মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। যে রকম রোজ যায় দু তিনবার প্রতি রাত্রে। ভেঙে গেল বলা ভুল। ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল মোবাইল। ওতে একটা কর্কশ রিং টোন লাগিয়েছে সে নিজেই। প্রতি রাত্রেই রাতজাগা কেউ না কেউ, হয় পেশেন্ট নয় পেশেন্ট পার্টি।
হাতের মোবাইলের দিকে তাকানো ক্লান্ত ভবতোষ ডাক্তার চোখ বুজে সামান্য ভাবল। এই যন্ত্রণাময় যন্ত্রটার হাত থেকে তার কি মুক্তি নেই? সে পেশেন্টদের এইসব ফোন ধরতেই থাকবে? ধরেই চলবে?
সেই কবে মেডিকেল কলেজ থেকে বেরিয়েছে। তত সাফল্য পায়নি সে পেশাগত জীবনে। কলেজে ঢোকার সময়ে ভেবেছিল, চিকিৎসা বিজ্ঞানী হবে। পারেনি। অন্য অনেকেই যা হয়েছে, হতে পেরেছে… সেই চিকিৎসা ব্যবসায়ীও হতে পারেনি। সামান্য মেধা নিয়ে অসামান্য কিছুই হওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে শুধুই এক পাতি চিকিৎসা কর্মী মনে করে নিজেকে। ভবতোষ উদ্যমহীন, হয় তো নিজের উন্নতি করার ব্যাপারে কিছুটা অলসও।
নিজের উদ্যোগে তেমন কিছু করার চেষ্টা করেনি সে। যদিও বন্ধু বান্ধব আত্মীয়রা বলেই চলেছে কানের কাছে,
– ভব, কষ্ট করে শেখা বিদ্যেটা অবহেলা কোরো না। প্র্যাকটিশটা করো। বেশি করতে না চাও, অল্প করো।
ভবতোষ উৎসাহ পায় না। সব কেমন যেন পালটে যাচ্ছে চারপাশে। মেডিকেল সাবজেক্টটাও। এখন নাকি সবই এভিডেন্স বেসড মেডিসিন। এভিডেন্স মানে ইনভেস্টিগেশন। পুরোনো ক্লিনিকস যা স্যারেরা শিখিয়েছিলেন, তার জায়গায় রাশি রাশি ইনভেস্টিগেশন।
সেই এভিডেন্স তিলে তিলে জোগাড় হবে পেশেন্টেরই পয়সায়। এভিডেন্স জোগাড়ের বদলে পারিতোষিক চারপাশে লোভের হাতছানি। এ যেন ভিশাস সাইকল।
নতুন ওষুধ বেরোচ্ছে রাশি রাশি। একগাদা করে দাম। ভবতোষ ভেবে কুল পায় না। এই সব ওষুধের তথ্য ডাক্তারের কাছে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় হচ্ছে ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটেটিভরা। ভবতোষের কাছে তারাও আসে না। তার প্র্যাকটিশের জেল্লা কম, তাই।
তার মত একটেরে পড়ে থাকা চিকিৎসককে নতুন তথ্য জানানোর জন্য কোনও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেই। যে কোন মলিকিউলের ইনোভেটর ব্র্যান্ড নাকি জেনেরিক ব্র্যান্ডের চেয়ে বেটার কাজ করে। এক সমুদ্র ব্র্যান্ডের মধ্যে কোন ব্র্যান্ড ইনোভেটর সে জানবে কী করে?
অতি জটিল এক পরিস্থিতি যা হোক।
মাঝে স্যারের অতি প্রিয় ছাত্র বুদ্ধদার সঙ্গে দেখা হল। ক্লিনিকসে খুব স্ট্রং ছিল। মেডিসিনের হেড ডিপ হয়ে রিটায়ার করেছে। তাকে জিজ্ঞেস করল।- বুদ্ধদা, তোমরা কেন, স্যারেরা যেমন তোমাদের তৈরি করেছিলেন, সেই রকমের ক্লিনিকস ওরিয়েন্টেড ছাত্র তৈরি করতে পারলে না?
নির্বিকার ভাবে বুদ্ধদা বলল, – কথাটা ঠিকই। করিনি। কী জানিস, ঝেড়ে ইনভেস্টিগেশন করালেই সব অসুখ ধরা পড়ে যায়। কী দরকার, পেশেন্টের পেছনে অত টাইম দেবার? এটা ধরে নে টাইম ম্যানেজমেন্টেরই পার্ট। তা ছাড়া সলিড প্রমাণও রইল। ক্লিনিকস ব্যাপারটা ভাল, কিন্তু সাবজেক্টিভ। এটা তো মানবি, সিপিএর যুগে?
