আগের পর্বটা যদি পুরো ভুলে না গিয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রথম সাতখানি সূত্রে যে কথা বলা হয়েছে, তার মূল নির্যাস, চিকিৎসকের কর্তব্য, উপসর্গ দেখে সমগ্র মানুষটিরই চিকিৎসা করা, তাঁকে নীরোগ করা আর যতো দ্রুত সম্ভব আরোগ্যে ব্রতী হওয়া। উপসর্গ দেখে রোগনির্ণয়ের সময়, চিকিৎসক মাথায় রাখবেন রোগীর জীবনযাপন-অভ্যাস-চরিত্র ইত্যাদি আর আরোগ্যের লক্ষ্য হবে রোগের মূলগত নিরাময়, বা বলা ভালো, রোগের নির্মূল। যে চিকিৎসক যথার্থভাবে জানেন রোগের কতোখানি নিরাময়যোগ্য, ওষুধ কতোখানি কার্যকরী, আর জানেন অসুখ-অনুসারে ওষুধের প্রয়োগবিধি, তিনিই সুচিকিৎসক। এর পাশাপাশি সুস্থ মানুষের স্বাস্থ্য বজায়ে চিকিৎসকের ভূমিকা যেভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা তো শিরোধার্য।
কথাগুলোর যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ, বোধহয়, নেই। কথাগুলো চিরকালীন – বিশেষ করে, আবারও মনে করিয়ে দেওয়া যাক, যদি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচারের পরে বর্তমান পরিস্থিতিতে কথাগুলো অনুধাবন করি, তাহলে তো আরো বেশী করে তাৎপর্যপূর্ণ।
বর্তমান অ্যালোপ্যাথির তখন শৈশব। তৎকালীন চিকিৎসার হালত কী ছিল, তার উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রক্তক্ষরণ বা ব্লাডলেটিং সেই আমলের অন্যতম প্রধান চিকিৎসাপদ্ধতি। অন্যদিকে ভেসালিয়াস-হার্ভের হাত ধরে প্রাপ্ত শারীরবৃত্ত-শারীরিক অন্তর্গঠনের প্রাথমিক পাঠ পেতে শুরু করে রোগের চিকিৎসা ক্রমশই সামগ্রিক মানুষ থেকে রোগগ্রস্ত প্রত্যঙ্গের দিকে সরে আসছে।
অর্থাৎ, একদিকে চিকিৎসা হয়ে উঠছে নৈর্ব্যক্তিক আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে উদাসীন, অন্যদিকে সেই চিকিৎসার কার্যকারিতা নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন।
তামার খনি অঞ্চলে মজুরদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে তিতিবিরক্ত হ্যানিম্যান প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির উপর বিশ্বাস হারালেন। আর, শুরু করলেন নিজস্ব চিকিৎসাপদ্ধতি, যা কিনা এক ভিন্ন চিকিৎসাদর্শনও বটে। যে দর্শনে খন্ড খন্ড করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়, চিকিৎসা হবে সমগ্র মানুষটিরই, আর সেই চিকিৎসায় ব্যবহৃত হবে ন্যূনতম ওষুধ।
লক্ষ্য করুন, হ্যানিম্যানের লেখা বইটির প্রথম নাম কিন্তু, অর্গ্যানন অফ দ্য র্যাশানাল আর্ট অফ হিলিং। এইখানে র্যাশানাল কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইদানিং তো হোমিওপ্যাথি থেকে যুক্তিটা হারিয়ে যাচ্ছে, তাই না? অন্তত, হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধ মতবাদীরা সেকথাই বলে থাকেন।
এখানে বলে রাখা যাক, হোমিওপ্যাথির জনক হিসেবে অনেকে হ্যানিম্যানকে চিনলেও, এই চিকিৎসাব্যবস্থার শুরু কিন্তু হ্যানিমানের আগেই। ভিয়েনার আন্তন ভন স্টর্কের পথ ধরে এগিয়ে হ্যানিম্যান এই চিকিৎসাব্যবস্থাকে একটা সুসংহত রূপ দিয়েছিলেন। এবং, হ্যানিম্যানের ভাবনা ছিল বেশ বৈপ্লবিক।
কিন্তু, প্রশ্নটা থাকেই, প্রায় একক প্রয়াসে প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার বিপক্ষে গিয়ে নতুন ভাবনার যে বৈপ্লবিক দুঃসাহস – যে প্রয়াস বিপুল জনপ্রিয়তা পেতে থাকল কয়েক দশকের মধ্যেই – তা এই বিগত দুশো বছরে দমবন্ধ জলাশয়ে পরিণত হলো কোন পথে!!
