ইউক্রেনে যুদ্ধ না বাধলে অনেকেই, সম্ভবত, জানতে পারতেন না – এদেশের অনেকেই ওদেশে ডাক্তারি পড়তে যান। শুধু ওদেশে নয়, আরও অনেক দেশে। যেমন চিন, রাশিয়া ইত্যাদি প্রভৃতি।
বিলেত-আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়ার সঙ্গে এ যাওয়ার কিছু ফারাক রয়েছে। এ যাওয়া বাধ্যত যাওয়া, নাচার হয়ে যাওয়া। এখানে সুযোগ না পেয়ে যাওয়া। সুতরাং, কিয়দংশে, গৌরবহীন যাওয়া।
সে যা-ই হোক, যে মুহূর্তে জানা গিয়েছে যে, এদেশের অনেককেই বিদেশ-বিভুঁইয়ে ডাক্তারি পড়তে যেতে হচ্ছে, অমনি সকলে ভয়ানক বিচলিত। কয়েকটি বিষয় নিয়ে তাঁরা খুবই চিন্তিত। যেমন –
১. যাঁরা ডাক্তারি পড়তে চাইছেন, তাঁরা সকলে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না – এ কেমন অবিচার! কয়েক লক্ষ পরীক্ষার্থী ভর্তির পরীক্ষায় বসছেন, কিন্তু আসন নাকি এক লক্ষেরও কম!! এ তো চূড়ান্ত অব্যবস্থা!!!
সত্যিই তো। উচ্চশিক্ষার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যাঁরাই বসবেন, তাঁরাই সুযোগ পাবেন – এমন চমৎকার ব্যবস্থা না করা গেলে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মূল স্পিরিট বজায় থাকবে কী করে!! আইআইটি আইআইএম ইত্যকার প্রতিষ্ঠানে, জানেনই তো, আসনের এমন বন্দোবস্ত যে, স্রেফ আগ্রহ থাকলেই ভর্তি হওয়া যায়। তাই না? পাড়ার মাঠের ফুটবল খেলাতেও আপনি চাইলেই সবাই খেলতে নেবে এমন নয়, অথচ তেমন আশ্চর্য দাবি আপনি ডাক্তারি পড়ার ক্ষেত্রে করে বসেন কেন!!
২. অবশ্য আসন বাড়িয়েই বা কী হবে! এ দেশে মেধার কদর কোথায়? পঞ্চাশ শতাংশের বেশি আসন যদি জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষিত হয়, তাহলে তো আর…
দেশে ডাক্তারি শিক্ষার আসনসংখ্যার অর্ধেকই বেসরকারি মেডিকেল কলেজে। বেসরকারি বনাম সরকারি কলেজে আসন, এই দুইয়ের অনুপাতটা ক্রমশ বেসরকারি আসনের দিকেই ঝুঁকতে থাকবে। সেই বেসরকারি কলেজের যত আসন, অন্তত অর্ধেক আসনে ভর্তির ব্যাপারে মেধা-টেধার আদৌ ভূমিকা নেই – ভূমিকা সেই একমেবাদ্বিতীয়ম অর্থবলের (অবশ্য কোচিং সেন্টারের এই রমরমার বাজারে “মেধা”-র মধ্যে কত শতাংশ অর্থের মেদ, তার হিসেব কষা মুশকিল)। বাকি অর্ধেকে ভর্তি “মেধাতালিকা” অনুসারে হলেও মনে রাখতে হবে, মেধাতালিকায় নাম ওঠা ছাত্রছাত্রীদের যাঁরা যাঁরা উক্ত কলেজের খরচাপাতি মেনে নিয়ে ভর্তি হতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন, “মেধাক্রম” মেনে ভর্তি হবেন তাঁরাই। অর্থাৎ “মেধা”-র বিষয়ে যৎপরোনাস্তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সে তো খুবই স্পষ্ট। জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে অনেককেই সরব হতে দেখি, বিত্তের ভিত্তিতে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বিশেষ কাউকে বলতে শুনি না।
সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথাটা হলো, ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন নামক বকচ্ছপের বরাভয় পেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়বে। অর্থাৎ রাজনীতির কল্যাণে যেভাবে বছর বছর জাতপাতভিত্তিক সংরক্ষণ বেড়ে চলেছে (যদিও আম্বেদকার সাহেব চেয়েছিলেন ঠিক তার উল্টোটা), বিত্তের ভিত্তিতে সংরক্ষণও ঠিক তেমন করেই বেড়ে চলবে। অর্থাৎ উঁচুজাতের গরীব-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বাদে সকলেই নিজের মতো করে নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারবেন। পারছিলেনও। “মেধা”-র মাধ্যমে, বা ট্যাঁকের জোরের মাধ্যমে, না হলে সহজপ্রাপ্য ব্যাঙ্ক ঋণের মাধ্যমে। ব্যবস্থাটা নিয়ে ক্ষোভ বিশেষ দেখিনি, শুধু টাকার অ্যামাউন্টটা নিয়ে ইতস্তত অসন্তুষ্টি দেখেছি।
তা আচমকা সবকিছু ছেড়ে ডাক্তারি পড়ার এত উৎসাহ কেন? যে প্রাণের বাছা বাপমায়ের হাত না ধরে পাড়ার রাস্তা পার হত না, সে স্রেফ মানুষের চিকিৎসা করবে বলে রাশিয়া-ইউক্রেন পাড়ি দিয়ে বসল!! ধানাইপানাই ছেড়ে সরল কথাটা বলি। কারণ মূলত দুটো –
১. যে যা-ই বলুন, এখনও এই পেশাটার একটা সামাজিক সম্মান আছে। এমনকি যাঁরা পেশাটার নামে দুবেলা গালিগালাজ করে থাকেন, তাঁদের কাছেও সম্মানটা আছে। মানে, যেমন ধরুন, “আহা, তুই যে ডাক্তার হলি, আমার কী ভালোই না লাগছে!! খুব বড় ডাক্তার হ’ বাবা। আজকালকার ডাক্তারগুলো যা চামার হয়েছে, তুই যেন ওরকমটি হোস না বাপু…” ইত্যাদি প্রভৃতি। উচ্চবিত্ত পরিবারে সেই ডাক্তারি ডিগ্রি খানিকটা স্ট্যাটাস সিম্বলও বটে।
২. এদেশে এখনও এই একটিমাত্র পেশা-ই অবশিষ্ট, যেটিতে খাওয়াপরা নিয়ে টানাটানির আশঙ্কা নেই। যদিও আইটি-র চাকরির গড় মাইনে কর্পোরেট হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারের মাইনের চাইতে ঢের বেশি – হ্যাঁ, সত্যিই বেশি – চারুকলা-গানবাজনা ইত্যাদি শিল্পজগতের মতো ডাক্তারিতেও আয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উইনার-টেকস-অল টাইপের অর্থাৎ গুটিকয়েক ডাক্তারের আয় আকাশছোঁয়া হলেও আম-ডাক্তারের মাসিক আয় আইটি-প্রাইভেট ব্যাঙ্কিং সেক্টরে সমবয়সী কর্মরতদের চাইতে ঢের কম – তবু, ডাক্তারিতে ন্যূনতম আয়ের বন্দোবস্তটুকু নিশ্চিত। যাঁরা কোটি টাকার বেশি খসিয়ে ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছেন, নিশ্চিতভাবেই তাঁরা ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে আসেন না – কথাটা অবশ্য শুধুমাত্র তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমন নয়। হয়ত প্রত্যাশাটা অন্যায়ও নয়, অনেকেই তো লতা মঙ্গেশকরকে দেখে গান গাইতে আসেন!!
তারপরও যুক্তি হিসেবে বলা যেতে পারে, যত যা-ই বলা হোক না কেন, যে দেশে ডাক্তারের এমন আকাল, সেখানে যদি কেউ ডাক্তারি পড়তে চায়, ডাক্তার হতে চায়, তাতে তো দেশেরই ভালো। তাই না??
