- ★
কানাইদা ছিল হাওড়া হাসপাতাল ইমারজেন্সির জিডিএ। জেনারেল ডিউটি অ্যাসিসটেন্ট। গ্রুপ ডি। এক জায়গায় কাজ করলে সখ্য একটা জন্মায়ই। কিন্তু কানাইদার সঙ্গে আমার প্রণয় তার বেশি কিছু ছিল।
সে ছিল শিল্পী মানুষ। হাসপাতালের ডিউটির বাইরে
ব্যান্ড পার্টিতে বাজনা বাজাত। সে ছিল ব্রাস ব্যান্ডের বাজিয়ে। চলতি কথায় যাঁদের বলা হয় ব্যান্ড পার্টি।
এখনও ব্যান্ডের অধিকাংশ বাজিয়ে আসেন বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকেই। বিবর্ণ একদা জমকালো ইউনিফর্মে নিজেদের সাজান তাঁরা। ঘষে-মেজে নেন প্রিয় বাদ্যযন্ত্রটিকে। তার পর রিহার্সালে সুর মেলানোর পালা। মরশুম ফুরোলে অধিকাংশ বাজিয়েরা ফিরে যান নিজের নিজের গাঁয়ে। বাজনা ছেড়ে মন দেন চাষবাস বা ব্যবসায়।
পুরো ব্যান্ড চাইলে প্রয়োজন অন্তত ১২ জন বাজিয়ের। রেস্ত বেশি হলে এমনকি ৫১ পর্যন্ত সদস্য থাকতে পারেন ব্যান্ডে। দু’ঘণ্টা করে শিফ্টের হিসেবে চুক্তি হয়ে থাকে। যাঁরা ব্যান্ডের বরাত দিচ্ছেন, তাঁরা চাইলে মাথার গোলাপি পাগড়ি কি ঘোড়ায় টানা গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিতে পারে ব্যান্ড পার্টিই।
একে আগেকার দিনে গোরাদের ব্যান্ডও বলত। খেয়াল করলে বোঝা যাবে ইংরেজ মিলিটারি ব্যান্ডের অনুকরণে তৈরি এই ব্যান্ডের পোষাক তথা ইউনিফর্মে সেই মিলিটারি পোষাকের অনুকরণ স্পষ্ট। মাথা থেকে পা অবধি।
হ্যারিসন রোড মানে মহাত্মা গান্ধী রোডের যে খন্ডাংশটি কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ এর দিকে গেছে তার বাঁদিকে পরপর রয়েছে দোকানগুলো। বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যান্ড, মেহবুব ব্যান্ড, নিউ ক্যালকাটা ব্যান্ড আরও কত। বাইরে ভেতরে কিছু রঙচঙে পোষাক ও বাদ্যযন্ত্র। উঁকি মারলে আর একটু বেশি দেখা যায়। যে টুকু দেখা যায় পুরোটাই অন্য এক জগতের ছবি। ঝলমলে কিন্তু বাইরে থেকেই আন্দাজ পাওয়া যায় দারিদ্রের। ঝলমলে পোষাকগুলো কিছু কিছু টুটাফাটা। যন্ত্রপাতিগুলো তত ঝাঁ চকচকে নয়। কিছুটা মলিন। জড়ো করা পেট্রোম্যাক্স, যেগুলো হ্যাজাকেরই ভিন্নতর সংস্করণ। গ্রাম থেকে আসা আমাকে কেউ বলেছিল ওগুলোর আরেক নাম ডে লাইট। ইদানিং তার জায়গা নিয়েছে এলইডি ল্যাম্প।
বিকেল সন্ধ্যের দিকে ওইখানেই ফুটপাথ আর দোকান মিলে রিহার্স্যাল। ব্যান্ড মাস্টারের নির্দেশে বেজে ওঠে ট্রাম্পেট, ক্ল্যারিনেট(বাঙালি উচ্চারণে কেন জানা নেই এটি ক্ল্যারিওনেট), স্যাক্সোফোন, সানাই, ড্রাম বা ঝুমঝুমি। নিবিড় অনুশীলনে রূপ পরিগ্রহ করে বাজার চালু হিন্দি গান কিম্বা বাঙালি বাড়ির অনুষ্ঠানের বরাত হলে, লাজে রাঙা হল কনে বউ গো…
কানাই দা বাজাতো ওই ড্রাম। ড্রাম আবার নানা সাইজের হয়। কিটি কিটি আওয়াজ করা কাড়া নাকাড়া আবার বিরাট বড় এক রকমের যাতে গুম গুম করে ভারি গম্ভীর আওয়াজ ওঠে। একদম শেষের এই সম্ভ্রম জাগানো বস্তুটি কানাইদা বাজাতো। কানাইদার একটু মোটার দিকে চেহারা। দেখবার মত বিশাল ভুঁড়ি। কত করে বলতাম কানাইদা একটু ডায়েটিং করে ভুঁড়িটা কমাও। প্রেশার, সুগার, কোলেস্টেরল, একশটা অসুখ বাধিয়ে রেখেছ। কানাইদা হাসত।
– ভুঁড়ি কোমাইলে হোবে না স্যার। এইটা দোরকার।
– কীসে দরকার, অ্যাঁ….
