিজ্ঞানীর অসংখ্য নির্ঘুম রাত আর অনন্ত স্বেদবিন্দুকেও অপমান করা হয়।