“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য”
মহানগরী প্যারিস— বিত্ত আর প্রাচুর্য পেরিয়েও আবহমান সৌন্দর্য আর প্রেমের নীল পোস্টকার্ড সে। তারই দক্ষিণে এক ছোট্ট শহরতলী আরক্যুয়েল। বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভালোবাসাদের খোঁজ করতে করতে ল্যাপলাস অ্যাভিনিউ ধরে একটু হাঁটলেই দেখা মিলবে বিখ্যাত লোরেঞ্জি ওয়ার্কশপের। দেড়শ বছরের পুরোনো পারিবারিক ব্যবসা। বিভিন্ন শো-পিস আর আবক্ষ মূর্তিদের মধ্যে মূল আকর্ষণ হ’ল নিখুঁত মুখোশ। কে নেই সেখানে— নেপোলিয়ন, রোবসপিয়র, ভিক্টর হ্যুগো, বেঠোফেন থেকে শুরু করে জুলিয়াস সিজার, দান্তে! ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী জায়গা করে নেওয়া নামীদামী কবি, শিল্পী, রাজনীতিক আর দার্শনিক! তাদের পেরিয়ে বেস্টসেলার কিন্তু অন্য একজন। লা ইনকন্যু দে লা স্যেন— স্যেন নদীর অপরিচিতা!
আলব্যেয়ার কামু নাম দিয়েছিলেন স্যেন নদীর মোনালিসা। সে নামও তো ধার করাই। মুখোশের আড়ালে থেকে যাওয়া মুখটির আসল নাম আজও অজানা।
উনিশ শতকের শেষের দিকের কথা। স্যেন নদীর জল থেকে উদ্ধার করা হ’ল বছর ষোলর এক কিশোরীর দেহ। সারা শরীরে আঘাতের কোনও চিহ্ন নেই। অর্থাৎ আত্মহত্যা। কিন্তু দেহটির জন্য এগিয়ে এলো না কেউ। বিখ্যাত প্যারিস মর্গে রাখা হ’ল তাকে। বিশাল কাচের জানালার একদিকে ব্যস্ত ভালোবাসার শহর, উৎসাহী মানুষজন। অন্যদিকে নৈঃশব্দ্যের দিকে স্থির চলে যাওয়া সারি সারি মৃতদেহ। শেষ সময়ে যদি কেউ চিনে নেয়, আপন করে তাদের!
শায়িত কিশোরীটিকে দেখে গুঞ্জন ওঠে মানুষদের মধ্যে, কিন্তু কেউ আর এগিয়ে আসে না। সে অপ্সরাসম কোনও রূপসী নয়, তবু তার স্থির মুখশ্রীর ভেতর এক অজানা সম্মোহন আছে, সৌন্দর্য আছে, শান্তি আছে। ঠোঁটে লেগে থাকা আধখানা হাসি। সামান্য টোল-পড়া গাল। চিরতরে বুঁজে রাখা চোখ। দেখে মনে হয় তার গভীর ঘুমের ভেতর সবুজ বনে ঘেরা কোনও দেশে তারই জন্য পক্ষীরাজ ঘোড়া নিয়ে আছে অপেক্ষায় আছে তার রাজকুমার।
সেই অচেনা, নামহীন স্থির মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে অন-ডিউটি প্যাথোলজিস্টের মনের ভেতর কোন জাদু কাজ করে কে জানে, তিনি ডেকে পাঠান এক মুখোশ নির্মাতাকে। মেয়েটি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে তার মুখের একটা প্লাস্টার ছাঁচ থাকুক অন্তত। ক্রমে সেই মুখোশই ছড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স, জার্মানি হয়ে সমগ্র ইওরোপে। ছড়িয়ে পড়ে অভিজাত ড্রয়িং রুমের দেওয়াল হয়ে পিকাসোর স্টুডিও পর্যন্ত। শুধু কামু বা পিকাসো নয়, ঠোঁটের কোণে চিরকালীন স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে জেগে থাকা কিশোরী মুখ শেষ পর্যন্ত শিল্পের, কবিতার উপাদান হয়ে ওঠে আরও বহু নামীদামী মানুষের কাছে। রিলকে, লুই আরাগঁ, ম্যান রে, ভ্লাদিমির নবোকভ— কে নেই সেখানে! তাকে নিয়ে প্রেমের গল্প গড়ে ওঠে, আবার কখনও সে হয়ে ওঠে রহস্যঘেরা ছলনাময়ী। ধীরে ধীরে কাহিনী আর লোকশ্রুতির মাঝের দাগটা আবছাও হয়ে যায় কখন।
