১
রাতে খেতে বসে শ্রীপর্ণ বলল, “মিনি, একবার গ্রামের বাড়িতে যাবে?”
মিঞ্জিরি চমকে গেল। বারো বছরের বিয়েতে শ্রীপর্ণ গ্রামের বাড়ির কথা-ই বলেনি কোনও দিন, যাবার কথা দূর অস্ত্। আজও মাঝে মাঝে তামাশা করে বলে, “যদি নতুন বিয়ের পরে ‘তোমার ছোটোবেলার ছবি দেখব’ বলে আবদার না করতাম, তাহলে হয়ত কোনও দিন ওবাড়ির কথা জানতেই পারতাম না।” বিয়ের পরে পরে জোর করেই গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল শ্রীপর্ণকে। তিন দিনের বিশ্রাম মোটেই বিশ্রাম হয়নি। প্রতি মুহূর্তে গ্রাম্য জীবনে, গ্রামের বাড়িতে আরাম আর স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবে শ্রীপর্ণ এমনই অস্বস্তি আর বিরক্তি প্রকাশ করেছিল, যে চার দিনের দিন শহরের ফ্ল্যাটে ফিরে একরকম হাঁপ ছেড়েছিল মিঞ্জিরি। শ্রীপর্ণর সারাক্ষণের নালিশ বাদে ওর অবশ্য খুব খারাপ লাগেনি। খোলা হাওয়া, সবুজের সমারোহ, ভোরবেলার পাখির ডাক আর সন্ধের ঘনিয়ে আসা আঁধারে নদীর তীরে বসে সূর্যের আলোর মুছে যাওয়া ওর ভালো লাগে। বাড়িটাও, মাটির দালান যদিও, বেশ বড়ো। হাত পা ছড়িয়ে থাকা যায়। কিন্তু ফিরে আসার পরে কয়েক সপ্তাহ ধরে গ্রাম্য জীবনের নানা অসুবিধার কথা শ্রীপর্ণ এমন ফলাও করে বলেছে — থাকার অস্বাচ্ছন্দ্য, রাস্তাঘাটের অভাব, গাড়িটাকে পর্যন্ত গাছতলায় পড়ে থাকতে হলো — শীতে মশা, গ্রীষ্মে গরম, বর্ষায় কাদাভরা রাস্তাঘাট, শরতে গ্রাম্য পুজো… অজুহাতের প্রাচুর্যে মিঞ্জিরিও আর ফিরে যাবার কথা বলেনি।
তাই খাবার মুখে তুলতে গিয়ে থমকে গিয়ে মিঞ্জিরি বলল, “কী বললে? আবার বলো?”
হেসে ফেলল শ্রীপর্ণ। বলল, “প্যাঁক দেবার কোনও দরকার নেই। সত্যিই ভাবছি।”
আবার খেতে শুরু করে মিঞ্জিরি বলল, “বেশ, শুনি কী ভাবছ।”
শ্রীপর্ণ বলল, “দেখো, রিটায়ারমেন্টের বয়স আরও না পেছোলে আমার কর্মজীবন আর একুশ বছর। তোমার কুড়ি। এখন অবধি ভালোই আছি… তোমার চাকরির কল্যাণে শহরের পশ্ এলাকায় এই বিরাট ফ্ল্যাট। কিন্তু নিজের ট্যাঁকের টাকায় ফ্ল্যাট কিনে থাকতে গেলে শহরতলী ছেড়ে নতুন গড়ে ওঠা বসতিতে যেতে হবে। তাই না?”
তাই। এবং সেজন্যই শহরপ্রেমী শ্রীপর্ণর এখনও নিজের বাড়ি নেই।
“তাহলে, সেই যদি এই বাজার-হাট-মল্-আড্ডা ছেড়ে দিকশূন্যপুরেই যেতে হয়, তাহলে কেন গ্রামের বাড়িতেই ফিরে যাই না?”
“ওই বাড়িতে?” অবাক হয়ে আবার খাওয়া থামাল মিঞ্জিরি। “এত দিন তো বলতে, আদ্যিকালের বাড়ি, ছোটো ছোটো ঘর, অ্যাটাচড বাথরুম-টয়লেট নেই…”
এবার উৎসাহিত হয়ে বাঁ-হাতে টিভির রিমোটটা তুলে নিল শ্রীপর্ণ। বলল, “সেটাই বলছি। তোমার মনে আছে, আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুরের ওপারে চৌধুরীদের জমিদারবাড়ি?”
