“ডেপুটেশন” এই শব্দটা যেকোনো ছোট বড় মাঝারি আমলাকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, সে বাম আমলের হোক বা ডান, তাদের বুকে মৃদু কম্পন জাগাতে বাধ্য। অন্য রকম কেউ যদি বলে, জানবেন সেই আমলা আপনাকে নির্জলা মিথ্যে কথা বলছে, সরি, “কাঁচা ঢপ দিচ্ছে”। ক্ষুদে আমলা হিসেবে আমিও ব্যতিক্রম নই, শব্দটা শুনলে আমারও একই রকম প্রতিক্রিয়া হয়। তাহলে আজকে এই লেখাটা কেন? আমার নানা রকম এলোমেলো কথায় আমার বন্ধুরা সদর্থক প্রতিক্রিয়া জানান বলেই আজকের এই গল্পটা শেয়ার করা।
আমার জেলার একটি ব্লকের তৎকালীন ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক মানে BMOH শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ হওয়াতে একটি বাচ্চা মেয়েকে সেই ব্লকের দায়িত্বে আনতে বাধ্য হই। মেয়েটির সাথে প্রথম আলাপেই মনে হয়ে ছিল ছোটখাট সাদামাটা চেহারার হলে কি হবে, আসলে খুব ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে, বিশেষ করে আমার মতো হঠাৎ মাথাগরম বসকে যে ভাবে প্রথম মোলাকাত এর দিনে ট্যাকেল করেছিল। দায়িত্ব দেওয়ার পরে সেই মেয়েটি একদিন কান্না ভেজা গলায় ফোন করে জানায় যে তার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সে ঘেরাও হয়ে আছে। একটি ডেঙ্গু রুগীর মৃত্যুর পর রোগীর বাড়ির লোক, পাড়া প্রতিবেশী সহ মানুষজন তাকে ঘেরাও করে রেখেছে। ভাঙচুর ও মারধোর শুরু হল বলে। এসডিপিও কে ফোন করি, তিনি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে গিয়ে যে যাত্রা উদ্ধার করেন। গল্পটা অতি পরিচিত, বিশেষ করে হেলথ সার্ভিসে যাঁরা আছেন তাঁদের জন্য। এখানেই শেষ নয়।
এর পর কয়েক মাস কেটে গেছে। ওই মেয়েটি প্রশাসকের দায়িত্বে থাকলেও সে প্রশাসনিক ক্যাডারের নয়। এই বার এলাকাবাসীর কাছে খবর গেছে যে ওই মেয়েটির বদলে প্রশাসনিক ক্যাডারের একজন BMOH দায়িত্ব নিতে চলেছেন। ব্যাস আর যায় কোথায়। ওই মেয়েটি নিজগুণে, তার কর্তব্য নিষ্ঠার জোরে, সততা ও আন্তরিকতার জোরে ততদিনে মানুষের মন জয় করে ফেলেছে। তাই শতাধিক মানুষ আমাকে সই করে আবেদন পত্র পাঠিয়েছে যাতে ওই মেয়েটিকে ওই দায়িত্ব থেকে সরানো না হয়। এখানেই শেষ নয়, এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা আমাকে ফোন করে বলছেন যে “সিএমওএইচ সাহেব , ওই লেডি ডাক্তারকে যেন কোনো মতেই সরানো না হয়, উনি দারুন ভালো কাজ করছেন, সরানো হলে পরে, এক হাজার জন এলাকাবাসী আপনাকে ডেপুটেশন দিতে যাবে।”
ডেপুটেশনের হুমকি এর আগেও অনেকবার শুনেছি। এই প্রথমবার শব্দটা শুনে মনের ভেতরটা অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে গেল। কোন যাদুমন্ত্র বলে আমার সেই ছোট্ট বোনটি মানুষের মনে এমন জায়গা করে নিল। একটু গর্বও হচ্ছিল। মানুষ চিনতে তাহলে ভুল করিনি। এমন ডেপুটেশন খেতে রাজি আছি। আপনারা এলাকাবাসী আসুন আপনাদের আবদার নিয়ে। এই ভালোলাগা ভোলার নয়। পর্ণার জন্য রইল অনেক অনেক আশীর্বাদ। ডাক্তার হওয়াটা সার্থক ওর জীবনে। আমার প্রশাসক জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ট উপহার আমাকে দিয়ে গেল ডা:পর্ণা কুন্ডু। ইস্পাতের ফলা আরো ধারালো হোক মানুষের ভালোবাসার উত্তাপের তাপে। বেঁচে থাকলে দেখে যেতে চাই ও রাজ্যের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্য প্রশাসকের আসনে বসেছে একদিন।