করোনার সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ের আগে সব অভিভাবকরাই তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তিত। বিভিন্ন সূত্রে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেহেতু শিশুরা টিকাকরণের আওতার বাইরে থাকবে তাই তারাই বেশি আক্রান্ত হবে। যদিও এটা ঠিক যে করোনার ক্ষতিকারক প্রভাব শিশুদের ওপর তুলনামূলকভাবে কম। ফলে সব মিলিয়ে সামগ্রিক চিত্রটা কেমন দাঁড়াবে সেটা এখনই সম্পূর্ণভাবে আন্দাজ করা মুশকিল। যদিও আমাদের সবচেয়ে খারাপের কথা ভেবেই প্রস্তুত হতে হবে। তারপর যদি দেখা যায় অবস্থা অতটা খারাপ নয় সে তো সোনায় সোহাগা। চলুন জেনে নিই, তৃতীয় ঢেউয়ের সময় শিশুদের কিভাবে সুরক্ষিত রাখব…
১.
জ্বর, সর্দিকাশি, পেটে ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট, র্যাশ, চোখ লাল হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান।
২.
“না না ডাক্তারবাবু, সব করোনা-টরোনা নয়। একটু বৃষ্টিতে ভিজেছে আর একটু ঠান্ডা জল খেয়ে ফেলেছিল। সেই থেকেই আর কী… করোনা হ’লে তো আরো খারাপ হতো। আমরা তো বুঝতে পারতাম, বলুন? আপনি ওষুধ লিখে দিন। তারপর দেখি…”
এ ধরনের কথাবার্তা আকছার শোনা যাচ্ছে। সোজাসাপ্টা বলে দিই, করোনা চোখে দেখা যায় না। আর পৃথিবীতে এমন কোনও ডাক্তার নেই যিনি একজন জ্বরের রোগীকে চোখে দেখেই নিশ্চিতভাবে বলে দেবেন এই রোগীর করোনা হয়নি। অসংখ্য ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাড়িসুদ্ধ সবার জ্বর। কারো করোনা পরীক্ষা হয়নি। সবাই এটা সেটা দু’দিনের ওষুধ খেয়ে জ্বর কমে যেতে দিব্যি ভেবে বসেছেন এই জ্বর করোনা নয়। কোনও ওষুধ না খেলেও একটা বড় শতাংশ করোনা এমনিই সেরে যাবে। শুধু যেসব ক্ষেত্রে করোনা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যাবে কিংবা ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড অথবা অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী কুপ্রভাব রেখে যাবে সেগুলো খুঁজে বার করার জন্যই চিকিৎসকের পরামর্শ কিংবা করোনা পরীক্ষা করা দরকার। রোগের কাছে কিন্তু ‘ও তো এমনি এমনি জ্বর’ বললে কোনও মাফ নেই।
৩.
রোগের উপসর্গ দেখা দিলেই শিশুকে বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে যথাসম্ভব আলাদা জায়গায় রাখার চেষ্টা করুন। শিশুর দেখভালকারীর সংখ্যা খুব কম রাখতে হবে। যিনি বাচ্চার পরিচর্যা করছেন, সম্ভব হলে তাঁকে বাড়ির অন্যান্য কাজ থেকে রেহাই দিন। পরিচর্যাকারী বাচ্চার কাছাকাছি এলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন।
৪.
পাঁচ বছরের নিচের বাচ্চারা অনেক সময়ই সঠিকভাবে মাস্ক পরতে পারে না। মাস্ক বারবার খোলাপরা করলে বা বাইরের দিকটায় বারবার হাত দিলে হিতে-বিপরীত হতে পারে। যদি পাঁচ বছরের নিচের কোনও বাচ্চা ভালোভাবে মাস্ক পরতে শিখে নেয় তাহলে পরিয়ে রাখা যেতে পারে। ছ’বছর বা তার ওপরের বাচ্চাদের অবশ্যই মাস্ক পরাবেন। মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপারে আগে নিজে সচেতন হোন। আপনার সচেতনতাই বাচ্চার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে।
৫.
হাঁচি-কাশির সময় কনুই, রুমাল বা টিস্যু পেপার দিয়ে নাক মুখ চেপে রাখতে হবে। বাচ্চা যাতে বারবার নাক বা মুখে হাত না দেয় সে দিকে খেয়াল রাখবেন।
৬.
বাচ্চার সুষম খাবারের দিকে নজর রাখুন। প্রতিদিনের খাবারে পরিমাণমতো জল, শাকসব্জি, ফলমূল রাখুন। কোনও প্যাকেটের খাবার বা বাজারচলতি হেলথ ড্রিঙ্কস দেওয়ার দরকার নেই।
৭.