আছে। বারো বছর আগে দেখা শ্বশুরবাড়ির পেছনের পুকুরের ওপারে প্রতিবেশীর বাড়ির কথা মনে থাকার একাধিক কারণ আছে। “সেখানে কী হয়েছে?”
রিমোটের বোতাম টিপে টিভি চালু করল শ্রীপর্ণ। ফুটে উঠল একটা এমন অদ্ভুত ছবি, যে মিঞ্জিরি একেবারে হাঁ হয়ে গেল। সামনে, যাকে বলে ফোরগ্রাউন্ডে একটা গ্রামীণ পুকুর। তার ওপারে, গাছের ফাঁকে ফাঁকে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা কোনওভাবেই এদেশি গ্রাম্য বাড়ি নয়।
খাওয়া মাথায় উঠল। কুড়িটারও বেশি ছবি পাঠিয়েছে শ্রীপর্ণর খুড়তুত দাদা। শ্রীপর্ণ সেগুলোকে মোবাইল থেকে স্ক্রিন-কাস্টিং করে টেলিভিশনে দেখাল। বলল, “একদম মডার্ন — চৌধুরীদের মেয়ে বানিয়েছে। ওই শানু। ও নাকি অ্যামেরিকায় থাকত। এখন গ্রামের বাড়িতে এসে থাকবে।”
মিঞ্জিরি অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু জিতুদা এই ছবি পেল কোত্থেকে?”
“হোয়াটস-অ্যাপে। গ্রাম থেকে চিতু ছবি তুলে ওকে পাঠিয়েছে, আর ও পাঠিয়েছে আমাকে।”
`চিতু শ্রীপর্ণর আর এক খুড়তুতো ভাই। গ্রামেই থাকে। জমিজমা দেখাশোনা করে। শ্রীপর্ণ বলেছিল, ছোটোবেলা থেকেই নাকি ওকে সবাই বোকা বলত। পড়াশোনা হয়নি, তাই। তবে শ্রীপর্ণ মনে করে চিতুর বুদ্ধি কম নয়। পড়াশোনায় ইন্টারেস্ট ছিল না, তাই স্কুলের গণ্ডী পেরোতে পারেনি। মিঞ্জিরিরও তাই মনে হয়েছে। গ্রামে বড়ো হওয়া তিন ভাইয়ের মধ্যে জিতু ছিল পড়াশোনায় সবচেয়ে উজ্জ্বল। ও এখন কানাডায় ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, শ্রীপর্ণ (ডাক নাম শীতু) পড়াশোনায় মাঝারি — দেশেই কলেজে পড়ায়, আর চিতু গ্রামের বাড়িতেই থাকে, জমিজমার দেখাশোনা করে।
ফোন বন্ধ করে খাবার থালায় মন দিল শ্রীপর্ণ। বলল, “শানুরা নাকি ফিরেছে দেশে। বাড়ি বানিয়ে গ্রামে গিয়ে উঠেছে।”
“ও, প্রাক্তন প্রেমিকা এখন গ্রামে? সেইজন্যই দেশের বাড়ির প্রতি টান বেড়েছে হঠাৎ?”
