প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি গুটিবসন্ত কোভিড-১৯ এর মতোই একটা ভাইরাসঘটিত রোগ, এতাবৎ বিশ্বে ছোঁয়াচে রোগগুলির মধ্যে গুটিবসন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটিয়েছে। যে টিকা দিয়ে তাকে পৃথিবী থেকে নির্মূল করা গেছে তার আবিষ্কর্তা এডোয়ার্ড জেনার, কিন্তু তার আগে এক ধরনের টিকা বিশেষ করে ভারত ও চীনে চালু ছিল। আজ দ্বিতীয় পর্ব।
গুটিবসন্তের বিশ্বজয়ের কাহিনী
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ঐতিহাসিকদের মতে, দশহাজার বছর আগে, কৃষি শুরু হবার সময় এই রোগ প্রথম জন্ম নেয়।
মিশরে তিন হাজার বছরের পুরনো মমিতে এর চিহ্ন দেখা গেছে।
ভারতবর্ষে এই রোগ অত্যন্ত পুরাতন বলে ভাবা হয়। সুশ্রুত সংহিতা বা চরক সংহিতায় ‘মসূরিকা’ নামে সম্ভবত এই রোগেরই উল্লেখ আছে, তবে এই সংহিতাদুটিতে এই রোগকে তেমন গুরুতর বলা হয়নি, তাই মসূরিকা সত্যিই গুটিবসন্ত কিনা সে নিয়ে সন্দেহ আছে। হয়তো ৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ (BCE), যখন ঐ সংহিতাদুটি সংকলিত হয়, তখন ভারতে গুটিবসন্ত তেমন বেশি ছিল না, বা কোনো কারণে তার আক্রমণ তেমন ভয়াবহ ছিল না। তাবে সাধারণাব্দ (CE) নবম শতকে সংকলিত ‘মাধবনিদান’ গ্রন্থে এই রোগের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে মনে হয় সেসময় গুটিবসন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, ও এদেশে একটি বড় ঘাতক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনদেশে এরোগ বহুদিনের, এবং ভারতের মতো চীনেও এর দেশীয় পদ্ধতিতে ‘টিকাকরণ’ চালু হয়েছিল-এই পদ্ধতি কিন্তু জেনার-এর আবিষ্কৃত পদ্ধতির চাইতে আলাদা।
এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের যেখানে যেখানে জনবসতি ছিল তার সর্বত্র এই রোগ বহু শতাব্দী ধরে ছিল। কিন্তু যতদিন আমেরিকা বাকি পৃথিবীর থেকে আলাদা হয়ে ছিল ততদিন অর্থাৎ কলম্বাসের আমেরিকা আগমনের আগে পর্যন্ত আমেরিকাতে এই রোগ আসেনি। এখন যেমন কোভিড-১৯ অতিমারি এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তখনও মানুষের মাধ্যম ছাড়া গুটিবসন্ত ছড়াতে পারত না। তাই ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকায় আসার পরে স্প্যানিশ নাবিক ও সৈন্যদের হাত ধরে গুটিবসন্ত রোগ নতুন বিশ্ব, অর্থাৎ দক্ষিণ এবং উত্তর আমেরিকাতে ছড়িয়ে পডল।
আমেরিকা মহাদেশে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার সময় একটা জিনিস লক্ষণীয় ছিল। স্প্যানিশ নাবিকরা সবাই আক্রান্ত হত না এবং আক্রান্ত হবার পরে অনেকেই সুস্থ হয়ে উঠত। কিন্তু আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের শরীরে রোগের বীজাণু একবার শরীরে ঢুকে গেলে প্রায় প্রত্যেকেই রোগে আক্রান্ত হত এবং রোগের ভয়াবহতা বেশি হত, আর অধিকাংশই মারা পড়ত।
কেন স্প্যানিশদের রোগ কম হত, আর আমেরিকান আদি অধিবাসীদের রোগ বেশি হত ও অধিক মারাত্মক হত?