বাচ্চাকে শারীরিক পরিশ্রম বা খেলাধুলোয় উৎসাহিত করে তুলুন। বাইরে বেরোনো যাচ্ছে না; এটা নিঃসন্দেহে একটা প্রতিবন্ধকতা। তবে সেটা যেন অজুহাত না হয়ে দাঁড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। ব্যায়াম করতে চাইলে একটা দু’ফুট জায়গায় দাঁড়িয়েই ঘাম ঝরানো যায়। নিজেরা নিয়মিত ব্যায়াম করুন। বাচ্চার সামনে উদাহরণ হয়ে উঠুন।
৮.
সাধারণ পরিছন্নতা, বারবার হাত ধোওয়া কিংবা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা; এসব নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। বাড়িতে অসুস্থ ব্যক্তি থাকলে তাঁর ব্যবহার্য থালা, বাটি, চামচ ইত্যাদি আলাদা রাখুন।
৯.
বাড়ির বয়স্করা কিংবা আগে থেকেই প্রেশার, সুগার বা অন্যান্য জটিল রোগ আছে এমন ব্যক্তিরা অসুস্থ শিশুর থেকে দূরে থাকবেন।
১০.
শিশুকে সমস্ত ধরনের টিকাকরণ করান। জাতীয় টিকাকরণ কর্মসূচীর বাইরেও আইএপি সূচীতে বাড়তি কিছু প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন (নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড, চিকেন পক্স, হেপাটাইটিস এ ইত্যাদি) আছে। আর্থিক সমস্যা না হ’লে আপনার শিশু-চিকিৎসকের কাছে সব ধরনের ভ্যাকসিন দিন। বড়রা সুযোগ পেলেই করোনা ভ্যাকসিন নিন। গর্ভবতী মা বা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েরাও নিশ্চিন্তে করোনা টিকা নিতে পারেন।
১১.
ঘরে বন্দী থাকতে থাকতে শিশুরা মানসিক অবসাদ বা অস্থিরতার শিকার হচ্ছে। সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
১২.
অনেকেই করোনা পরীক্ষা না করিয়ে ‘সাধারণ জ্বর’ বলে দিব্যি চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতে আপনার ক্ষতির সম্ভাবনা তো আছেই উপরন্তু আপনি রোগটা আরো পাঁচজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকার বা প্রশাসনের দোষ-ত্রুটির দিকে আঙুল তোলার পাশাপাশি নিজেও সচেতন নাগরিক হয়ে ওঠা সমান গুরুত্বপূর্ণ।
১৩.
নিজে নিজে বা এর ওর পরামর্শে চিকিৎসা করতে যাবেন না। প্রমাণিত আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কিছু অন্ধভাবে মেনে নেবেন না। রোগ সত্যিই খারাপ পর্যায়ে গেলে ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিন’ বলে পরিচিত ছদ্ম-বিজ্ঞানগুলি কাজে আসে না।
১৪.
হঠাৎ জ্বর এলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগেই ঘরোয়া চিকিৎসাগুলি শুরু করুন। বাচ্চাকে বেশি করে জল খাওয়ান। সহজপাচ্য খাবার অল্প পরিমাণে বার বার দিন। একশো ডিগ্রির ওপরে জ্বর এলে প্রতি কেজিতে পনেরো মিলিগ্রাম হিসেবে প্যারাসিটামল দিন। অর্থাৎ, দশ কেজির বাচ্চাকে প্রতি পাঁচ মিলিতে একশো কুড়ি/পঁচিশ মিগ্রা আছে এরকম সিরাপের ছ’মিলি অথবা পাঁচ মিলিতে আড়াইশো মিগ্রা আছে এরকম সিরাপের তিন মিলি দিতে হবে। একইভাবে হিসেব করে ট্যাবলেট গুঁড়ো করে জলে মিশিয়ে খাওয়ানো যাবে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াবেন না। খুব বেশি জ্বর এলে ভেজা কাপড় দিয়ে গোটা গা মুছিয়ে দিন। দরকার হ’লে স্নান করান।
১৫.
জ্বর বা সর্দিকাশির জন্য স্নান করা, ভাত খাওয়া ইত্যাদি বন্ধ করবেন না। নিশ্চিন্তে কলা বা টকফল খাওয়া যাবে।
সতর্ক থাকুন। সচেতন থাকুন। ঢেউয়ের সামনে বুক চিতিয়ে বলুন ‘উই শ্যাল ওভারকাম’!