শ্রীপর্ণর চোখে এখন চালশে। খেতে বসে চশমা লাগে। অর্ধচন্দ্র রিডিং-গ্লাসের রেলিং টপকে তাকাল মিঞ্জিরির দিকে। মনে রেখেছে মিঞ্জিরি। শ্রীপর্ণদের স্কুলে পড়ার বয়সে বাংলার গ্রামে ছেলে-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল বিরল।
বিশেষত যেখানে একটা পরিবার এককালে জমিদার ছিল আর অন্য পরিবার সেই-কালে ছিল সে জমিদারেরই নায়েব। তবু, একই বয়সী, কাছাকাছি স্কুলে পড়া দু-জন প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে বা সাইকেলে একই সঙ্গে যাওয়া আসার সুবাদে বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। আর একটু বয়স বাড়ার পরে হয়ত সে বন্ধুত্বের অনুভূতিতে একটা রোমান্সের ছোঁয়াও ছিল। তবে সাহস, সময় আর সুযোগের অভাবে সে অনুভূতি সেখানেই থেকে গেছে। দুজনের বন্ধুত্ব সে বয়সে যেখানে পৌঁছেছিল, সে কথা তখন তাদের গুরুজনেরা জানতে পারলে তড়িদাহত হতেন সন্দেহ নেই, কিন্তু আজকের নিরিখে ‘কিছু’-ই হয়নি। শানুর সঙ্গে ওর সম্পর্কের প্রত্যেকটা কথা না জানলেও, এতটা মিঞ্জিরি জানে, তবু পেছনে লাগতে ছাড়ল না।
“যা ছিল তাকে প্রেমিকা হয়ত তখনকার দিনে হয়ত বলা যেত, কিন্তু আজ বলা যাবে না। বন্ধু ছিল। বেস্ট ফ্রেন্ড। তখন তো আর একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে তেমন ভাবে প্রেম হতে পারত না — তাই…”
মিঞ্জিরি বলল, “তবু, কিছু একটা ছিল তো।”
ছিল কিছু একটা। সমবয়সী একটা ছেলে মেয়ে বাড়ির নজর এড়িয়ে বন্ধু। বয়ঃসন্ধিতে বন্ধুত্বে রোম্যান্সের ছোঁয়া লেগেছিল। সে কথা কাউকে বলার উপায় ছিল না। তবে তার ঠিক পরেই দুজনের জীবন দু’দিকে মোড় নেয়। শ্রীপর্ণকে যেতে হয় শহুরে কলেজে পড়াশোনা করতে, শানু ভর্তি হয় স্থানীয় কলেজে। শ্রীপর্ণ চট করেই শহরের প্রেমে পড়ে, কলেজের তিন বছর পেরোতে না পেরোতেই গ্রামে ফেরা কমে যায়… পঁচিশ — না, প্রায় সাতাশ বছর হয়ে গেল, দু’জনের আর যোগাযোগ হয়নি। শানু কবে গ্রাম ছাড়ল, কবে দেশ — কিছুই জানে না শ্রীপর্ণ।
“তোমাদের তো শরিকী বাড়ি। সবাই রাজি না হলে বাড়ি ভেঙে নতুন করে বানাতে পারবে?”
কথাটায় শ্রীপর্ণর হাসি পেল। বাবারা তিন ভাই এক বোন। বাবা আর কাকারা মিলিয়ে ওরা তিন খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাই-ই উত্তরাধিকারী। বোন নেই। প্রবাসী পিসিও সন্তানহীন। বলল, “শরিক তো এখন আমরা মাত্র তিনজন। জিতুদারই আইডিয়া, পুরোনো বাড়িটা ভেঙে নতুন করে বানানো — শানুদের মতো। আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। চিতুর আপত্তি নেই। ও তো জিতুদার কথায় সবসময়ই রাজি। জিতুদা বলেছে, তিনটে উইং হবে — যাতে আমরা একসঙ্গে, এবং পৃথকান্নও থাকতে পারি। একেবারে মডার্ন কনস্ট্রাকশন। শানুদের মতো সাহেবি হবে কি না সেটা ঠিক করেনি এখনও। মানে শরিকরা সবাই রাজি।”
“আচ্ছা, শানুদের বাড়ি সম্বন্ধে গ্রামের লোকের কী মত? এত মডার্ন একটা কনস্ট্রাকশন দেখে কী বলছে তারা?”