– স্যার, আমি যিটি বজাই, ওই ড্রামটা ভুঁড়ি না হলে সেটিং হোবে না।
শুয়োরের মাংস খুব ভালো রাঁধত কানাই দা। নাইট ডিউটিতে সেই মহাপ্রসাদ সর্বভুক আমাকে দু এক টুকরো দিত। মাঝে মাঝেই ভারি বিরাগ প্রকাশ করতাম আমার প্রফেশনের প্রতি। কানাইদা আশ্বাস দিত,
– ই ডাক্তারি কামটা হাল্কা ফুল্কা করে চালিয়ে লিন পেনশন তক। রিটায়ার করে লিন। বাকি আপনাকে ব্যান্ড পার্টিতে ক্যাচ মেরে ঢুকিয়ে লিব।
আমাদের সঙ্গে মিশে আমাদের লব্জ এই ক্যাচ কথাটা শিখেছিল কানাইদা।
ইমারজেন্সিতে টুটা ফাটা সেলাই, প্লাস্টার লক-জ সেটিং সব পারত। পারত শুধু না, ঈর্ষণীয় ভাবে ভালো পারত। বলতোও সেটা,
– আলফাল কেস হলে উ সব সিলাই আপনি করে দিবেন। ক্যাচ কেস হলে হামি হাঁথ দিব।
আমি তখন খড়দা থেকে হাওড়ায় ডিউটি করতে যাই। আমার গাড়ির চালক সঞ্জয় ভারি উৎসাহী ছেলে। কানাইদার কাছ থেকে কাটা ছেঁড়া সেলাইটা রপ্ত করেছিল। এক সন্ধ্যেয় টিএল জয়সওয়াল হাসপাতাল থেকে সেখানের অ্যাম্বুলেন্সে এক স্ক্যাল্প ইনজুরি কেস এল। মাথার চামড়ায় অনেকখানি সেলাই। খুব ধৈর্য ধরে আমার সঞ্জয় কানাইদার তত্ত্বাবধানে সেলাইটা করল। ড্রেসিং করা হয়ে গেছে। প্রেসকৃপশন লিখতে লিখতে টিএলজের ড্রাইভারকে বললাম,
– কী গো, তোমাদের ওখানে এই সেলাইও করার লোক নেই? এখানে তো কানাইদাও নয়, যে সেলাই করল সে আমার গাড়ির ড্রাইভার।
সেই অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভার এক গাল হেসে বলল,
– মাইনের দিন অত লোক মাইনে নেয়। আছে স্যার, প্রচুউর লোক আছে ডিউটিতে। কিন্তু কী বলি আপনাকে, আমি আর ডাক্তারবাবু ছাড়া সবাই ইয়ে টেনে আউট।
আড়চোখে দেখি, কানাইদা মিটিমিটি হাসছে। না, কানাইদা কখনও বেহেড হয়ে ডিউটি করত না।
আমাকে ব্যান্ড পার্টিতে কী বাজাতে হবে এই ভেবে একটু টেনশনে ছিলাম। স্বাভাবিকই। জীবনে গান বাজনার চর্চা করিনি কি না! আমার ধারণা ছিল ওই কাড়া নাকাড়া গোছের কিছু একটা দিলে তালে তাল মিলিয়ে ঝম্পর ঝম্পর কিছু একটা বাজিয়ে দেব। কৌতুহলে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম একদিন।
– ও কানাইদা, আমাকে কী বাজাতে দেবে গো? ওই তুমি যে রকম বাজাও না ওর চেয়ে ছোটো যে গুলো সে রকম কিছু?
কানাইদা গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল। ও আমার মিউজিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানত।
– গানের মদ্দিখানে উল্টাপাল্টা বিট পরলে পুরা সত্যনাশ হইয়ে যাবে। বাঁশি দিব আপনাকে। ওই যে শিঙ্গা মাফিক। হাঁথির শুঁড়ের মতুন উপ্রে দিকে পাকাইয়ে উঠে, ওই বাঁশি। গাল ফুলায়ে বজাবেন।
– বাঁশি? বলো কী দাদা। ড্রামই বাজাতে দিচ্ছ না আর জীবনে যা ফুঁ দিয়ে দেখিনি, এক্কেবারে সেই বাঁশি?
আধা নীমিলিত চোখে অভয় দিল কানাই দা
– ই বাঁশি সে বাঁশি নয় স্যার। ইতে ওই গাল ফুলিয়ে ব্যান্ডপার্টির সঙ্গে লেফট রাইট করে যাওয়াই শুধু কাজ। কুনো আবাজ বিরোয় না ই বাঁশিতে। রেট কম দিবে। একদিন খাটলে ধরুন আমি যা পাই তার আধা দিবে।
অতিমারি শেষ হলে নিশ্চয়ই ব্যান্ড পার্টি আবার স্বমহিমায় উৎসবে ফিরবে।
আমি রিটায়ার করে গেছি। সেই শব্দহীন বাঁশি বাজানোর বরাত পেতেই পারি এখন। কিন্তু কানাই দা কথা না রেখে চলে গেছে। হার্ট অ্যাটাকে। নীলাঞ্জন জানাল।
–