গত ১০ই মার্চ, বৃহস্পতিবার বেলেঘাটার আই ডি হাসপাতালে একটা প্রশিক্ষণ শিবির হল। আমিও একজন প্রশিক্ষণ প্রাপক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। কিসের প্রশিক্ষণ? জলাতঙ্ক রোগের প্রশিক্ষণ। এরকম নানান বিষয়েই বিভিন্ন সময়ে, সরকারী ভাবেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, আমার মত সরকারি চাকরীরত ডাক্তারদের। আমি নিজেই জেলায় জেলায় ঘুরে, ডাক্তার বাবুদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, সাপের কামড়ের উপর।
এই যে জলাতঙ্কের উপর প্রশিক্ষণ হল, এটা কিন্তু জাতীয় কর্মসূচী। এই জলাতঙ্ক প্রতিরোধের জাতীয় কর্মসূচী ব্যাপারটা আমার ঠিক জানা ছিল না। যে কোন প্রশিক্ষণই আমাদের জানা বোঝার জন্য উপকারী, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই জলাতঙ্ক প্রতিরোধের ব্যাপারেও আমাদের কিছু কিছু ভুল ধারণা ছিল, ভালো করে শিখলাম। তবে কিনা আমার মতে এই প্রশিক্ষণ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া খুব জরুরী।
এই যে জলাতঙ্ক প্রতিরোধের প্রধান কাজটা হয়, কামড়ের পর তাড়াতাড়ি সাবান জলে ধুয়ে ফেললে। আসলে টিকা ইঞ্জেকশন ইত্যাদির থেকেও এই ধুয়ে ফেলাটা বেশী জরুরী। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এই সাবান জলে ধুয়ে ফেলা ব্যাপারটাই সব থেকে বেশী অবহেলিত হয়। আমরা হাসপাতালে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কুকুর বিড়াল কামড়ের জায়গাটা ধুয়ে ফেলাটা যে অত্যন্ত জরুরী, এটা সাধারণ মানুষকে বোঝানোই যায় না।
পনের মিনিট ধুতে বললে এমন ভাবে তাকায় যেন ডাক্তারকে পাগল ভাবছে। তাছাড়া কুকুরের কামড় সাধারণত পায়ে হয়। বেশিরভাগ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পা ধোয়ার মত জায়গায় জলের কলটা থাকে না।
এখন সব সরকারী হাসপাতালে দামি দামি টিকা, সিরাম ইত্যাদি বিনা মূল্যেই দেওয়া হয়; কিন্তু এই পনের মিনিট ধুয়ে ফেলার ব্যাপারটা আদৌ দেখা হয় না।
কামড়ের জায়গা দ্রুত সাবান জলে ধুয়ে ফেলা, তারপর কামড়ের জায়গায় RIG অর্থাৎ জলাতঙ্কের সিরাম ইঞ্জেকশন দেওয়া, এই হল প্রাথমিক কর্তব্য। তারপর দুই হাতের উপরে, কাঁধের পাশে (Deltoid) দুটি টিকা দেওয়া হয়। টিকার নির্দিষ্ট দিন প্রথম টিকার দিন ধরে হিসাব করে লিখে দেওয়া হয়। প্রথম টিকার দিনটিকে শূন্য দিন বা Day Zero বলা হয়। এর পর তিন, সাত একুশ ও আঠাশ নম্বর দিনগুলিতে একই ভাবে দুটি করে টিকা দেওয়া হয়।
জলাতঙ্ক যেহেতু একশ শতাংশ মারণ রোগ, তাই এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরী। জলাতঙ্ক হলে বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই, এজন্যই কামড়ের জায়গা ধুয়ে ফেলা থেকেই খুবই যত্ন নিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।
এবার বলি, এই জলাতঙ্ক প্রতিরোধের জাতীয় কর্মসূচী ব্যাপারটা আমাকে কেন হতাশ করেছে। আমরা গত বারো-চোদ্দ বছর লাগাতার ভাবে বলে যাচ্ছি যে, সাপের কামড়েও হাজার হাজার মানুষ মারা যান। সরকারী হিসেবেই শুধু মাত্র আমাদের রাজ্যে বছরে তিনশ-র বেশী মানুষ সাপের কামড়ে মারা যান। আমরা সমীক্ষা করে দেখিয়েছি যে, এই সাপের কামড়ে মৃত্যু সংখ্যা বছরে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার। এদিকে জলাতঙ্ক রোগে বছরে কুড়ি জন মানুষ মারা যান। তবুও আমাদের দেশের নীতি নির্ধারক বড় বড় কর্মকর্তার কাছে সাপের কামড়ের থেকেও জলাতঙ্ক বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।
জলাতঙ্ক রোগ গুরুত্ব পেয়েছে, তাতে আমাদের বলার কিছুই নেই। কিন্তু তার থেকে পনের গুণ বেশী মানুষ মারা যায় যে কারণে, তাকে কেন অবহেলা করা হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করাটা অপ্রয়োজনীয় নয় যে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৯ সালেই সাপের কামড়কে একটি “Neglected Tropical disease” বলে চিহ্নিত করেছে। জলাতঙ্ক কিন্তু ঐ তালিকায় নেই। সাপের কামড়ে গ্রামের চাষী, মজুর, জেলে এসব প্রান্তিক মানুষেরা মূলত মারা যান, এজন্যই কি এই ব্যাপারটা এত অবহেলিত?