মাথা নাড়ল শ্রীপর্ণ। অত জানে না। তবে আজকাল কি এরকম বিলিতি বাড়ি একেবারে অপরিচিত? গ্রামে তো এখন ইলেকট্রিসিটি আর ইন্টারনেট দুই-ই পৌঁছে গেছে। চিতুর কথায় বোঝা যায় ও অ্যামাজন প্রাইম আর নেটফ্লিক্স-টেটফ্লিক্সে মাঝেমাঝেই হলিউডের ছবি দেখে। এখন আর আগের মতো ব্যাক-অফ-বিয়ন্ড নয় ওদের গ্রাম।
২
আগের বারের মতো প্রায় সাত ঘণ্টা নয়, ঘণ্টা চারেকেই পৌঁছে গেল। চিতু উঠোনের গাছতলায় বাঁশের কাঠামোর ওপর পাতার ছাউনি দিয়ে গ্যারেজ বানিয়েছে। বলল, “এবারে তো আর তিন দিন থেকে দশ বচ্ছরের জন্য পালাতে পারবি না — বার বার আসতেও হবে, তাই…”
প্রায় ছ’মাস কেটে গেছে শ্রীপর্ণ আর মিঞ্জিরির প্রথম আলোচনার পরে। কাগজপত্রে কাজ এগিয়েছে অনেকটাই। জিতুদার আর্কিটেক্ট বন্ধু সুজন মাথাই দায়িত্ব নিয়েছেন। সুজনকে চেনে না শ্রীপর্ণ। এরা সব জিতুদার বড়ো বয়সের বন্ধু — অনেককেই বিদেশে গিয়ে চিনেছে জিতুদা। আজ হাতেকলমে কাজ শুরু। জমি মাপজোকের জন্য সুজনের কর্মচারীরা আসবে। জিতুদা চাইছে, তখন যেন অন্তত শ্রীপর্ণ থাকে — সবটা চিতুর ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
খিড়কির পুকুরে ডুব দিতে গিয়ে শানুর নতুন বাড়িটা দেখে চমকে গিয়েছিল, যদিও ছবিতে দেখা ছিল সবটাই। খিড়কির পুকুরের ওদিকের পাড়টাকেও যা করেছে, তাকে সাদা বাংলায় সৌন্দর্যায়ন বলে। শানু নাকি বাড়ি এসে চিতুকে বলে গেছে, ওরা যেন নিজেদের দিকটাকেও কিছু করে। গ্রাম্য খিড়কির পুকুর হলেও তাকে সুন্দর করতে তো আপত্তি নেই — স্নান, কাপড়-কাচা বন্ধ না করেও করা যায়। পুকুরটা নিয়ে কয়েক পুরুষ ধরে একটা আইনি সংঘর্ষ ছিল দু-পক্ষে। চৌধুরীদের জমিদারি থাকতেই শ্রীপর্ণদের পারিবারিক উত্থান হয় — শ্রীপর্ণর বাবার ঠাকুর্দা দাবী করেন পুকুরটা তাঁর। জমিদারের তখন পড়তি দশা, তবু জমিজমা বিক্রি করে মামলা করেন। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সেসব জমির-ও অনেকটাই নামে-বেনামে কিনে নেন শ্রীপর্ণর বাবার ঠাকুর্দা-ই। তারপরে সে মামলার দায়িত্ব এসে পড়ে শ্রীপর্ণদের ঠাকুর্দার ওপর। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। তারপরে শ্রীপর্ণদের বাবা-কাকারা আর মামলা চালিয়ে যেতে চাননি, নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন শানুর বাবা-ও। আর এই প্রজন্মের তিন ভাইয়ের দু’জনের তো জমিজমা নিয়ে অত মাথাব্যথাও নেই। তাই শানু যখন পুকুরের মালিকানা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য না করে কেবল চিতুকে প্রস্তাব দিয়েছিল, “তোমরা তোমাদের দিকটার দেখাশোনা করো, আর আমরা এ-দিকটা করব,” তখন জিতুদা লিখেছিল, “মেয়েটা তো ভালোই আইডিয়া দিয়েছে। মামলায় টাকাকড়ির ফালতু অপচয় না করে মালিকানাটা শেয়ার করলেই ঝামেলা চুকে যায়।”
অত হাজার মাইল দূরে থাকলে যায়। যে মানুষগুলোর এই জমি, আর এই পুকুরের ওপরেই সমস্ত পরিচিতি নির্ভর করছে তাদের যায় না। চিতু যেমন শ্রীপর্ণর পাশে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, “তোরা বললি বলেই আমি ছেড়ে দিলাম। নইলে…”
