জিন আমাদের বংশের ধারাকে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যায়, এ তো বিজ্ঞান বইয়ে আমরা পড়েছি। সেই জিনের মাসতুতো ভাই হল মীম। মীম-এর জন্মদাতা প্রখ্যাত বায়োলজিস্ট রিচার্ড ডকিন্স ১৯৭৬ সালে তাঁর লেখা বই ‘ দ্য সেল্ফিস জিন’-এ লিখলেন জিন যেমন বংশগতির ধারক ও বাহক মীম তেমনি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কোন আইডিয়া, আচরণ বা স্টাইল যখন এক ব্যক্তি থেকে আর এক ব্যক্তিতে এবং এইভাবে ক্রমাগত সমস্ত সংস্কৃতি জুড়ে চারিত হয় সেই আইডিয়া বা আচরণই হল মীম। অর্থাৎ কিনা জিনের মতোই মীমও মিউটেশন ও প্রতিরূপ তৈরি করতে করতে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সংস্কৃতির ধারাকে বহন করে চলে। সমাজের ভাঙা গড়ার সঙ্গে সঙ্গে মীমেরও রূপ বদলায়।
এই মূহূর্তে সারা পৃথিবী জুড়ে ইন্টারনেট মীমের রমরমা। যদিও তারা ভাই ভাই তবুও ডকিন্সের মীমের সঙ্গে ইন্টারনেট মীমের একটা তফাৎ আছে। ডকিন্সের মীম স্বত:স্ফূর্তভাবে মানুষের আচরণের মধ্যে দিয়ে সমাজে চারিত হয় কিন্তু আজকের ইন্টারনেট মীম জনপ্রিয়তা লাভের আশায় উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তৈরি করা হচ্ছে।
বদলাচ্ছে সমাজ, বদলাচ্ছে মীমের প্রকৃতি আর স্বরূপ। হাল্কা হাসি-ঠাট্টা বা ব্যঙ্গ নয়, এখনকার মীম নির্মমতার তুঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে কখনও কখনও। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য মীম ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে রাজনৈতিক মীম আছে, সেলিব্রেটিদের নিয়ে মীম আছে, ধর্ম নিয়ে উস্কানিমূলক মীম আছে। আমরা প্রতিদিন সেগুলো দেখছি, শেয়ার করছি। হ্যাঁ, অনেক সময় দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে শেয়ার করছি। আমাদের আচরণ হাঁটি হাঁটি পা পা করে ইন্টারনেটের জগতে নিম্নরুচির সংস্কৃতির পদচিহ্ন রেখে এগিয়ে চলেছে।
কার্টুন ছবিতে রাজনৈতিক বিষয়ে বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য আগেও প্রকাশ করতেন শিল্পীরা। কিন্তু আজকের মীম অনেক ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে চরম প্রতিহিংসামূলক। ইন্টারনেটের দৌলতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার ফলে অনেক সময় যে ব্যক্তি বা সংগঠনের উদ্দেশ্যে এই মীম তৈরি হয়েছে তার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। বহু ক্ষেত্রে এই সমস্ত মীমের বিশ্বস্ততা বা চিন্তার উর্বরতা প্রায় থাকে না।
হাল্কা হাসির মেজাজ ছেড়ে অসংবেদনশীল এই সব মীম সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তা ভাবনাকে প্রভাবিত করছে যা ক্রমাগত চারিত হচ্ছে বৃহত্তর সমাজে। আলাদা আলাদা বয়সের বা সামাজিক অবস্থানের মানুষদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মীম বেশি জনপ্রিয় হতে থাকে ও শেয়ারের মাধ্যমে সেই জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির পরিচায়ক হয় ওঠে। যেমন এক গুচ্ছ মীম কিশোর কিশোরীদের মধ্যে চালু আছে যেগুলো তৈরি করা হচ্ছে তাদের নিরুৎসাহ করার জন্য। ফলে তরুণ প্রজন্ম খুব সহজেই হতাশার শিকার হচ্ছে।
কেন তৈরি হচ্ছে এমন সব মীম? যেহেতু এগুলো ছেলেমেয়েরা দেখছে এবং শেয়ার করছে তাই ব্যবসার খাতিরেই তৈরি হচ্ছে সেগুলো। তাহলে আমরা যে মীম দেখছি বা শেয়ার করছি তাই কি আমাদের সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে না? তাই সচেতন হোন সামাজিক মাধ্যমে কোন মীম শেয়ার করার আগে দু বার চিন্তা করুন। এ কথা ভুললে চলবে না বড় বাবুর যেমন গোঁফে পরিচয় আজকের দিনে আমার আপনার মানসিকতার পরিচয় তেমন মীমে।
One Response
বেশ ভালো লাগলো।