ধরুন, হোমিওপ্যাথি ওষুধের বিষয়ে মূল আপত্তির যে জায়গাটা – দ্রবণে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিমাণে ওষুধ থাকার সুবাদে পুরো দ্রবণটিই প্রবল শক্তিশালী ওষুধে পরিণত হওয়ার যুক্তি – সেই তত্ত্ব এই দুশো বছরে বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরেও কীভাবে অপরিবর্তিত থাকতে পারে?
অনেকেই জানেন, হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রস্তুতের সময় মূল একটি উপাদানকে উত্তরোত্তর লঘু দ্রবণে পরিণত করা হয় – দ্রবণে দশভাগের একভাগ ঔষধ-উপাদান থাকলে তা 1X, তাকে আরো দশগুণ লঘু করে একশোভাগের একভাগ উপাদান থাকলে 2X, আরো দশগুণ লঘু করলে 3X ইত্যাদি – অর্থাৎ সংখ্যাবাচক দুই-তিন-চার-পাঁচ ইত্যাদি দশের উপরের সূচক অর্থে – 7X শক্তির অর্থ এক কোটি ভাগে একভাগ ঔষধ-উপাদান। একইভাবে 1C-র অর্থ একশো ভাগে একভাগ ঔষধ-উপাদান – 2C-র অর্থ (১০০ x ১০০) দশহাজার ভাগে একভাগ ঔষধ-উপাদান ইত্যাদি ইত্যাদি।
এতে আপত্তির কিছু ছিল না – কম ডোজে ওষুধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা করতে চাইলে, সেকাজ কেউ করতেই পারেন। সমস্যা হল অন্যত্র, তাঁরা দাবী করতে শুরু করলেন, দ্রবণ যত লঘু হয়, অর্থাৎ দ্রবণে ওষুধের ভাগ যতোই কমে আসে, ওষুধ ততোই জোরদার ও শক্তিশালী হয়। কিন্তু, ওষুধের শক্তি 12C বা 24X-এর বেশী হওয়ার অর্থ একভাগ ওষুধ-উপাদান রয়েছে একের-পরে-চব্বিশটা-শূন্য পরিমাণ দ্রবণে – যাতে কিনা, অন্তত অ্যাভোগাড্রোর তত্ত্ব মানলে, এক লিটার দ্রবণে একটি ওষুধের অণুও থাকার সম্ভাবনা কম – আর আপনার হাতে ছোট্ট শিশিটিতে থাকা ওষুধের কথা তো বলাই বাহুল্য। এদিকে মুশকিল, অতি লঘু দ্রবণে ওষুধের অণুর উপস্থিতি বিষয়ে বা অনুপস্থিতি সত্ত্বেও গুণাগুণ বজায় থাকা নিয়ে আপনি যতোই নিশ্চয়তা দিতে চান, অ্যাভোগাড্রোর বিকল্প তত্ত্ব এই মুহূর্তে বাজারে সেভাবে নেই।
কিন্তু, আবারও মনে করিয়ে দেওয়া যাক, আঠেরোশো সালে তো রসায়ন এমনধারা এগোতে পারে নি। অ্যাভোগাড্রো আর হ্যানিম্যান সমকালীন হলেও অ্যাভোগাড্রোর তত্ত্ব তখনও হাইপোথিসিস – সর্বজনস্বীকৃত নয়। কাজেই, এক লিটার জলে এক ফোঁটা ওষুধ ঢেলে খুব করে ঝাঁকালে, আর তার পরে তার মধ্যে আরো ক’লিটার বা কয়েকশো লিটার জল মেশালে, তার মধ্যে যে আর অণু-পরিমাণ ওষুধও থাকে না, এবং অণুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তামাম দ্রবণটিই যে অতীব শক্তিশালী ওষুধে পরিণত হতে পারে না – এই সরল সত্য বিজ্ঞান দিয়ে জানার সুযোগ হ্যানিম্যানের হয়নি। অনুমান করা কঠিন নয়, কার্যকরী ওষুধের অভাব আর ভালো-করতে-না-পারো-খারাপ-কোরোনার সনাতন গ্যালেন-হিপোক্রেটিয় নীতিই হ্যানিম্যানকে বাধ্য করেছিলো এরকম ভাবতে।
উইলিয়াম অসলার-এর কথায় ফিরি –
“No regular physician would ever admit that the homeopathic preparations, ‘infinitesimals,’ could do any good as direct curative agents; and yet it was perfectly certain that homeopaths lost no more of their patients than others. There was but one conclusion to draw– that most drugs had no effect whatever on the diseases for which they were administered.”