শ্রীপর্ণ ওদের দিকের ঘাটে দাঁড়িয়ে শানুদের দিকের ঘাটটা দেখছিল। নতুন ঘাট। পুকুরপাড়ও বাঁধানো। বাড়ির পেছনের জমির শেষে রেলিং। আগে এদিকে কোনও বাধা ছিল না, দুই বাড়ির মধ্যে অবাধে হেঁটে যাতায়াত করা যেত — অবশ্য যেত না কেউ-ই, এক মাঝে মাঝে, লুকিয়ে চুরিয়ে শ্রীপর্ণ ছাড়া। বাড়ির পেছনের বাগান নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না শ্রীপর্ণদের। শানুদের ফলের বাগানও দেখাশোনার অভাবে জংলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন শানুদের দিকটা দেখে মনে হচ্ছে যেন শহুরে প্রমোদকানন। বড়ো বড়ো আমগাছগুলো নেই। কিছু পেয়ারা আর বোধহয় সবেদা গাছ রয়েছে। আর ঘাসের গালচে। কিন্তু ওদের দিকটা আগের মতোই জঙ্গুলে রয়েছে। জিতুদার পরামর্শে চিতু আর শ্রীপর্ণও কথা দিয়েছে, বাগান না হোক, ওদের দিকের পুকুরপাড়টাও ওরা এমনভাবেই সাজিয়ে নেবে। পুকুরে চিরাচরিত কাজ — যেমন স্নান করা, কাপড় কাচা, বাসন মাজা আপাতত চলবে, কিন্তু শ্রীপর্ণদের বাড়িটাও যখন নতুন করে তৈরি হবে, সেখানেও বাথরুম, কলের জল, ইত্যাদির ব্যবস্থা হবে। তখন পুকুরের কাজ কমে আসবে — কেবল অভ্যাসে আর ব্যতিক্রম খুঁজতে পুকুরঘাটে আসবে কেউ কেউ।
জিতুদা লিখেছিল সুজন মাথাই শানুদের বাড়ির ছবি দেখে খুব হেসেছে। বলেছে নাকি এরকম বাড়ি এই আবহে বেমানান, টিঁকবেও না। এরকম আমেরিকাতেই হয়। শ্রীপর্ণদের বাড়ি এরকম হবে না। অনেক স্থানোপযোগী হবে, কিন্তু মডার্ন। সুজন ছবি দিয়েছে — বাংলার সাবেকি স্টাইলে তৈরি ওদের নতুন বাড়ির ভেতরে থাকবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে শানুদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শ্রীপর্ণর মনে হলো, বেমানান নয়। যদি এখানকার মাটিতে কোনও বাড়ি দাঁড়াতে না পারে, বা আবহাওয়ায় সহজে নষ্ট হয়, তাহলে অন্য কথা। নইলে যে বাড়ি আমেরিকায় মেপ্ল্, স্প্রুস্, সিডার, সাইপ্রেসের বাগানে থাকতে পারে, তাকে এই আম, জাম, কাঁঠাল, কৃষ্ণচূড়ার বাগানে তো বেমানান লাগছে না! কেবল অভ্যাস আর অনভ্যাসের ব্যাপার। এ দেশে এমন বাড়ি দেখে মানুষ অভ্যস্ত নয় — এই যা।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে পুরোনো সিন্দুক ঘেঁটে বাড়ির বা বাগানের কোনও প্ল্যান পাওয়া গেল না। মান্ধাতার আমলের গ্রাম্য দালান — তখন কি কেউ ব্লু-প্রিন্ট বানিয়ে বাড়ি বানাত? চিতু বেরিয়ে গেল। ওর এসব ব্যাপারে মন নেই, তা ছাড়া মাঠে কাজও আছে। শ্রীপর্ণ সিন্দুক থেকে নানা কাজের-অকাজের জিনিস তখনও বের করছে, এমন সময় মিঞ্জিরি এসে বলল, “কী গো, পুরোনো কাগজ ঘাঁটলেই চলবে? একবার ওদের বাড়ি যাবে না?”
মিঞ্জিরি শানুদের বাড়ি যাবার কথা বলছে। শ্রীপর্ণ বলল, “কেন? দরকার কী?”
মিঞ্জিরি চোখ কপালে তুলে বলল, “সে কী! এতদিনের পুরোনো বন্ধু — দেখা করতেও মন চাইছে না?”
চাইছে। কিন্তু অস্বস্তিও আছে। সে কেবল মিঞ্জিরির প্রতিক্রিয়ায় নয়, শানুরও একজন জীবনসঙ্গী রয়েছে। ওদের ছোটোবেলায় জমিদারবাড়ির সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না। দেখা হলেও মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়াই দস্তুর ছিল। একমাত্র শানু আর ও-ই সে দস্তুর ভাঙে।
তবে সত্যিই হয়ত না গেলে আরও বিসদৃশ দেখাবে। হাতের কাগজপত্র থেকে মুখ তুলে মিঞ্জিরির দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে শানুকে চাক্ষুস না দেখে তোমার মন মানছে না?”
