সদ্যসদ্য কিষনগর সদর হাসপাতালে আমার অধীনে গাইনি রুগি ভর্তি হওয়া শুরু হোয়েছে! খুব চাপ!
দুএকদিন পরেই কোর্টের নোটিশ! সাধারণ শমন না এক্কেরে “ওয়ারেন্ট অর্ডার”! মানে আমি অপরাধী –
মরেছেরে – কি ব্যাপার?
এম্নিতে রেপ ভিক্টিম রুগীদের পরীক্ষা করতেই হয় – আমার দেওয়া সেই রিপোর্ট থানাপুলিশ ঘুরে আদালতে বিচার হয় জানতাম! সেই ব্যাপারে তো “শমন” আ! কিন্তু আগে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা হবার আগেই –একেবারে “ওয়ারেন্ট” ???
বুঝতেও পারছিনা কি কেস –
সিনিয়র দাদা খোঁজ নিয়ে জানালেন – “ওটা রেপ কেসেরই – আর রেপ করার হিম্মত তো তোমার আমার নেই – কাজেই অমুক উকিলের কাছে নিশ্চিন্তে যাও – খোজ নাও” —
সেদিনই সন্ধ্যায় গেলুম! ঘুপচি ঘর‚ একটা বেঞ্চ আর মশারি টাঙ্গানো তক্তাপোশে শুয়ে উকিলবাবু বল্লেন – “আপ্নাকে জামিন নিতে হবে‚ তিনচারশো টাকা দিন ড্রাফট কিনতে হবে”
দিলাম – প্রাণে মানে তো বাঁচি আগে
পদ্দিন সেই আদালতের বাইরেই উকিলবাবু বল্লেন – “এই কাগজটায় সই দিয়ে বাড়ি চলে যান”
তাই করলাম! হঠাৎ বিকেলে কোর্ট থেকে এক পরিচিতর ফোন – “দাদা এখন থেকে দুতিন দিন বাড়িতে থাকবেন না – আপনার নামে ‘এরেস্ট অর্ডার’ অর্ডার বেরিয়েছে একবারে লালকালিতে”————
কি এক্কেরে এরেস্ট? হলোটা কি? বাড়ি থেকে হাওয়া হতেই হলো দুদিন! কি দোষ কি কল্লাম – এক্কেরে অন্ধকারে! পাগল পাগল অবস্থা —
পেছনে শনি লাগা কি একেই কয়?
এদিক ওদিক খোঁজখবর নিয়ে কলকাতায় আমার ঘ্যাম একজন আত্মীয়-আমলাকে যোগাযোগ করে খুবই সাবধানে আদালতে ঢুকলাম!
জজসাহেব আমার পরিচয় পেয়েই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে চিতকার করে উঠলেন – “এরেস্ট হিম, এরেস্ট হিম ”
গা হিম হয়ে গেল একদম! পুলিশরা ধরতে এসেও ইতস্ততঃ – হাজার হোক ডাক্তারবাবু তো!
ঘামছি আর ঘামছি – কান মাথা ভোঁভোঁ‚ চোখে কালোদেখছি!
অন্যান্য উকিলরা এগিয়ে এলেন — “স্যার ছেড়েদিন – কমবয়েস করেফেলেছে – ছেড়ে দিন -”
—- “নো হি ইস ভেরী ডেঞ্জারাস – এরেস্ট হিম – এই পুলিশ ধর ধর” –
বুক দুদ্দুর‚ পা কাঁপছে‚ জিভ শুকিয়ে কাঠ – মাইরি!
পুলিশ এসে হাত ধরলো – অনিচ্ছা নিয়েই হাত টেনে – “চলুন স্যার ‚ কি আর করবেন কদিন না হয় … ”
দেয়ালে পিঠ ঠেকলে যা হয় আরকি! জীবনে অনেক আন্দোলন ফান্দোলন করেছি আর ক্যারিয়ার খেয়াল না করে বোম পর্যন্ত খাওয়া একটা যাচ্ছেতাই অখাদ্য বখাটে ডাক্তারি ছাত্র আমি! এই পরিস্থিতিতে আমার অজান্তেই কে যেন আমার ভেতরে জেগে উঠলো –“– স্যার আপ্নিতো বিচারক! আগে অর্ডারটা লিখুন! তারপর এরেস্ট ! আপনি হিন্দী সিনেমার অমিতাভ বচ্চনের মতো হাত নাড়িয়ে ওভাবে এক্টিং করতে পারেন না”— (আমার জিভে কি বিনয় বাদল ভর করেছিলো)?