ক্লাসমেট অনিরুদ্ধ নাকি দিনে আশি থেকে একশোটা পেশেন্ট দেখে। খুব শার্প ছেলে।
ক্লাস মিটে দেখা হল। সিংগল মল্টের গেলাস হাতে বলল, ‘’একদিন আমার চেম্বারে এসে দেখে যা। পার পেশেন্ট এক থেকে দেড় মিনিট। হিস্ট্রি নিচ্ছে একজন। বিপি আর ওয়েট মাপছে অন্য আর একজন। এতে তো কী যেন বলে কর্মসংস্থানও হচ্ছে, তাই না?
কথাগুলো বলেই চালাক চালাক হাসে অনিরুদ্ধ।
ও নিশ্চয়ই টাইম ম্যানেজমেন্ট খুব ভালো শিখেছে। ভবতোষ নিজে টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখতে পারেনি।
এই সব তালেগোলে ভবতোষের মাথা পাগল পাগল লাগে। একটা পেশেন্ট দেখতে তার সময় লাগে বেশি। স্যারেরই মতন আধঘণ্টা বা তারও বেশি সময়। লাগবেই। সেই পুরোনো শেখা নিয়মে, হিস্ট্রি টেকিং, ইনস্পেকশন, প্যালপেশন, পারকাশন, আর স্টেথোস্কোপ দিয়ে অসকালটেশন। হিস্ট্রি নেওয়াতেই সময় যায় অনেক।
আর সেই অল্প কজন দেখা পেশেন্ট আর তাদের বাড়ির লোকজন চেম্বারে তো বটেই বাড়িতেও এই মোবাইলে তাকে কথা বলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পরিত্রাণের উপায় দেখতে পায় না ভবতোষ।
ভোররাতে বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে চারপাশটা। মনোরম সেই ঊষামুহূর্তে স্যার এলেন ফিরে আসা ঘুমের স্বপ্নে।
– ভবতোষ, বিরক্ত?
– বিরক্ত না স্যার, ক্লান্ত। সারাদিন এত কথা শুনতে শুনতে ভারি ক্লান্ত।
– তুমি আসলে কে ভবতোষ? কী তোমার জীবিকা? আদৌ কি একটাও পেশেন্টকে তুমি নিরাময় করতে পারো?
আচমকা প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় সে। এমনিতেই স্যারের সামনে চূড়ান্ত অপ্রতিভ থাকত সেই হাউসস্টাফশিপের সময়েও।
উত্তর দিতে গিয়ে তো তো করতে থাকে। স্যারই ধরিয়ে দেন পরের কথা।
– শোনো, তুমি আসলেই কাউকে নিরাময় দাও না। পেশেন্টের সিস্টেম সারে নিজে নিজেই। তুমি সাহায্য কর, পরিচর্যা কর মাত্র। তুমি যা দাও তা হল শুশ্রূষা। তোমার শুশ্রূষায় সে আস্তে ধীরে সেরে ওঠে। তোমার জীবিকা স্বাস্থ্য বিক্রি নয়, তোমার কাজ শুশ্রূষা। শুশ্রূষার মানে কী মনে আছে তো, ভবতোষ?
স্বপ্নের মধ্যেই আবছা মনে পড়ে। সেই কবে, স্যার ওয়ার্ডে বলেছিলেন শুশ্রূষা শব্দটার মানে ডিকশনারি থেকে দেখতে। দেখেওছিল।
পরিচর্যা আর সেবা শুধু নয়। ডিকশিনারিতে দেখেছিল শুশ্রূষার অন্য মানে শোনার ইচ্ছা।
ঘুম ভাঙার পর মগ্নচৈতন্য থেকে উঠে আসা স্বপ্নটা মনে পড়ে লজ্জিত ভবতোষের।
সত্যিই তো। সে টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখতে চেয়েছিল।
কিন্তু না। তার আসল কাজ তো শুশ্রূষা। শোনার ইচ্ছা।
টাইম ম্যানেজমেন্ট নয়, অনুসন্ধিৎসু ডাক্তারকে তন্ন তন্ন শুনতেই হবে রোগী আর তার বাড়ির লোকের কথা। সেটাই প্রকৃত শুশ্রূষা।
★