প্রখ্যাত প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ রায় মশাই আজকাল পত্রিকায় একটি নিবন্ধে কথাটি লেখার অক্ষরে প্রকাশ করেছেন। ” ভদ্রলোক একটা ধারণা নিয়েই এসেছেন, সেটাই আমার উপর চাপাতে চান”। আমাদের, ডাক্তারদের এই অভিজ্ঞতা খুবই সাধারণ। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত লোকজনের এ একটা কঠিন অসুখ।
চাকরী জীবনের প্রথম দিকে, আজ থেকে প্রায় ২৩ -২৪ বছর আগে, উত্তরবঙ্গের এক প্রত্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এরকম এক রুগীর কথা এখনও চোখের সামনে ভাসছে। সম্ভবত সেইদিনই প্রথম ঐ চাকুলিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রুগী দেখেছিলাম। রুগীর, তার থেকেও বলা ভাল ,রুগীর সাথে আসা দাদার আবদার মেটাতে গিয়ে, কি বিপদটাই না হয়েছিল।
ভাবছেন ওসব গাঁগঞ্জের ব্যাপার, শহরে হয় না। ভুল। এই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি, কোলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজেই এমন অভিজ্ঞতা হল।ইমার্জেন্সিতে বসে দেখলাম, একজন জোয়ান লোককে, ট্রলিতে বসিয়ে নিয়ে ঢুকল আর দুটি ছেলে।একটি ছেলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে এসে বলল, অক্সিজেন চালিয়ে দেন তো! বললাম, কে চালাতে বলল, কাগজ দাও।
সে বলল, আমি চালাতে বলছি। একজন মিস্ত্রী বা মজুরের মত লোক এসে এরকম বলছে, এটা কোন নতুন ঘটনা নয়।
এখন বয়স হয়েছে, এসব বেয়াড়াপনা তেমন গায়ে মাখি না।কিন্তু কুকুর বেড়ালের আঁচড় কামড় খেয়ে এসে যখন বলে, টিটেনাস দিয়ে দেন তো, রাগই হয়।টিটেনাস-এর ভ্যাকসিন-এ জলাতঙ্ক আটকাবে না, এটা বোঝাতে হিমশিম খেতে হয়। সবসময় ইমারজেন্সিতে এত সময়ও থাকে না।
পিঠে চোট লাগা একটি লোকের চিকিৎসার জন্য অক্সিজেনের কি দরকার, আমার অন্তত জানা নেই। হ্যা, দরকারটা কি, অর্থাৎ যারা এসেই এটা দিয়ে দিন, ওটা দিয়ে দিন বলে, তাদের যুক্তিটা কি? এটা বোঝার জন্য ডাক্তারী পড়ার দরকার নেই।
এটা শিখেছিলাম ঐ দিনাজপুরের আর একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কাজ করার সময়।একজন অশিক্ষিত গ্রাম্যবধূ বলেছিল, “নাইআবার! তোমরা সব ব্যালাক করে দিচ্ছ”! অর্থাৎ সরকারী জিনিস, তো সে ওষুধ, স্যালাইন, অক্সিজেন যাই হোক, সেটাতো আর ডাক্তার নিজের পকেট থেকে দিচ্ছে না, তাহলে আমার একটু ইচ্ছা হয়েছে ,স্যালাইনের, ডাক্তার দেবে না কেন? নিশ্চই “বেলাক” করার জন্য রেখে দিচ্ছে।
এক এক সময় বিরক্তিকর লাগে, এসব অমানুষের সাথে তর্ক করে ,নিজের সময় নষ্ট করার ইচ্ছা থাকে না। যা চাইছে নিয়ে বিদায় হোক, এই ভেবে দিয়েও দিয়েছি।
ঐ যে চকুলিয়ার রুগী; শ্বাসকষ্ট নিয়ে এসে আবদার করল, স্যালাইন চালিয়ে দিতে হবে।বুকে কফ জমে ঘড়ঘড় করছে, তাকে স্যালাইন দেব কেন? কে শোনে কার কথা।সঙ্গের লোকটি রীতিমত চেঁচামেচি শুরু করে লোক জড়ো করে ফেলল।তার কথা হল, লক্ষণ ডাক্তার বলেছে, হাসপাতালে কি স্যালাইন নেই।বিপদ বুঝে আমার আগে থেকে ওখানে থাকা, বিএমওএইচ, ডা দাসকে ডাকলাম।ডা দাসও বোঝাতে ব্যর্থ হলেন।সিস্টারকে বললেন একটা স্যালাইন চালিয়ে দিতে।
করিডরে একটা ট্রলীর ওপর স্যালাইন চলল।একটি টুল নিয়ে ,দাদাটি বসে রইল।আমি ওদিক দিয়ে বারদুই যাওয়ার সময় দেখলাম, দাদাটি আমাকে করুণার চোখে দেখছে।
ঘণ্টাতিনেক পরে, আমার কোয়ার্টারের পিছনের জানালা দিয়ে দেখলাম, বিএমওএইচ নিজের কোয়ার্টারের পিছনের টিউবওয়েলে স্নান করছে, আর চিৎকার করে কাকে যেন ধমক দিচ্ছে।
হাসপাতালের দিকের জানালা দিয়ে দেখলাম, সকালের রুগিটি, ভ্যানরিক্সার ওপর বসে শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছে। সকালের যে দাদা এসে, রংবাজী করে, “স্যালাইন আদায়” করেছিল, সে কিন্তু আর আসেনি। আমার শহরে ফেরার তাড়া ছিল, লোকটার পরিণতি আর দেখে আসা হয়নি।
এখনতো এসব আবদার আরও বেড়েছে।সিটি স্ক্যান ফ্রি হয়ে গেছে।আজকাল আর লোকের এক্সরেতে মন ভরছে না।প্রায়ই এসে সিটি স্ক্যান করার জন্য চাপ দিচ্ছে।আমরা শহরের মেডিক্যাল কলেজে বসে তবুও বোঝাতে পারছি, মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে যে কি উৎপাত চলছে, বোঝাই যায়।
চোখের ডাক্তার হয়ে সব থেকে বিরক্তিকর লাগে, যখন ছানি পরেনি শুনে লোক আকাশ থেকে পড়ে।বারবার এমন করে জিজ্ঞাসা করে যেন, এ লোকটা ছানিপড়া কি জিনিস আদৌ জানে কি! এরাই কিন্তু বাণিজ্যিক হাসপাতালগুলোতে বেশী ভিড় করে।আবার ছানি পড়েছে, অপারেশন করে নেবেন, বলার পর, “ড্রপ লিখে দেন; চেষ্টা করেই দেখুন না, যদি সেরে যায়”, এরকম প্রায় নিরানব্বই ভাগ লোকই বলে।
উনি বাড়ী থেকে বেরনোর সময় ভেবে বেড়িয়েছেন, একটা ড্রপ লিখিয়ে নিয়ে বাড়ী ফিরবেন; তো ডাক্তার ওনার মতে লিখবেন না কেন? ঐ লেখাটার জন্যতো উনি টাকা দিচ্ছেন! ওনার টাকার জোর আছে, ওনার কথামত কাজ করবে না কেন ডাক্তার?
Correct
আপনার কথা বলার মতো আপনার লেখা ও সুন্দর। ভালো থাকবেন।