আদালত কক্ষে একটা বোম ফাটল যেন! পিনড্রপ সাইলেন্স –!
— স্যার উনি নিজেই তো আর অপরাধী নন! উনি এক্সপার্ট উইটনেস হয়ে সাক্ষী দিতে এসে জেলে গেলে কিন্তু ডাক্তাররা ক্ষেপে উঠতে পারে”– চুলদাড়ি সাদা এক বয়স্ক উকিল বলে উঠলেন –
ওফ! থ্যাঙ্ক গড! অন্তত একজনকে পাশে পেলাম
– “আরে উনাকে তিন নয় চারবার শমন পাঠানো হয়েছে – বড়ো ডাক্তারতো‚ তোয়াক্কাই করেনি” জজ বল্লেন!
– ” আমি কোনও শমনই পাইনি, স্যার”
— “মানে! আমি নিজে সই করেছি শেষ দুটোতে”
— “আমি সত্যিই কিছুই জানিনা স্যর”
– “এই কেউ ডাকুনতো দাশবাবুকে” জজ চেঁচিয়ে উঠলেন! দাশবাবু মানে সেই ক্লারিক্যাল স্টাফ যাঁর দায়িত্ব “শমন”-এর নোটিশ সবাইকে পাঠানো –
বিড়ির শেষটুকু ঘরে ঢোকার আগে দরজার মুখে ফেলতে ফেলতে দাশবাবু আদালত কক্ষে এলেন!
“– দাশবাবু আপনি উনাকে শমন পাঠাননি? এতগুলো শমন লেখা হলো?”
— “হ্যাঁ স্যার পাঠিয়েছি তো” দাশ অম্লানবদন!
অনেক খোঁজাখুঁজির পর দাশবাবুর টেবিলের কাগজপত্র আর কাচের নিচেই চারটে শমন অর্ডার পাওয়া গেল !!!!
কিন্তু গায়ে জ্বালাটা অনেকদিন ছিলো — সত্যিই
বছর দুয়েক পরে এক দারুণ শীতের গভীর রাতে আমি ইমার্জেন্সি ডিউটিতে!
– “ডাক্তারবাবু, দেখুনতো শান্তিপুরের রাসমেলার ভীড়ে আমার স্ত্রীর কানটা ছিঁড়ে বদমাশরা দুল ছিনিয়ে নিয়েছে! দেখি সেই জাজমশাই সাথে আরো দুজন সপরিবার জাজ আর “অন ডিউটি” লেখা গাড়ি!
মাফলার চাদর- কম্বল জড়ানো আমাকে অতরাতে চিনতেই পারেননি উনি!
সেলাই ইত্যাদি স্টাফরাই করেন! একজন স্টাফ এগিয়ে আসতেই জাজমশাই বল্লেন – “ডক্টর – আপনাকেই সেলাই করতে হবে আর হ্যাঁ পরে যেন কোনও দাগ না থাকে”-
এসো বাবা ভাঁজে এসো!!! ওইরকম আঙ্গুল তুলে একঘর লোকে মাঝে – “এরেস্ট হিম”! আর দুদিন লুকিয়ে কাটানো – খুব মজা না? ছেলেমানুষিটা চলকে উঠল!
—- “স্যার হাসপাতালে যেসব সুতো তাতে দাগ থাকবেই” আমি বলে দিলাম নির্বিবাদে!
— “কি সুতো লাগবে লিখে দিন কিনে আনছি” জাজ দু’জন বল্লেন!
লিখে দিলাম “এইট জিরো ক্যাটগাট (পেতে গেলে কিষনগর থেকে কলকাতা মায় বোম্বে যেতে হতে পারে ………)!”
সকাল সাতটা – আমার ডিউটি শেষ! সেই পজ্জন্ত কেউ সেই “এইট জিরো ক্যাটগাট” কিনে আনেননি!
খুবই ছ্যঁচড়ামো আর বাঁদরামো – ঠিক হয়নি কি বলেন??? হয়তো তাইই – তবে একহাতে তালি তো বাজেনা – তাইনা!!!
বিচারের ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলুম!
আজ এখানে জগদ্ধাত্রী পুজো! অনেক ঠাকুর দেখে এটাসেটা খেয়ে পেটটা মনে হচ্ছে মাঝরাতে ভোগাবে – যাই মেট্রোজিল খেতে হবে এক্ষুনি –!
দারুন।