মুখ ভেটকে, “আমার বয়ে গেছে, আমি তো আর যাচ্ছি না, তোমাকে যেতে বলছি,” বলে মিঞ্জিরি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
৩
সামনে মুখ ভেটকালেও, মিঞ্জিরি বিকেলে শ্রীপর্ণর সঙ্গেই তৈরি হয়ে নিল। শ্রীপর্ণ নিজের জন্য যে টি-শার্টটা বের করেছিল, সেটা সরিয়ে আমেরিকা থেকে আগেরবারে জিতুদার এনে দেওয়া নীল, সবুজ, মেরুন স্ট্রাইপ দেওয়া টি-শার্টটা বের করে দিল। আড়চোখে শ্রীপর্ণ লক্ষ করল, নিজেও না সেজেই সাবধানে সাজল। শাড়ি পরল, যদিও আসার আগে বলেছিল, “শাড়ি-টাড়ি নিয়ে কাজ নেই, কী বলো? বর্ষায় গ্রামে ম্যানেজ করতে পারব না।”
জমিদারবাড়ির রাস্তা অনেকটা ঘুরে। পেছন দিয়ে গেলে চট করে যাওয়া যায়, কিন্তু শ্রীপর্ণ সেদিকে গেল না। না জানিয়ে কারও বাড়িতে পেছন দিক দিয়ে ঢোকা উচিত না। মিঞ্জিরির সাদা শাড়ি আর সাদা জুতোর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে গাড়িটা বের করল।
বাইরের গেটও বদলেছে। এখন কায়দার স্লাইডার গেট। নিচে পাতা রেললাইনের ওপর গেটের চাকা থাকে, পাশাপাশি খোলে। উর্দিপরা দারোয়ান নয়, ফতুয়া আর খেটো ধুতি পরা মালি বাগানে কী কাজ করছিল, ছুটে এসে খুলে দিল। শ্রীপর্ণ জিজ্ঞেস করল, “দিদি বাড়িতে আছেন তো?”
মালি ঘাড় নেড়ে একগাল হেসে বলল, “শীতুদা, কতদিন পরে এলে! ভালো আছ তো?”
শীতু চিনতে পারল না। বলল, “আছি ভালো।” তারপরে ‘তোমরা’ আর ‘আপনারা’-র মাঝামাঝি একটা শব্দ করে জানতে চাইল, “…ভালো?”
মালি একগাল হেসে ঘাড় কাত করে বলল, “আমায় চিনলে না তো? হারান। ওই যে জেলেপাড়ার… বাবার সাথে তোমার বাড়ি মাছ নে যেতাম…”
ছোটো ছেলেটাকে আবছা মনে পড়ল শ্রীপর্ণর। বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা তোমাদের খবর কী? বাবা কেমন আছে?”
হারান মাথা নাড়ল। “ভালো নেইকো। এখন তো এস্টোক হয়ে বিছনা-শয্যা। শুয়ে-শুয়েই সবকিছু। মাছ টাছ আর ধরে না।”
“তুমিও না?”
“সকালে যাই নদীতে। তবে মাছ ধরে আর চলে না। তাই এখেনে…” বলে বাগানের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “শীতুদা, তোমাদের বাড়ি বানানোর কাজ শুরু হবে?”
