কোটার্ড সিনড্রোম। তথা, ডিলিউশন অফ নিহিলিজম।
“আমি তো আর মানুষ নেই। আমি পাগল হয়ে গেছি, আমার মধ্যে আর কিছু নেই। আমার মধ্যে রাগ, হিংসা, ভালোবাসা, কষ্ট আর কিছুই বাকি নেই। আমি শেষ হয়ে গেছি।”
২৭ বছর বয়সী একটি মেয়ে। এসেছে মায়ের সঙ্গে। ২০২৩ থেকেই মোটামুটি ডাক্তার দেখাচ্ছে এই আউটডোরে। টিকিটটা উল্টেপাল্টে দেখলাম — সিভিয়ার ডিপ্রেশন, হোপলেসনেস +ve, তার সঙ্গে ভার্বাটিম কিছু কথাও লেখা। আস্তে আস্তে উঁচু ডোজ অ্যান্টিডিপ্রেসান্টের দিকে যাওয়া হয়েছে। আগেরবার অ্যাডমিশন করতে চাওয়া হয়েছিল, রিফিউজ করেছে।
টিকিটটা থেকে মুখ তুলে মেয়েটির দিকে চাইলাম। জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটির মুখে কোনো উত্তর নেই। মা উত্তর দিল, একই রকম আছে। ঘরে বসে থাকে গত দুবছর, শুরু হয়েছিল বাবার অপারেশনের পর, তারপর থেকে আস্তে আস্তে কথা বলা বেশ কম করে দেয়, আর একসময় টিউশনি পড়ানোটাও ছেড়ে দেয়। ইতিহাসে উচ্চশিক্ষিত মেয়েটি তাকালো আমার দিকে, নিজেরই ইতিহাস শুনতে শুনতে, কিন্তু কিছু বললো না। বাধ্য হয়েই ওপিডির দাঁড়িয়ে থাকা পেশেন্টের ভিড়কে বললাম একটু বাইরে যেতে, আর তার সঙ্গে মাকেও বললাম বাইরে অপেক্ষা করতে।
তারপর আস্তে আস্তে মেয়েটি মুখ খুললো। ওই ওপরে লেখা কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললো, আর বললো তার ওষুধ খেতে ভালো লাগে না। ওষুধ খেয়ে হবেটাই বা কী, সে তো আর কোনোদিন ভালো হবে না। গলায় হতাশা ও নিরাশা মেশানো দৃঢ় বিশ্বাস। তার বুদ্ধিশুদ্ধি, পড়াশোনা, স্মৃতিশক্তি সবই গেছে নাকি, ফিরবে না কোনোদিন।
এরকম পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট এবং ট্রিটমেন্টের কমপ্লায়েন্স (নিয়ম মেনে চলা) দুটোই সুনিশ্চিত করা ভারি মুশকিল। আদৌ ওষুধ খায় কিনা, ঘরের লোক নজর রাখে কিনা — কেই বা জানতে পারে সঠিকভাবে! সবচেয়ে ভালো উপায় কিছুদিনের জন্য ভর্তি করা। আগেরবার যে দেখেছিল, সেই কলিগের সাথে আলোচনা করলাম। সেও আগেরবার অনেক চেষ্টা করেছিল ভর্তি করার, পারেনি। আবার আমরা দুজন মিলে বসলাম, পেশেন্ট আর তার মাকে নিয়ে। মাকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমি তেড়ে কাউন্সেলিং করলাম, বোঝালাম এরকম পেশেন্টের Insight এর অভাব থাকে, তারা বোঝে না যে চিকিৎসা প্রয়োজন। স্যারের সঙ্গে কথা বললাম। তারপরেও ভর্তি করা গেল না। নতুন ওষুধ লিখে ছেড়ে দিতে হলো। আমি মাকে একবার শেষবারের মতো কড়াভাবে বললাম, রোজ সামনে দাঁড়িয়ে ওষুধ খাওয়াতে। পরে শুনলাম, মেয়েটি যাবার আগে কলিগকে বলে গেছে, সে সত্যিই রেগুলার ওষুধ খায় না (অর্থাৎ, এতোদিনের ট্রিটমেন্ট বেশ কিছুটা বৃথা)।
যাইহোক, পরেরবার এলে আবার চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে, কনসেন্ট তথা সম্মতি নেবার। চেষ্টা করতে হবে, রোগ থেকে সুস্থতার দিকে তাকে নিয়ে যাবার। চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করেই যেতে হবে।
এইভাবেই, ওপিডি শেষ হয়ে যায়, কিন্তু পেশেন্টরা সঙ্গে থেকেই যায়…