এমনিই একটি প্রচলিত গল্প হ’ল, কিশোরীটির জন্ম আসলে সুদূর লিভারপুলের এক হতদরিদ্র পরিবারে। তার এক যমজ বোনও ছিল। মেয়েটি এক ধনী ব্যবসায়ীর প্রেমে পড়ে পালিয়ে চলে আসে প্যারিসে। অবশেষে সেখানেই কিশোরী ভালোবাসা এবং দিনবদলের স্বপ্নের মৃত্যু। তারপর সে স্বেচ্ছায় বেছে নেয় বহতা নদীকে।
অনেক বছর পরে যমজ বোন একদিন প্যারিস ঘুরতে এসে হঠাৎ দেখে তারই অপরূপ সুন্দর হাসিমুখ ঝুলছে উপহার দোকানে। জীবন ততদিনে ন্যুব্জ করেছে তাকে। ঠোঁটের কোণে হাজার জটিল রেখা, চামড়ার ভাঁজে ক্লান্তি। চমকে ওঠে সে নিজেকে দেখে। তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে তার হারিয়ে যাওয়া বোনের কথা। ভালোবাসাহীন ক্লান্ত, জটিল এক পৃথিবীর ওপাশে সে নিজের অভিমান নিয়ে চলে গেছে বহুদিন হ’ল। তবু তার চিরকালীন প্রশান্তি, মুখের কিশোরী রোদ জেগে আছে আজও।
নাম না-জানা এক অখ্যাত, সামান্য কিশোরী তার মৃত্যুর পর ছড়িয়ে গেল একটা গোটা মহাদেশে, চিরজীবনের মত বেঁচে থাকল লোকগাথায়, শিল্পীর ইজেলে, কবির মনকেমনে— গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু রূপকথারা এভাবে শেষ হয় না।
কালটা ১৯৫৫, স্থান প্যারিস থেকে বেশ কিছুটা উত্তরে। নরওয়ের এক খেলনা প্রস্তুতকারক আসমুন্ড লারদাল। গত দেড় দশক ধরে তিনি বাচ্চাদের পুতুল, মডেল গাড়ি ইত্যাদি বানান। উপাদান মূলত কাঠ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে বাজারে এল এক নতুন উপাদান— প্লাস্টিক। আসমুন্ড মজেও গেলেন তাতে।
এর মধ্যেই একদিন আসমুন্ডের দু’বছরের ছেলে জলে ডুবতে ডবতে কোনওমতে বেঁচে যায়। আসমুন্ড ছেলেকে শুধু জল থেকে টেনেই তোলেননি, ছেলের ফুসফুস থেকে নিজেই চাপ দিয়ে বের করেন জল।
ঘটনাক্রমে এর মধ্যেই আসমুন্ডের সাথে যোগাযোগ করে অ্যানেসথেটিস্টদের একটি দল। পুরোভাগে অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত চিকিৎসক পিটার স্যাফার। তিনি সম্পূর্ণ নতুন এবং আধুনিকতম রূপ দিয়েছেন হৃদ-শ্বাস পুনরুজ্জীবন পদ্ধতির (সিপিআর)। তার গাইডলাইন মেনে সফলভাবে ফিরিয়ে আনা গেছে ঠান্ডা কাচের জানালার ওপাশে চলে যাওয়া অসংখ্য মানুষকে। এবার প্রয়োজন একটি ম্যানিকুইনের যার সাহায্যে চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ— সকলকেই শেখানো যায় সিপিআর পদ্ধতি। প্রায়োগিক কারণেই সেটি প্লাস্টিকের হ’তে হবে।
যাদুবাস্তবের কোনও এক অদৃশ্য তুলির টানে মিলে যায় অস্ট্রিয়া থেকে নরওয়ে, এক স্বনামধন্য চিকিৎসক এবং এক সামান্য খেলনা প্রস্তুতকারক।
কারণ আসমুন্ড এবার শুধু সামান্য একজন খেলনা প্রস্তুতকারী নন। অথবা ক্লায়েন্টের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে, যেন-তেন ভাবে প্রজেক্ট উতরে দেওয়া কোনও ব্যবসায়ী। তিনি দিন কয়েক আগেই মৃত্যুর মুখ থেকে নিজের সন্তানকে ছিনিয়ে আনা একজন বাবা, একজন শিল্পী, জীবন ফিরিয়ে আনার ম্যাজিক শিখতে চাওয়া একজন মনোযোগী শ্রোতা— জীবনই যাকে অবিস্মরণীয় হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
সিপিআর পদ্ধতিতে ছন্দ মেনে বুকে চাপ দেওয়ার পাশাপাশিই সময় মত মুখে মুখ দিয়ে পাঠাতে হয় শ্বাস। আসমুন্ডই বললেন, ম্যানিকুইনের মুখ হোক কোনও মেয়ের। পুরুষ প্রধান সমাজে তাহলে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে সে।