শ্রীপর্ণ হেসে বলতে যাচ্ছিল, কত জায়গায় কাজ করবে, হারান? কিন্তু না বলে বলল, “হবে, কিন্তু সে এখনও দেরি আছে। আর সত্যি বলতে কী, কতটা কী কাজ হবে, তা আমিও জানি না।”
কাঁকড় বিছানো চওড়া গাড়ি-ঢোকার রাস্তাটা আধুনিক বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। হারান আগে আগে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে, শ্রীপর্ণ আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে বেরিয়ে মিঞ্জিরিকে সাহায্য করল কাঁকড়ের ওপরে হিল পরা চপ্পল সহ হাঁটতে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন একজন সুঠাম চেহারার ব্যক্তি — বয়সে শ্রীপর্ণর চেয়ে কিছু বেশিই হবেন, কিন্তু অনেক বেশি পেটানো চেহারা। একসময়ে কায়িক শ্রম করতেন, এখনও নিশ্চয়ই ব্যয়াম-ট্যায়াম করেন। হাত জোড় করে নমস্কার করে বললেন, “আসুন, আসুন।”
দেখতে যেন কাঠের ফ্লোর, কিন্তু চলতে গিয়ে কাঠের মতো লাগল না। দুটো সিঁড়ি উঠে বাড়িতে ঢুকতে হয়েছিল, তেমনই বাড়ির ভেতরের বড়ো ঘরের মধ্যেই দুটো সিঁড়ি নেমে একটা নিচু বসার ঘর — যাকে সাঙ্কেন লিভিং রুম বা ড্রইং রুম বলে। শ্রীপর্ণকে মেঝের দিকে তাকাতে দেখে ভদ্রলোক বললেন, “একেবারে আমাদের ওখানকার বাড়ির মতো করে বানিয়েছি। তবে ওখানে তো মেঝে হয় কাঠের — এখানে কাঠ দিয়ে ঠিক হবে না, তাই লুক-অ্যালাইক মেটিরিয়ালের তৈরি। ফাইবার না কী বলে…” শ্রীপর্ণ নিজের পরিচয় দিয়ে মিঞ্জিরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন — সোমেশ্বর নাথ। “আমি শান্তার হাজবেন্ড।” বসার ঘরে বসিয়ে ভেতরের দিকে গিয়ে গলা উঁচু করে বললেন, “শানু, এসো, দেখো কে এসেছে।” তারপরে ফিরে এসে বললেন, “আমরা ঠিক এরকম জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত নই — যদিও শানু এখানেই বড়ো হয়েছে — আমি তো শহরে মানুষ…”
“কোথায় থাকতেন ছোটোবেলায়?” ভদ্রতা করে জানতে চাইল শ্রীপর্ণ। একটু শ্রাগ করে সোমেশ্বর বললেন, “কোথায় না বলুন? জন্ম আর একেবারে ছোটোবেলা এলাহাবাদে। পড়াশোনায় মন ছিল না, বাবার মারের চোটে বাড়ি থেকে পালাই, তখন বয়স চোদ্দ। ক্লাস সেভেন। তারপরে কিছুদিন বম্বে, তারপরে সেখান থেকে জাহাজের খালাসীর কাজ নিয়ে দেশ ছাড়ি। প্রথমে কিছু বছর জাহাজে জাহাজে কাটে। তারপর সাউথ অ্যামেরিকায় — ব্রেজিল, আর্জেন্টিনা, সেখান থেকে মেক্সিকো হয়ে সোজা হাজির হই ক্যানাডায়। ইউ.এস.এ যাই সেখান থেকে। তারপরে ইউরোপে। জার্মানি, স্পেন, ইতালি, গ্রিস… কিছুদিন ইংল্যান্ডেও ছিলাম। তারপরে সব শেষে ব্রাসেলসে, তখনই আলাপ হয় শানুর সঙ্গে। তখন থেকে ভবঘুরেপনা শেষ।”
অবাক হয়ে মিঞ্জিরি বলল, “বাপরে! আপনি তো গ্লোব ট্রটার মশাই!”