গুটিবসন্তের বীজাণু স্পেনে বহুদিন ছিল, ফলে অনেক নাবিক বা সৈন্যের এ-রোগ আগে হয়েছিল। তাতে শুধু সেই নাবিক বা যোদ্ধা গুটিবসন্ত থেকে বাঁচত তাই নয়, তার দলে থাকা অন্য মানুষের সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে যেত—একে বলে হার্ড ইমিউনিটি। অন্যদিকে আমেরিকান আদি অধিবাসীগণ পুরুষাণুক্রমে এই বীজাণুর সংস্পর্শে আসেনি, ফলে তাদের কারো আগে রোগ হয় নি, প্রতিরোধ-ক্ষমতাও গড়ে ওঠেনি, হার্ড ইমিউনিটি-র প্রশ্নই ওঠেনা। আবার গুটিবসন্ত নিয়ে অভিজ্ঞতা ছিল বলে স্প্যানিশরা চিকিৎসার নামে রোগীর ক্ষতি করত না, কিন্তু আদি আমেরিকানরা রোগটি সম্পর্কে অপরিচিত থাকায় রোগ হলে ভুল চিকিৎসা করে এরা রোগীর ক্ষতি করত। স্প্যানিশদের সাধারণ স্বাস্থ্য ও খাবারদাবার মোটের ওপর ভাল ছিল, আর ঐসময়ে স্বভূমিচ্যুত আদি আমেরিকানরা অপুষ্টিতে ভুগত। এর ওপরে ছিল তাদের দাস বানানো ও ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মধ্যে গুটিবসন্ত ছড়ানো।
প্রসঙ্গত, কোভিড–১৯ অতিমারীর ক্ষেত্রে এই হার্ড ইমিউনিটি–র ধারণাটি প্রয়োগের কথা আসছে।
বলা হচ্ছে, লকডাউন ইত্যাদি করে রোগের ছোঁয়া বাঁচিয়ে সাময়িক লাভ, লকডাউন খুললে ভাইরাস পুরোদমে ছড়াবে। অনেকে বলছেন, বয়স্করা যেহেতু কোভিডে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি, কমবয়সীদের মধ্যে এই রোগ হতে দেওয়া যেতে পারে, অবশ্য তাদের বয়স্ক মানুষের থেকে দূরে থাকতে হবে। কমবয়সীদের মধ্যে মূলত মৃদু রোগ হবে, মৃত্যু তেমন বেশি হবে না। এভাবে দেশের অন্তত ৬০% মানুষের একবার কোভিড রোগ হয়ে গেলে, বাকিরাও ‘হার্ড ইমিউনিটি’ (Herd immunity)-র সুবিধা পাবেন। ফলে এরপর সহজে রোগ হবে না, আর বড় মহামারি আটকানো যাবে।
যেহেতু আজ থেকে মাত্র দুশো কুড়ি বছর আগেও গুটিবসন্ত রোগের কোন উপযুক্ত চিকিৎসা ছিল না এবং টিকাও ছিলনা, তাই ভারতবর্ষে ইউরোপে বা পৃথিবীর সর্বত্রই এই রোগ মহামারি হিসেবে দেখা দিত, এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন উপায় জানা ছিল না। তবে মানুষ নিশ্চেষ্ট ছিল না। ভারত ও চীনদেশে গুটিবসন্তের ‘টিকা’ কমবেশি চালু ছিল।
গুটিবসন্তের গুটির রস থেকে মালমসলা নিয়ে এই টিকা দেওয়া হত। আজ আমরা জানি, এর অর্থ হল গুটিবসন্তের ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করানো। ফলে টিকা নেবার পরে দেহে গুটিবসন্তর লক্ষণ দেখা দিত, কিন্তু সাধারণত সেটা স্বাভাবিক গুটিবসন্তের চাইতে কম ভয়াবহ হত। টিকার ফলে গুটিবসন্ত হয়ে রোগী মারা যাবার ঘটনা অল্প হলেও অতি-বিরল ছিল না। টিকা বা ইমিউনাইজেসন-এর যে ইতিহাস আমরা পড়ি, তাতে এই ‘টিকা’ অস্বীকৃত। জেনার-এর কাউপক্স টিকা দিয়েই টিকা-র শুরু ধরা হয়, আর জেনারকে ফাদার অফ ভ্যাকসিনোলজি অর্থাৎ টিকাকরণের জনক বলা হয়। তাই জেনার নিয়ে কথা বলতে গেলে টিকা নিয়ে দু-চার কথা জানা দরকার।
টিকা কাকে বলে?
বীজাণুঘটিত অসুখ থেকে বাঁচার জন্য আমাদের শরীরে, মূলত রক্তে, কিছু কোষ আছে। যখন কোনো বীজাণু, তা ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাক-ভাইরাস যাই হোক, শরীরে ঢোকে, তখন এই দেহকোষগুলি বহিরাগত শত্রুকে মারার মতো রাসায়নিক তৈরি করে, মূলত অ্যান্টিবডি। প্রথমবার বীজাণু ঢুকলে তাকে শত্রু বলে চিনে ঠিকঠাক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সময় লাগে, কিন্তু শরীর সেই বীজাণুকে চিনে রাখে, যেন পুলিশের খাতায় নাম-ওঠা দাগি আসামি। ঐ একই বীজাণু পরে আবার শরীরে ঢুকলে খুব দ্রুত সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। আমরা বলি শরীর ঐ বীজাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে। এইজন্যই একবার গুটিবসন্ত হলে দ্বিতীয়বার তা হয় না।