কেমন মুখ? কার মুখ? ক্যানভাস জুড়ে আবার ছুটে চলে যাদুবাস্তবের তুলি।
আসমুন্ডের হঠাৎ মনে পড়ে তার আত্মীয়র বাড়ির দেওয়ালে ঝুলে থাকা একটি মেয়ের মুখ। এত বছর পেরিয়েও সেই অদ্ভুত মায়া, সম্মোহন ভুলতে পারেনি সে। লা ইনকন্যু। অজানা কিশোরী। এবার সেই মুখ অভিজাত ড্রয়িংরুম আর কবির মনকেমনের পাতা থেকে স্থায়ী উঠে আসবে সিপিআর ম্যানিকুইনের মুখ হয়ে। নতুন নাম পাবে সে— রেসকিউ অ্যানি। বানানোর সাথে সাথে বিখ্যাত হয়ে উঠবে, নরওয়ের শ্রেষ্ঠ পুতুলের শিরোনাম জুটবে সে বছর।
পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় বিগত ছ’দশক ধরে রেসকিউ অ্যানির বুকে চাপ দিয়েই থেমে যাওয়া হৃৎপিন্ডকে আবার সচল করার পাঠ শিখেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তার ঠোঁটে ঠোঁট রেখেই শিখেছে জীবন ফেরানোর পাঠ। জীবনজুড়ে অভিমান যার সঙ্গী ছিল, আর মৃত্যুজুড়ে অপরিচয়— প্রশিক্ষণের অঙ্গ হিসেবেই দশক শতক পেরিয়ে লক্ষ মানুষ তাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে “Anne are you okay?” শুধু কি সাধারণ মানুষ? তাকে নিয়ে শিল্পীর উন্মাদনাও আবহমান যে— স্বয়ং মাইকেল জ্যাকসন তার বিখ্যাত Smooth criminal গানে ঠিক এই ফ্রেজ দিয়েই বারবার ছুঁতে চেয়েছেন তাকে।
হৃদ-শ্বাস পুনরুজ্জীবন এমনই একটি পদ্ধতি যার জন্য উন্নত যন্ত্র, জটিল প্রযুক্তি অথবা নামের পাশে ভারী ভারী ডিগ্রির কোনওটিরই প্রয়োজন হয়না। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত সিপিআর পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন অন্তত কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষ।
অবিশ্বাসীরা বলেন, লা ইনকন্যু আসলে বাস্তব ছাপিয়ে যাওয়া একটি কিংবদন্তী। জলে ডুবে মৃত্যু হওয়া কারোর চোখমুখ কিছুতেই এরকম হওয়া সম্ভব নয়। অনেক ঘেঁটেও তৎকালীন পুলিশি নথিতে এরকম কারোর খোঁজ পাওয়া যায় না। তবু আরক্যুয়েল থেকে লিভারপুল, আলব্যেয়ার কামু থেকে মাইকেল জ্যাকসন পর্যন্ত বিস্তৃত একটা স্থান- কালের মধ্যে স্পষ্ট বেঁচে থাকে নামহীন সেই কিশোরী। বাঁচিয়ে রাখে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষদের।
একদিন চিরতরে থেমে যাওয়া যে হৃদপিন্ড সচল করার কোনও উপায় ছিল না, আজ সেইই মানুষকে শিখিয়ে যাচ্ছে বীজমন্ত্র; বেঁচে থেকে যে ঠোঁটে ভালোবাসার আঙুল ছোঁয়নি, মৃত্যুর দশক- শতক পরে তাতে ঠোঁট রাখছে লক্ষ মানুষ; যে কিশোরী মৃতদেহের কোনও পরিচয় জোটেনি আজ তাকেই চেনে একটা গোটা পৃথিবী— বোধের অতীত পড়ে থাকা এই ম্যাজিক আসলে আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের জীবন দিয়ে বিশ্বাস করতে চাই, আগলে রাখতে চাই দু’হাতের ভেতর। জীবন ফিরে পাওয়া জ্যোৎস্নার নীচে ভেবে উঠতে চাই লা ইনকন্যুই আসলে জীবনানন্দের বনলতা।
এ পৃথিবীতে যতদিন মানুষ তার সহযাত্রী মানুষকে হিমশীতল মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে, ততদিন অফুরান কবিতার মতো বেঁচে থাকবে স্যেন নদীর নামহীন কিশোরী।
Osadharkn ekti lekha porlam sir. Kaler kalantore hariye jaoa kono ek golpo jeno punorjjibito hoyeche ❤️