আবার শ্রাগ করলেন সোমেশ্বর। “কই আর? গোটা আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া আর ফার ইস্ট-টা তো বাকি। আর সাউথ অ্যামেরিকাতেও বেশি দেশ দেখা নেই। সত্যি বলতে কী, সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছি ইউরোপেই… এই যে শানু… দেখো, ওই পুকুরের ওপারের বাড়ির — চিতুবাবুর দাদা এসেছেন…”
শ্রীপর্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। ষোলো বছরের যে মেয়েটা স্মৃতিতে আঁকা ছিল, এই মহিলার সঙ্গে তার অনেক তফাত। গোলগাল শানু এখন ছিপছিপে — প্রায় অ্যাথলিটের মতো চেহারা। শ্রীপর্ণ একগাল হেসে বলতে যাবে, তোর চেহারাটা তো একেবারে সাংঘাতিক বানিয়েছিস রে… বা ওরকম কিছু, কিন্তু ওকে অবাক করে শানু দু’হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, “আপনারা তো আজই সকালে এলেন, না? হারান বলছিল, ও বাড়ির মেজোভাই এসেছে।”
পাশে বসা মিঞ্জিরির ভুরু কুঁচকে গেল। শানু আগেই জেনেছে মেজোভাই, আর তারপরেও হাত জোড় করে নমস্কার, আপনি সম্বোধন? শ্রীপর্ণ অবাক হয়ে বলল, “শানু, আমি শীতু।” শ্রীপর্ণর হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে এক লহমা থমকে গেল শানু। চট করে একবার চেয়ে দেখল সোমেশ্বরের দিকে। তারপরে হাসল। বলল, “ও, হ্যাঁ, তাই তো! আসলে আমি এতদিন গ্রামছাড়া, যে কাউকে মনে নেই আর।” তারপর সোমেশ্বরের পাশে বসে বলল, “ও তো বলে, তোমাকে নিয়ে গ্রামে ফেরাটা এত এম্ব্যারাসিং হবে জানলে…” মিঞ্জিরির চোখে পড়ল সোমেশ্বর পাথরের মতো স্থির দৃষ্টিতে শানুর দিকে তাকিয়ে। শানু এবার সোমেশ্বরের পাশে বসে খেলাচ্ছলে কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলা দিতে সোমেশ্বর একটা কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, “ভাবুন, এত ভুলে যায় মানুষ — হতে পারে?”
মিঞ্জিরির মনে হলো, হতে পারে না। আরও কিছু আছে। আড়চোখে শ্রীপর্ণর দিকে তাকিয়ে দেখল ও-ও অবাক হয়ে শানুর দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ শানুর রি-অ্যাকশন স্বাভাবিক নয়। এর মধ্যে আর কী আছে, সেটা জানতে হবে।
আড্ডা জমল না। কিছুক্ষণ প্রায় কেবলই কাজের কথা হলো। শানুরা শ্রীপর্ণদের মতন আগের বাড়ির জায়গাতেই নতুন বাড়ি বানায়নি। পাশের খালি জমিতে বানিয়েছে। “পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ফেলব, জানেন,” বললেন সোমেশ্বর। “আর কিছু করা যাবে না। আর্কিটেকচারাল ভ্যালু নেই, থাকাও যাবে না। ভেঙে বাগান করলে তবু দেখতে ভালো লাগবে।” তারপরে পেছনের পুকুরের ঘাট কেমন হবে, পাড় কী ভাবে বাঁধানো হবে — এ সব আলোচনা হলো। দুই বাড়ির জমি গায়ে গায়ে নয়, মাঝের কয়েক গজ সরকারি জমির মাপ নিয়ে আলোচনা দরকার। কিছুক্ষণ পরে দুজনে উঠে পড়ল। গল্প তেমন হলো না বটে, তবে মানতে হলো, জমিদারকন্যার বাড়ির চা সাধারণ গ্রাম্য চা নয়, চমৎকার সুগন্ধী চা। শহর থেকে আনা।
যাবার আগে ওরা শানুর পিসির সঙ্গে দেখা করে গেল। নামেমাত্র দেখা। অতিবৃদ্ধা পিসি আগেও শ্রীপর্ণকে চিনতেন না, এখন তো কাউকেই চেনার অবস্থায় নেই। শানু বলল, “ও বাড়িতে যে ঘরটায় থাকতেন, দেখে কান্না পায়। আলো নেই, হাওয়া নেই… তারই মধ্যে বিছানায় শুয়ে রয়েছেন রাত দিন। দেখাশোনা করার জন্য একটা মেয়ের বন্দোবস্ত করা ছিল, সে তো হয়ত মাঝেমধ্যে কয়েক দিন আসতই না। খেতে পেতেন কি না, বাথরুম-টাথরুম… এখানে এনে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছি…”
বেরোবার সময় গাড়ি পর্যন্ত এসে বলল, “আসবেন আবার, আছেন তো ক’দিন।” তারপরে মিঞ্জিরির হাত ধরে বলল, “তুমিও ভাই সময় পেলে চলে এসো। আমরা এখন রিটায়ার্ড, প্রায় কখনওই বাড়ি থেকে বেরোই না। একা একা বোর লাগে — একটু গল্প করে সময় কাটাব।”
ক্রমশঃ (পরবর্তী অংশ আগামী রবিবার)
অসাধারণ।অপেক্ষা করছি।