প্রথমত, প্রথম বিশ্বের দেশের আন্দাজে এদেশে ডাক্তারের কমতি থাকলেও আমাদের দেশে ডাক্তারের ঘাটতি আপনারা যতখানি ভাবেন, বা সরকার যতখানি ভাবাতে চান, ততখানিও নয়। ঘাটতি বা সমস্যা বলতে যেটা, সেটা ডাক্তারের ডিস্ট্রিবিউশনে। শহরাঞ্চলে, বিশেষত মেট্রো সিটি বা টায়ার ওয়ান সিটিতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডাক্তার রয়েছে – মফস্বলে কম – প্রত্যন্ত গ্রামে প্রায় অনুপস্থিত। প্রচুর সংখ্যক ডাক্তার তৈরি করে এই “ঘাটতি” মেটানোর আশা প্রায় অর্থনীতির চুঁইয়ে আসা সমৃদ্ধির মতোই মায়াবী আশা, যাতে নাকি আম্বানির সম্পত্তি অনেক অনেএএক বাড়লে আপনার বাড়ির ঠিকে ঝি (স্যরি, কাজের দিদি) রীতার ছেলের জীবন আলোকিত হবে। ডা দেবী শেঠির মতো মানুষজন অবশ্যই বারবার বলবেন যে, ডাক্তারির আসনসংখ্যা বাড়ানোই সমাধান – কেননা, তিনি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্পোরেট স্বাস্থ্যব্যবসার মালিক এবং মালিক মাত্রেই চাইবেন শ্রমিকের ঢালাও জোগান, যাতে ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের অঙ্কটা মালিকের পক্ষে সুবিধেজনক অবস্থায় থাকে।
দ্বিতীয়ত, এঁরা বিদেশ থেকে ঠিক কীরকম ডাক্তারি পড়ে আসছেন? ডাক্তারি মূলত হাতেকলমে শেখা। বইয়ের পড়াটা হাতেকলমে শেখার প্রেক্ষিত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ একজন অসুস্থ মানুষকে পরীক্ষা করার মুহূর্তে কী দেখব কী শুনব কী ভাবব সেটা জানার জন্যে বই। বইয়ের ভূমিকা ওটুকুই। (ঠিক এই কারণেই এই একটিমাত্র পেশাতেই ‘হাতুড়ে’ ব্যাপারটা এক্সিস্ট করে এবং সেই হাতুড়েরা সবক্ষেত্রেই যে পাস-করা ডাক্তারের তুলনায় খুব খারাপ চিকিৎসা করেন, এমন নয়।) শ্বেতাঙ্গদের দেশে এঁরা হাতেকলমে শেখার সুযোগ কতটুকু পান? আমার হাতে বিশদ তথ্য নেই, তবে অনেক রাশিয়া-ইউক্রেন ফেরত ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যেটুকু শুনেছি, তার ভিত্তিতেই বলতে পারি, হাতেকলমে পরীক্ষার সুযোগ সেদেশে নিতান্ত সীমিত। গাইনি ওয়ার্ডে রোগিনীর যোনিদ্বারে হাত ঢুকিয়ে পিভি এক্স্যামিনেশন শেখা দূরে থাক, মহিলা ওয়ার্ডে রোগীর হাত ধরে পালস দেখার সুযোগটুকু পাওয়াও অনেকের বরাতে জোটে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এঁদের পড়াশোনা এমনই নড়বড়ে যে, পাস করার পর দেশে ডাক্তারি করার যে ন্যূনতম যোগ্যতামানের পরীক্ষা, প্রায় আশি শতাংশ সে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এবং বিশ্বাস করুন, প্রশ্নপত্রের মান হিসেব করলে, সে পরীক্ষাটি ডাক্তারি পরীক্ষার মাপকাঠিতে রীতিমতো সরল পরীক্ষা। (পাশাপাশি মনে করিয়ে দিই, রাশিয়া-ইউক্রেনে এমবিবিএস ডিগ্রি নেই, পাঁচ বছর পড়াশোনার শেষে ওখানে যে ডিগ্রি দেওয়া হয়, সেটি এমডি – বিশেষজ্ঞ এমডি নয়, তবুও তো এমডি। এদেশে এমডি/এমএস নিয়ে আমজনতার আদেখলাপনার বাজারে সেটাও যথেষ্ট বাড়তি মাইলেজ।) এমতাবস্থায় এঁরা এসে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন, এমন আশা…