টিকা এই সুযোগটাকে কাজে লাগায়। পুরনো পদ্ধতিতে টিকাকরণে গুটিবসন্তের বীজাণুই শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হত, তাতে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা আসত। কিন্তু সেটা নিরাপদ ছিল না। টিকার গুটিবসন্তের বীজাণু থেকে গুটিবসন্ত হত, হয়ত তা কম মারাত্মক হত—তবে অল্প কিছু মানুষ স্রেফ টিকার জন্যই গুটিবসন্তে মারা যেতেন। জেনার যে টিকা আবিষ্কার করলেন তাতে ঐ একইভাবে সুস্থ মানুষের চামড়া ফুঁড়ে বীজাণু ঢুকিয়ে দেওয়া হত, তবে সেটা গো-বসন্তের বীজাণু। গো-বসন্ত আর গুটিবসন্ত এ-দুটো রোগের ভাইরাসের গঠন কাছাকাছি হওয়াতে মানুষের শরীর গো-বসন্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেটা গুটিবসন্তের ভাইরাসকেও মেরে ফেলে, ফলে রোগ হয় না। অবশ্য এটা খানিক আন্দাজি কথা, গো-বসন্তের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শারীরিক প্রতিরোধ গুটিবসন্তকে আটকাবে কেন সে ব্যাখ্যা মেলা শক্ত—একে এক আকস্মিক সৌভাগ্যই বলতে হবে। গো-বসন্তের জীবন্ত ভাইরাস আমাদের শরীরে ঢুকিয়ে দিলেও তা তেমন রোগ সৃষ্টি করতে পারে না—প্রতিটি প্রাণীর শরীরে রোগ ঘটানো ভাইরাস সাধারণত আলাদা (পাদটিকা ১ দেখুন)। এই যে বীজাণু (বা তার অংশ) শরীরে ঢুকিয়ে শরীরকে দিয়ে তার প্রতিরোধ তৈরি করা, একে বলে সক্রিয় প্রতিরোধ টিকা। যেমন মুখে খাবার পোলিও টিকা—এতে থাকে জ্যান্ত পোলিও ভাইরাস, কিন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই ভাইরাসের আক্রমণ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়। আবার পোলিও টিকার আরেকটা রকম আছে, তাতে মৃত পোলিও ভাইরাস ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। টিটেনাস ব্যাকটেরিয়া মেরে তার দেহাংশ দিয়ে টিটেনাস-এর টিকা বানানো হয়।
নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ টিকাতে সরাসরি অ্যান্টিবডি ব্যবহার করা হয়। যেমন জলাতঙ্কগ্রস্ত পশু তেমনভাবে কামড়ালে কেবল সাধারণ সক্রিয় প্রতিরোধ টিকা যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে জলাতঙ্ক-ভাইরাস মারার অ্যান্টিবডি ইঞ্জেকশন করে দিতে হয়। রোগ হবার আগেই দেওয়া হচ্ছে, এবং অ্যান্টিবডির মাধ্যমে কাজ করছে, তাই এটাও টিকা, কিন্তু নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ টিকা।
শেষ করার আগে বলে রাখি, গুটিবসন্তের ল্যাটিন নাম Variola (ভ্যারিওলা)। জেনার-এর টিকার আগে গুটিবসন্তের রস দিয়ে যে টিকাকরণের পদ্ধতি ছিল, তা ভারতে টিকা নামে পরিচিত হলেও, ইউরোপে ডাক্তারি পরিভাষায় তার নাম ছিল Variolation (ভ্যারিওলেশন), অর্থাৎ গুটিবসন্ত ঘটানো, Immunization (ইমিউনাইজেশন) বা অনাক্রম্যতা তৈরি নয়।
পরের পর্বে আমরা এডোয়ার্ড জেনার-এর অবদান নিয়ে আলোচনা করব। পরে আমরা দেখতে চাইব, ভারতে বা চীনে যে প্রাচীন পদ্ধতিতে টিকা দেওয়া হত, তা টিকা-র শর্ত পূরণ করেছিল কিনা।
পাদটিকা ১– কোভিড, সার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু এসব ভাইরাস পশুপাখি থেকে পরিবর্তিত অর্থাৎ মিউটেটেড হয়ে মানুষে এসে রোগ সৃষ্টি করছে। ফলে এক প্রাণীর রোগ তৈরি করা ভাইরাস অন্য প্রাণীতে রোগ করতেই পারে না, এমন নয়।
তথ্যসূত্র
১) Edward Jenner and the history of smallpox and vaccination, Stefan Riedel, https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1200696/
২) Vaccine epidemiology: A review. Chandrakant Lahariya. Journal of Family Medicine and Primary Care, 2016 Jan-Mar; https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4943153/
চিত্র পরিচিতি (কেবলমাত্র অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য)
১) গুটিবসন্তের চিহ্নযুক্ত মমি (ফারাও পঞ্চম র্যামেসিস, মৃত্যু ১১৪৫ সাধারণ পূর্বাব্দ (BCE))
২) আমেরিকান আদিবাসীদের মধ্যে গুটিবসন্ত (মেক্সিকোর আজতেক চিত্র, সাধারণাব্দ (CE) ষোড়শ শতক)
৩) প্রাচীন পদ্ধতিতে টিকাকরণ (Variolation)– ভারত (কল্পিত চিত্র, বাস্তব অনেকটাই অন্যরকম)
৪) প্রাচীন পদ্ধতিতে টিকাকরণ (Variolation)– চীন (চিত্রের সময়কাল অজ্ঞাত, ইংরাজি বইতে ১৯১৩ সালে প্রথম প্রকাশিত)
৫) প্রাচীন পদ্ধতিতে টিকাকরণ (Variolation)– ইউরোপ ( ১৭২১ সালের ব্যাঙ্গচিত্র)