অর্থাৎ, কোনো স্বাভাবিক চিকিৎসকই মানবেন না, যে, হোমিওপ্যাথি ওষুধ তাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ওষুধের পরিমাণ নিয়ে সরাসরি অসুখ সারানোর কাজে লাগতে পারে। কিন্তু, এও অনস্বীকার্য, (ইতিহাসের সেই সময়ে) অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতির চাইতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় বেশী মানুষ মারা যেতেন না। এর থেকে যে সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতে পারি, সে হল, অধিকাংশ (অ্যালোপ্যাথি) ওষুধ যে অসুখের জন্যে প্রয়োগ করা হত, অসুখ সারানোর ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ছিল নগণ্য।
কিন্তু, হ্যানিম্যানের তত্ত্ব ইত্যাদি তো অনেক অনেএএএক বছর আগের কথা। সব মহাদেশেরই নদী দিয়ে তারপর বিস্তর জল গড়িয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানের সবকটি শাখার মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানও এগিয়েছে অনেক – এবং, বিজ্ঞানের বাকি শাখাপ্রশাখার উন্নতি চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। অনিবার্য প্রশ্ন জাগে, দুশো বছর ধরে, হাজারে হাজারে হোমিওপ্যাথ কেন তাঁদের চিকিৎসাপদ্ধতিটিকে বিজ্ঞানের সূত্রে বাঁধতে চেষ্টা করলেন না? কেন বিজ্ঞানের নিত্যনতুন সত্যের আলোকে নিজেদের ভালোবাসার শাস্ত্রটিকে নতুন করে আবিষ্কার করার পরিশ্রমটুকু করলেন না?? না, এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।
হ্যানিম্যানসাহেব তো নিজেই নিজের কথাকে বেদবাক্য বলে ধরে থাকেন নি। তাঁর অর্গ্যানন প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮১০ সালে। জীবদ্দশাতে তিনি এর পরিমার্জন করেন বেশ কয়েকবার। শেষবার ১৮৪২ সালে। বহুবছর পরে প্রকাশিত হয় সেই ষষ্ঠ সংস্করণ। প্রথম আর ষষ্ঠ সংস্করণের ফারাক বিস্তর।
তাহলে, তাঁর অনুসারীরা, সেই অর্গ্যাননকেই অভ্রান্ত বেদ-কোরাণ বলে থেমে থাকলেন কেন? কেন প্রশ্ন করার, পরীক্ষা করার যুক্তিবোধ হোমিওপ্যাথি থেকে হারিয়ে গেল? বা, আরো রূঢ় ভাষায় বললে, কেন হোমিওপ্যাথি থেকে মেধা বিদায় নিলো?
হ্যাঁ, একটা কারণ নিশ্চয়ই অর্থাভাব। প্রাতিষ্ঠানিক নেকনজর থেকে হোমিওপ্যাথি চিরকালই বঞ্চিত। কিন্তু, এইটা তো একমাত্র কারণ হতে পারে না। প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই যে চিকিৎসাপদ্ধতির উদ্ভব ও বিকাশ, সে যে প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য পাবে না, এ তো জানাই কথা। কিন্তু, সেই কারণে, নাকি সেই অভিমানে, হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মকানুনগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবে, এ কেমন কথা!!