(প্রসঙ্গত, ডাক্তারি পরীক্ষায় টোকাটুকি নিয়ে ইদানীং অনেক কথা শুনছি। টোকাটুকি সমর্থন করি না অবশ্যই। কিন্তু এদেশে এমন কোনও পরীক্ষার কথা বলতে পারেন, যেখানে টোকাটুকি নেই? টোকাটুকির বাহুল্য দেখে যাঁরা বলছেন, এঁদের কাছে কোন ভরসায় চিকিৎসা করাব, তাঁরা নিজেদের বাচ্চাদের ইস্কুল-কলেজে পড়তে দিতেন কী করে? কেননা, টোকাটুকি তো জেনারেল লাইনে ভরপুর। সাংবাদিক মাত্রই “সততার প্রতিমূর্তি” একথা তো জানি। তাঁরা নিজেরা টোকাটুকি তো দূর, তেমন কথা ভাবতেও পারতেন না, সেও মানি। তবু তাঁর কোনও পরিচিত মানুষ বা সতীর্থ কি কখনোই টোকাটুকি করেননি? নাকি সেই ছাত্রাবস্থায় “টুকলিবাজ”-দের বলা/লেখা খুবই নিম্নমানের? ওকালতি করার জন্য আইনের যে পরীক্ষা পাস করতে হয়, সে পরীক্ষায় তো শুনেছি এমন পরিস্থিতি, যে, কেউ টোকাটুকি ছাড়া পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করলে সকলে তাঁর মানসিক সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তা অসমসাহসী কেউ কি আদালতে দাঁড়িয়ে বলতে পারবেন, হুজুর ধর্মাবতার, জানি আপনি টুকে পাস, তবুও বইপত্র তো হাতের কাছেই রইল, আমার কথাটুকু শুনে যদি একটু বইটই কনসাল্ট করে রায়টা দেন, তাহলে বড় উপকৃত হই??
আবারও বলি, টোকাটুকি সমর্থনযোগ্য নয়। এবং সবাই টোকে তাই আমরাও টুকি, যুক্তি হিসেবে সেও খুবই ভুলভাল। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হলো, ডাক্তারিতে আসল ব্যাপারটা হল প্র্যাক্টিকাল। সেখানে টোকা মুশকিল। প্লাস, এখানে থিওরি-ভাইভা-প্র্যাক্টিকাল, তিনটিতেই আলাদা আলাদা করে পাস করতে হয়, প্রতিটিতে পাসমার্ক ন্যূনতম পঞ্চাশ শতাংশ। শুধু টোকাটুকির ভরসায় কেউ থিওরিতে উতরে গেলেও বাকিটা পারবেন না।)
যাক গে, বিস্তর এলোমেলো বকলাম। অনেকগুলো কথা-ই অনেকের শুনতে ভালো লাগবে না। অনেকেই এর মধ্যে অনেক কথা মানতেও চাইবেন না। কিন্তু কথাগুলো আমার মত, আমার অকপট মত।
আমাদের রাজ্য সরকার নাকি ইউক্রেন-ফেরত ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের দিকে “সহযোগিতার হাত” বাড়িয়ে দিচ্ছেন। রাজ্যের সরকারি কলেজে নাকি তাঁরা শিক্ষানবিশি সম্পূর্ণ করতে পারবেন, এমনকি সেই শিক্ষানবিশির জন্য স্টাইপেন্ড-ও পাবেন। কেস খেতে চাই না, তাই এমন সাধু উদ্যোগকে দু’হাত তুলে সাধুবাদ জানাচ্ছি। এমন ভাবনা কাজে পরিণত হলে, আমার কথাগুলো ভুল না ঠিক, তা হাতেনাতে যাচাই করে দেখার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তাও কি কম কিছু পাওনা?