রাত জেগে পরীক্ষাগারে কাজ করছিলেন একটু ছিটগ্রস্ত বিজ্ঞানী বিলহেল্ম। বহু কষ্টে কলেজ পালানো এই বিজ্ঞানী কাজ পেয়েছেন জার্মানীর ভুর্জবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি সামান্য মতান্তরে জড়িয়ে ডিপ্লোমা শেষ হওয়ার আগেই হল্যান্ডের উট্রেখট্ বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয় তাকে।
রোজ রাতে পদার্থ বিভাগের ঘরগুলো ফাঁকা হয়ে গেলে ল্যাবরেটরীতে কাজ শুরু করেন তিনি। ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে তাঁর খুব উৎসাহ। এইসব ভুলভাল বিষয়ে রাতবিরেতে কাজ করার জন্য তাঁর সহকর্মী এবং অধস্তন-রা যারপরনাই বিরক্ত তাঁর উপর।
আরে! ক্যাথোড রে এত দূর পর্যন্ত যায় না তো! কি করে গেল? শুধু তাই নয়, এ তো তাঁর ‘ক্রুকস’ টিউবের কাঁচের দেওয়াল, কালো কাগজ ও কার্ডবোর্ডের আবরণী ভেদ করে নয় ফুট দূরে প্ল্যাটিনোবেরিয়াম পর্দার উপরে সবুজ আভা সৃষ্টি করেছে। অদ্ভুত! এ তো তাহলে নতুন কোনো রশ্মি!
দেখা গেল মোটা কাঠের দেওয়ালও ভেদ করে যেতে পারে এই রশ্মি। দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল মনে। মানুষের শরীরের ভেতরটা তো দেখা যেতে পারে এই দিয়ে! দুষ্টুবুদ্ধির অভাব তার কোনদিনই ছিল না অবশ্য। ওইজন্যই তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল উট্রেখট্ থেকে।
বাড়ি গিয়ে স্ত্রী বার্থাকে খুলে বললেন সব। আর কাউকে পাওয়া যাবে না যার শরীরের ছবি তোলা যায়। সহকর্মী বা অধস্তন-দের বললে আত্মসাৎ হয়ে যেতে পারে এই আইডিয়া।
বার্থা এককথায় রাজী। নতুন আবিষ্কারের নেশায় ঘুম ছুটল দম্পতির। কয়েকদিনের মধ্যেই ল্যাবরেটরীর ছোটখাটো পার্টস দিয়ে বানিয়ে ফেললেন এক যন্ত্র যা দিয়ে এই নতুন রশ্মি তৈরী করা যায়।
সেদিনটা ছিল শুক্রবার, ৮ই নভেম্বর, ১৮৯৫। সপ্তাহের শেষ। বিশ্ববিদ্যালয় একটু বেশীই ফাঁকা। বার্থা-কে নিয়ে ল্যাবরেটরীতে ঢুকলেন বিলহেল্ম। স্ত্রী বার্থা-র হাতটা যন্ত্রের সামনে রেখে সুইচ টিপতেই ক্রুক টিউব থেকে বেরিয়ে আসা রশ্মি বার্থার হাত ভেদ করে ফটো প্লেটে গিয়ে পড়ল। তৈরি হল হাতের নতুন ধরণের ছবি। তাতে চামড়া, মাংসপেশী নেই। শুধুমাত্র হাতের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু একি! উত্তেজনায় বিয়ের আংটি-টা খুলে রাখতে ভুলে গেছিলেন বার্থা। আঙুলের হাড়ের সাথে আংটির ছবিও উঠে গেল। যাকগে! এই ছবিই থাকুক।
আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে দেড় মাস বাদে ভুর্জবুর্গ ফিজিও-মেডিক্যাল সোস্যাইটি-তে প্রথম প্রকাশিত হল তাঁর গবেষণাপত্র “On a new kind of Rays”। লেখক পদার্থবিজ্ঞানী বিলহেল্ম কনরাড রোয়েন্টজেন। পরের জানুয়ারিতে ওই সোস্যাইটিতেই এক মিটিং-এ জনসমক্ষে এক শারীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞের হাতের ছবি তুলে দেখালেন বিলহেল্ম।
তাঁর আবিষ্কৃত নতুন রশ্মির নামকরণ হল এক্স-রে। এই নিয়ে জার্মানী ও ইউরোপে সাধারণ মানুষের মনে অভূতপূর্ব উৎসাহের সৃষ্টি হল। এই অদ্ভুত ছবি সম্বন্ধে খবরের কাগজগুলোতে নিয়মিত লেখালেখি হতে থাকল। এমনকি এক্স-রে ছবি তোলার স্টুডিও পর্যন্ত চালু হয়ে গেল।
দ্রুত আমেরিকাতে পৌঁছে গেল এই আবিষ্কারের খবর। টমাস এডিসন আমেরিকায় বানিয়ে ফেললেন এক্স-রে যন্ত্র। ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রথম কোনো হাসপাতালে ব্যবহৃত হল এই নতুন রশ্মি। আমেরিকার ডার্টমাউথে এক রোগীর ভাঙ্গা হাতের ছবি তুললেন এডোয়ার্ড ফ্রস্ট।
সেই থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার অভিমুখই বদলে দিল আশ্চর্য এই আবিষ্কার। চিকিৎসকরা রোগনির্ণয়, গবেষণা এবং অপারেশন করার সময় সাহায্য নিতে থাকলেন এক্স-রে যন্ত্রের।
১৯০১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন বিলহেল্ম কনরাড রোয়েন্টজেন। তার সাথে কালজয়ী হয়ে রইল স্ত্রী বার্থা-র বিয়ের আংটি পরা হাতের পৃথিবীর প্রথম এক্স-রে ছবি। বিলহেল্ম কিন্তু নোবেল পুরস্কারের সব অর্থ দান করে দিয়েছিলেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
যাতে সস্তায় এবং সহজে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে, তাই এই আশ্চর্য্য আবিষ্কারের পেটেন্ট পর্যন্ত নেননি বিলহেলম রোয়েন্টজেন।
তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও স্প্যানিস-ফ্লু মহামারী সবে শেষ হয়েছে। ১৯২৩ সালে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় তিনি মারা যান।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
——————-
১. আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি
২. ডয়েশ মিউজিয়াম, মিউনিখ, জার্মানী