একথা অনস্বীকার্য, যে, বিগত শতকের শুরু থেকেই, অ্যালোপ্যাথি ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসাব্যবস্থাকে দূরে সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার আগে পর্যন্ত, যেমন ধরুন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, সবকটি চিকিৎসাব্যবস্থাকে সমান গুরুত্ব দিয়েই পড়ানো হতো। আর চিকিৎসাশিক্ষা ছিলো, প্রকৃত অর্থেই, ইন্টারডিসিপ্লিনারি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির সূচনা এক হোমিওপ্যাথি ছাত্রের হাতেই।
কিন্তু, ঊনবিংশ শতকের শেষে রকফেলার-কার্নেগীর প্রচুর পেট্রোরাসায়নিকজাত ওষুধ বিক্রির বাজার তৈরীর জন্যে, মেডিকেল পাঠক্রমের “আধুনিকীকরণ” জরুরী হয়ে পড়লো। আব্রাহাম ফ্লেক্সনারের নেতৃত্বে ঢেলে সাজানো হলো মেডিকেল শিক্ষাক্রম। একমাত্র অ্যালোপ্যাথী পেলো মডার্ণ মেডিসিনের তকমা। বাকি সবাই দুয়োরানী। এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে কখনো করা যাবে। অবশ্য, এই ঘটনায় আমাদের অবাক হওয়া সাজে না। এর বহু আগেই, ব্রিটিশরাজ, পরিকল্পিতভাবেই, আমাদের যুগযুগান্ত ধরে পরীক্ষিত চিকিৎসাব্যবস্থাকে ব্রাত্য করে অ্যালোপ্যাথি তথা মডার্ন মেডিসিনকেই ধ্রুব সত্য জ্ঞান করতে শিখিয়েছে। বিস্তারে সেই আলোচনা করার সুযোগ এ নিবন্ধে নেই – কিন্তু, বিজ্ঞানের একটি পথ ক্ষমতার অঙ্গ হয়ে উঠে বাকিদের কেমন করে প্রান্তিক করে দেয়, সে উদাহরণ বিজ্ঞানের ইতিহাসে অজস্র।
মোটকথা, প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য ব্যতিরেকে, অর্থসংস্থানের অভাবে গবেষণা থেমে থাকলে বহতা নদীতুল্য চিকিৎসাপদ্ধতি মজা ডোবায় পরিণত হয়। আর মেধার যোগানও কমে যায়। এদেশের অতীত গৌরবের আয়ুর্বেদও সেই পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে – হোমিওপ্যাথিও ব্যতিক্রম নয়।
তবে, বিজ্ঞানসম্মত একটি চিকিৎসাপদ্ধতির সম্মান পেতে গেলে, বিজ্ঞানের অন্তত সাধারণ নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। হোমিওপ্যাথি কি তার থেকে সরে আসছে না? আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত বা ইতিহাসগত কারণসমূহ তো নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ – কিন্তু, শুধুমাত্র সেটুকু নিয়ে পড়ে থাকলে, বা সেটিকেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ দিলে, মূলগত গলদের দিকটা প্রকাশ্যে আসে না।
ধরুন, একটি চিকিৎসা আদৌ কোনো কাজ করে নাকি করে না, সেটা যাচাই করে দেখার পদ্ধতি ঠিক কী? এতদিনে আমরা জেনেছি, ওষুধে কোনো কার্যকরী উপাদান না থাকলেও রোজ একটি করে ক্যাপস্যুল খেলেও আপনি অনেকখানি সুস্থ বোধ করতে পারেন – স্রেফ একটি ওষুধ খাচ্ছেন এই শান্তিতেই – যাকে পরিভাষায় বলে, প্লাসিবো এফেক্ট। নতুন ওষুধ এলে, প্রথমেই যাচাই করে দেখার দস্তুর – আদপেই ওষুধটা প্লাসিবো এফেক্টের চেয়ে বেশী কার্যকরী কিনা। এই যাচাইয়ের সবচেয়ে বেশী স্বীকৃত পদ্ধতি র্যাণ্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল। রোগীদের দুভাগে ভাগ করা হয় – একটি দল পান নতুন ওষুধ, অন্য দল প্লাসিবো – সাধারণত বিশ্লেষণের আগে ধরে নেওয়া হয়, এই দুই দলের ক্ষেত্রে ফলাফল শেষমেশ একই দাঁড়াবে, যাকে বলা হয় নাল হাইপোথিসিস। বিশ্লেষণের শেষে যদি দেখা যায় সেই নাল হাইপোথিসিস ভুল – অর্থাৎ প্রথম দলের রোগীরা বেশী তাড়াতাড়ি বা বেশী ভালো করে সুস্থ হচ্ছেন, তাহলে বলা যায়, ওষুধটা কাজের।
