না মশাই, থ্রেট সিন্ডিকেট শুধু মেডিকেল কলেজে নয়, এখন তো দেখছি এটা সব জায়গায় রয়েছে।শান্তিপুর হাসপাতালে এবার অভিযোগ উঠল। অভিযোগ সুপার নাকি এক ডাক্তারকে হুমকি দিয়েছে,”আর জি কর করে দেবো”। কে ঠিক বলছে আর কে ভুল বলছে সেটা তদন্ত সাপেক্ষে। কিন্তু একটা কথা প্রশ্নাতীত। “আর জি কর করে দেবো” এই শব্দবন্ধ এর একটি নির্দিষ্ট মানে আছে। প্রশাসনিক প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে চূড়ান্ত ক্ষতি করা হবে, এবং তার বিচার মিলবে না। এটাই এই হুমকির আসল অর্থ।
তিলোত্তমার খুন আর ধর্ষনের পরে যখন প্রশাসন সঞ্জয়কে একমাত্র অপরাধী বলে দেগে দিয়ে ফাঁসির দাবি তোলা হচ্ছিলো, ঠিক তখন আন্দোলনরত মানুষ এবং মৃতার বাবা মা কয়েকটি প্রশ্ন নিরন্তর তুলে যাচ্ছিলো। সঞ্জয় একা নয় অনেকে জড়িত, বৃহত্তর ষড়যন্ত্র আছে, এর পিছনে প্রভাবশালীর যোগ আছে, আসল সত্যি কি সেটা আমরা জানতে চাই। এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাবার জন্য আন্দোলন আর আইনি লড়াই চলছে।
দুদিন আগে মালদা জেলাতে এক তৃণমূল কাউন্সিলর এবং পার্টির জেলা সভাপতি বাবলা সরকার খুন হলো। যারা গুলি করে খুন করলো তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করাও হয়ে গেছে। এবার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেই ল্যাটা চুকে যেতো।
এরপরেই ওনার স্ত্রীর যে মিডিয়া বাইট দেখলাম সেখানে এই সামনে দেখা আততায়ীর শাস্তি হলেই যে উনি শান্তি পেয়ে যাবেন, সেটা মনে হলোনা। ওনার বক্তব্য শুনে মনে হলো উনি অন্য কিছু ভাবছেন। উনি নিজেও একজন শাসক দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং জেলার মহিলা সংগঠনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। উনি শাসকদল এবং তার তদারকিতে প্রশাসন কিভাবে চলে সেটা ভেতর থেকে জানেন। উনি যখন শাসকদল বা প্রশাসন নিয়ে কোনো মন্তব্য করে তখন সেটা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়।
এবার দেখা যাক উনি ওনার স্বামীর খুন হওয়া নিয়ে ঠিক কি বললেন সেটা পয়েন্ট করে দেখা যাক।
১) ওনার স্বামীর খুন একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। অনেকে মিলে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
২) এর মাথা সম্ভবত এক বা একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ওনার কথায় এখানে পরিষ্কার, সেই নেতাগুলি সম্ভবত শাসক দলের।
৩) এই হত্যার পিছনে কারা আছে সেই সত্যি উনি জানতে চান
৪) উনি এটাও চান যে আগের অনেক কেসের মতো, পুলিশ যেনো আসল অপরাধীকে আড়াল না করে, তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসে।
৫) এর আগেও খুন হওয়া কাউন্সিলর আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপর ওনার পুলিশি সুরক্ষা ছিলো। সম্প্রতি সেই সুরক্ষা পুলিশ তুলে নেয়। এরপরেই এই খুন। এরমধ্যেই ওনার স্ত্রী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন।
এবার আপনারা আর জি করের নির্যাতিতার আপনজনদের দাবি আর এই শাসক দলের নেত্রীর দাবিকে একটু মিলিয়ে নিন। দেখতে পাবেন দুটোর মধ্যে কিরকম অদ্ভুত মিল।
দুটি ঘটনা কীভাবে মিলে গেলো সেটাই এখানে দেখার চেষ্টা করবো।
আর জি করে ডাক্তার কন্যা খুন হলো। পুলিশ সঞ্জয় রাইকে একা অপরাধী বলে ধরলো। মানুষ এটা মানতে পারলো না। আর পিছনে কারা তার সন্ধান করছে এখনো।
মালদাতে দুজন কাউন্সিলরের ওপর গুলি চালিয়ে খুন করলো। দুজনে ধরাও পড়ে গেলো। তবুও ওনার স্ত্রী পিছনে কারা আছে, কোন রাজনৈতিক নেতারা এর প্ল্যান করে থাকতে পারে তার সন্ধান করতে ব্যস্ত।
আমরা আম জনতা আর মৃতের স্ত্রী শাসকদলের নেত্রী। আমরা যেটা অনুমান করি সেটাই উনি দলের ভিতর থেকে প্রশাসনের ভিতর থেকে জানেন।
ওনার বক্তব্য থেকে দুটি জিনিস পরিষ্কার –
১) বর্তমান শাসকদলে এমন কিছু নেতা আছে যারা পরিকল্পিত খুনের মতো অপরাধ করার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য উনি আর কারুর দিকে আঙুল তোলেন নি।
২) পুলিশ আগের অনেক কেসে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করেছে। এটা উনি প্রশাসনে আছেন বলেই জানেন।
এবার প্রশ্ন হলো উনি এই সত্যি কেনো মিডিয়ার সামনে বলে দিলেন। এর আগে যা খুনোখুনি হয়েছে তার আঁচ ওনার গায়ে লাগেনি। তাই সেখানে সত্যি বলার থেকে ওনার রাজনৈতিক আনুগত্য প্রাধান্য পেয়েছে। এবারে সরাসরি ওনার আপনজন খুন হয়েছে। তাই হয়তো শোকের তীব্রতায় রাজনৈতিক আনুগত্য সাময়িক হলেও সত্যের কাছে হেরে গেছে।শোক কমে গেলে হয়তো রাজনৈতিক আনুগত্য আবার প্রাধান্য বিস্তার করবে। উনি হয়তো ওনার বক্তব্য পাল্টে ফেলতে পারেন। কিন্তু এই শোকের আবহে প্রশাসনের ভিতরের একজনের থেকে যে সত্যিটা আমরা জেনে গেলাম, এটাই আমাদের লাভ। যেগুলো আমাদের অনুমান ছিলো, সেগুলো যে কতটা সত্যি সেটাই এই হতভাগ্য স্বামীহারা মহিলা শোকের তীব্রতায় মিডিয়ার সামনে বলে ফেললেন।
যে থ্রেট সিন্ডিকেটের কথা আর জি কর আন্দোলন থেকে বারবার উঠে এসেছে, সেটা যে কতটা ব্যাপ্ত সেটা আবার প্রমাণিত হলো। প্রাণ গেলো এখন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের। ওনার বাড়ির মানুষজন সুরক্ষা নিয়ে আজকে চিন্তিত। যারা বলার চেষ্টা করছেন থ্রেট সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই, তাদের উত্তর হলো মালদায় বাবলা সরকারের খুন।