০৪.১০.২০২৪
মহাভারতের যুদ্ধ ১৮ দিনে শেষ হয়েছিল, এই গণজাগরণ অষ্টাদশ অধ্যায়ে তার দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা করলো। ৯ই আগস্টের ঘটনার প্রতিবাদে যে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি শুরু হয়েছিল, তা আংশিকভাবে উঠলো ২১শে সেপ্টেম্বর। এর সাথে রইলো আরো অসংখ্য কর্মসূচি।
১০১. আংশিক কর্মবিরতির প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হিসাবে জুনিয়র ডাক্তারেরা ছুটে গেছে বন্যা দুর্গতদের ত্রাণকার্যে। বিভিন্ন কলেজ থেকে বিভিন্ন জেলায় অভয়া ক্লিনিক ও ত্রাণের বন্দোবস্ত করা হয়। রাজ্য সরকার যেখানে নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, সেখানে এই জুনিয়র ডাক্তারেরা একান্ত নিজেদের চেষ্টায়, কোনোরকম সরকারি প্রচেষ্টা ব্যতিরেকে ত্রাণকার্যে এগিয়ে আসে। এবং প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষের সাড়া ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রায় প্রতিটি ত্রাণকেন্দ্রে পাঁচ থেকে সাতশ’ জন রোগীকে পরিষেবা দেওয়া হয়। যেসব খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেসবও বিলি হয়ে যায় চোখের নিমেষে। সদিচ্ছা থাকলে যদি এই কয়েকটা কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এত বড় উদ্যোগ নিতে পারলে, সরকার চাইলে কী না করতে পারে!! কিন্তু তারা ত্রিপলটুকুও হাপিস করতে ব্যস্ত।
১০২. বন্যাত্রাণ থেকে ফিরে এসে দু’টো বড় কর্মসূচি ছিল- সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ ও গণকনভেনশন। প্রথমটার জন্য এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে মানি স্কোয়ার মলে অনুমতি নেওয়া হয়েছিল, দ্বিতীয়টার জন্য মৌখিক অনুমতি নেওয়া ছিল ধনধান্য অডিটোরিয়ামের। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, শেষ মুহূর্তে অনুমতি প্রত্যাহার করলো মানি স্কোয়ার- প্রথমে আন্দোলনের দ্রোহ’রস’ মলের ‘পশ’ ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে এবং পরিশেষে উপরওয়ালার চাপের কথা স্বীকার করে। যেসব নাগরিক সমাজ প্রতিনিধি ও সেলেব্রিটিরা এসেছিলেন পারফর্ম করতে, তাঁরা চরম অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে যান। মানি স্কোয়ারের সামনে তখন অঝোর বৃষ্টি, পায়ের নিচে জলস্রোত। মাথায় দু’খান ছাতা নিয়ে গিটারের সাথে সবাই গেয়ে উঠলো প্রতিবাদের গান, আকাশ কেঁপে উঠলো বজ্রপাতের মতো স্লোগানে। বোঝা গেল, সামনের লড়াই আরো কঠিনতর হবে- সরকারি প্রতিরোধ আরো নির্লজ্জভাবে নেমে আসতে চলেছে।
১০৩. এবং তা এলোও- মৌখিক অনুমতির পরও ধনধান্যে গণকনভেনশনের অনুমতি বাতিল হলো। যে অডিটোরিয়ামে অভীক দের মতো একজন সমাজবিরোধী ডাক্তারের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, সেখানে এরকম প্রতিবাদসভার আয়োজন বেমানানই বটে। তাই কনভেনশনের স্থান পরিবর্তন করে এসএসকেএম অডিটোরিয়াম করা হয়। এসবের মাঝে আসে রক্তদান শিবিরের আয়োজন। কারণ আমরা শপথ নিয়েছিলাম, “রক্ত চাইলে রক্ত দেব, বিচার আমরা ছিনিয়ে নেব”। কিন্তু অনেকেই চেয়েও রক্ত দিতে পারলোনা। রক্তদান করার জন্য আনুমানিক ১০০জনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল- সেই সংখ্যাটা ১৩২ হয়ে গেল। আর রক্ত নেওয়ার বন্দোবস্তই নেই। এরকম অভুতপূর্ব সাড়ায় আমরা অভিভূত হয়েছি, অবাক হয়েছি, আরো সাহস পেয়েছি এগিয়ে যাওয়ার।
১০৪. এরপর এলো গণ-কনভেনশন ২৭সেপ্টেম্বর, এসএসকেএম অডিটোরিয়ামে। সরকার যে দাঁত-নখ বের করে অবশেষে নিজের প্রকৃত রূপ সামনে এনেছে, সেকথা সামনে আসছিল। সামনের মাসের পয়লা এবং দোসরা তারিখ গণমিছিলের আহ্বান জানানো হয় যথাক্রমে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের পক্ষ থেকে। কনভেনশন ভালোই চলছিল, এর মাঝেই খবর এলো সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ থেকে- আবার চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা। একজন খুবই সঙ্কটজনক রোগিমৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ জনরোষের শিকার হন চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। আবার নীরব দর্শকের ভূমিকায় সুরক্ষাকর্মীরা, যারা আদতে পুলিশও নয়- সিভিক ভলান্টিয়ার। এই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সিসিটিভি নয়, দুর্বৃত্ত দমনে সরকারি অনীহাই এসব আক্রমণের কারণ।
১০৫. শুধু যে সাগর দত্তে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে এমনটা নয়। ন্যাশনাল মেডিক্যাল, বর্ধমান মেডিক্যাল, রামপুরহাট- কয়েকদিনের মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে এরকম দুর্বৃত্তদের তাণ্ডব চলতে থাকে। যেখানে শাসকদলের জনপ্রতিনিধিরাই ডাক্তারদের ওপেন থ্রেট দেন- সে হুমায়ুন কবীরের মতো স্ট্যাম্প মারা লুম্পেন হোক বা ঘুষ নিয়ে ধন্যবাদ জানানোর সৌজন্য রাখা অধ্যাপক সৌগত রায় হোক, সেই খুনী-ধর্ষক-দুর্বৃত্তদের দল তৃণমূলের বাকিদের থেকে আর কী প্রত্যাশা রাখা যায়!! প্রত্যেক জায়গায় আক্রমণ হচ্ছে, “আরজিকর করে দেব” থ্রেট দেওয়া হচ্ছে- সরকার চুপচাপ দাঁড়িয়ে নিজের হাসপাতালে ভাঙচুর দেখেছে, আরো মানুষকে লেলিয়ে দিয়েছে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে… অথচ কেউ সাহস করে বলেনি, যে একটাও আরজিকর হতে দেবনা- এই হলো প্রশাসন।
এই রাজ্যের নেত্রীর থেকে আর কিছু প্রত্যাশার ছিলোনা, আমরা তাকিয়ে রইলাম শীর্ষ আদালতে, বিচারের জন্য।