হ্যাঁ, আমিও মানি, র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোলড ট্রায়াল, ওরফে আরসিটি, বাদ দিয়ে জগত মিথ্যা, এও এক মৌলবাদ। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক সত্যিটা হল, এই মুহূর্তে এর চাইতে উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিও কিছু নেই।
আরসিটি-র যাথার্থ্য নিয়ে তাত্ত্বিক বা দার্শনিক অনেক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে – বিজ্ঞানের যেকোনো পদ্ধতি নিয়েই থাকে সেই বিরুদ্ধ মত – কিন্তু, আরসিটি-র যে সমস্যাটা আমাদের কাছে প্রায় জাজ্বল্যমান, সেটি মুখ্যত প্রায়োগিক। আরসিটি বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল পদ্ধতি – বর্তমান পরিস্থিতিতে যার নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই বৃহৎ বহুজাতিক পুঁজির হাতে। অতএব, আরসিটি এবং তদনুসারী এভিডেন্স-বেসড মেডিসিন-কে ব্যবহার করে কর্পোরেট পুঁজি চিকিৎসাব্যবস্থাটাকেই মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। তথাকথিত প্রমাণনির্ভর চিকিৎসার নামে চিকিৎসার প্রতি অংশে আজ ওষুধকোম্পানির আধিপত্য প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পাচ্ছে। এভিডেন্স-বেসড হওয়ার নামে চিকিৎসাই হয়ে উঠছে উত্তরোত্তর নৈর্ব্যক্তিক, আর এই পথে চলতে থাকলে কোম্পানীর মুনাফা ভিন্ন অপর কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই – এমনকি, এই নৈর্ব্যক্তিক মুনাফামুখী চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যক্তি-চিকিৎসকের মানবিক স্পর্শটুকুও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। বিকল্প মডেলের খোঁজ আমাদেরও প্রয়োজন।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকরা ও চিকিৎসকরা সেই সমস্যা নিয়ে বারবার সোচ্চার হচ্ছেন।
হোমিওপ্যাথির অবস্থান, স্বাভাবিকভাবেই, এই বহুজাতিক পুঁজির বাইরে – হোমিওপ্যাথি অনেক বেশী করে অসুস্থ মানুষটির সাথে খুঁটিয়ে কথাবার্তার কথা বলে – আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের চেয়ে বেশী সংলাপনির্ভর – অন্তত অনেকাংশে তো বটেই। কিন্তু, পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে হোমিওপ্যাথরা কীভাবে ভাবছেন? বিকল্প মডেলের দিশা কি তাঁদের হাতেও রয়েছে??
বিজ্ঞানের অপব্যবহার বা সঙ্কীর্ণ স্বার্থে বিজ্ঞানের ব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াতে পারে একমাত্র বিজ্ঞান-ই – সমাজমুখী ও জনকল্যাণের আদর্শে দীক্ষিত বিজ্ঞান। হোমিওপ্যাথির অবস্থান সেক্ষেত্রে ঠিক কী??
(চলবে)
মুনাফামুখী চিকিৎসা ব্যবস্থার কথাটা এখানে ভালো ভাবে উঠে এসেছে।
তাছাড়াও এখানে ‘প্লাসিবো এফেক্ট’ শব্দদুটোর সাথে পরিচিত হলাম।