দুদিন পেছনোর পর আজ তৃতীয় দিনে সুপ্রিম কোর্টে আর জি কর বিষয়ে শুনানির ষষ্ঠ দফা হল। মাত্র ২০ মিনিটের সেশন-এ আবার সেই মুখ বন্ধ খাম পেশ এবং প্রধান বিচারপতির চলছে চলবে মনোভাব এবং ১ মাস পর আবার সিবিআই-এর আরেকটা মুখবন্ধ খাম পেশের নির্দেশ। ইতিমধ্যে কলকাতার শিয়ালদা কোর্টে মূল মামলার শুনানি শুরু হতে চলেছে ১১ নভেম্বর। এখনও পর্যন্ত সঞ্জয় রাই একমাত্র খুনি হিসাবে অভিযুক্ত। ফলে আর জি করে অভয়ার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে পথে নামা মানুষদের বড় অংশ যারপর নাই হতাশ। সে প্রসঙ্গ ব্যক্ত হয়েছে আজ এক আইনজীবির সওয়ালেও।
সাধারণত পথে নামেন না এমন বহু মানুষ বিচারের দাবীতে সরব হয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। রাজ্যের বিভিন্ন অংশে গড়ে উঠেছে নাগরিক সংগঠন। সিবিআই-এর দীর্ঘসূত্রিতা এবং অবশেষে একমাত্র সঞ্জয় রাইয়ের নামে চার্জশিট দেওয়া, সুপ্রিম কোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্তের মনিটারিং নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ায় অনেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। অনেকেরই প্রশ্ন বিচার পাওয়া যাবে তো?
একটু তলিয়ে ভেবে দেখুন, সেই ব্রিটিশ যুগ থেকে শুরু করে স্বাধীনোত্তর যুগে কটা ক্ষেত্রে আইন-আদালত- সরকার ন্যায় বিচার দিয়েছে। ব্রিটিশ যুগে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ফাঁসি, জেল, দীপান্তর থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বাবারি মসজিদ ধ্বংস, গোধরা গণহত্যা, সারা দেশে ঘটে চলা হাজার হাজার নারী নির্যাতন ও হত্যা, কটা ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার এসেছে? অভয়ার হত্যাকাণ্ড দেশ তথা বিশ্বের নানা প্রান্তে যে প্রতিবাদ ধ্বনিত করেছে তাতে আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম শাসকরা বোধহয় সহজে নত হয়ে পরবে এবং সবসময় শাসকদের পক্ষ নেওয়া ন্যায় ব্যবস্থা সত্যনিষ্ঠ হয়ে পড়বে।
যদিও এটা ঠিক প্রশাসন, আমলা, পুলিশ, তদন্তকারী, বিচার ব্যবস্থায় যুক্তদের অনেকে সৎ কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং শাসকের নিয়ন্ত্রণের জন্য এদের ক্ষমতা সীমিত। অভয়ার হত্যায় যেমন জনজাগরণ হয়েছে তেমন রাজ্যের শাসকদের সর্বোচ্চ স্তর থেকে বিচারের পথকে কেবল দুর্গম নয়, শেষ করার চূড়ান্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজ্য-কেন্দ্র সেটিং-এর তত্ত্বও ক্রমশ জোড়ালো হচ্ছে। এই আবহে সিবিআই সত্য উদঘাটনের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতে, অভয়ার বাবা-মার কাছ্ এমনকি তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ডাক্তার প্রতিনিধিদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের মধ্যে ন্যায় বিচারের আশা মাঝে মাঝে জাগিয়ে তুলেছে।
বর্তমান অবস্থায় বর্তমান আইন ব্যবস্থা সত্যিকে বের করে, প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করা ও শাস্তি বিধানের পথে হাঁটবে কিনা সে কথার উত্তর সবার মত আমার কাছেও নেই। সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে সরকারি হাসপাতালে যে দুর্নীতি, থ্রেট কালচার এবং প্রশাসনিক গুণ্ডারাজ চলছে এই আন্দোলনের চাপেই তার মুখোশ খুলে গেছে। গত তিন-চার বছরে শিক্ষা থেকে গণবন্টন, কয়লা থেকে গরু পাচার, চাকরিতে নিয়োগ, পদোন্নতি প্রভৃতি কেলেঙ্কারির সঙ্গে স্বাস্থ্য দপ্তরের দুস্কর্ম মিশে আজ সরকারের মুখ ঢাকার কোনো জায়গা নেই।
এ কথা ঠিক ভোটের বাক্সে এই অনৈতিকতার কোনো প্রতিফলন পড়ে না। আসলে আমাদের দেশে ভোট হয় না তা করানো হয়। নানা ডোল পলিটিক্স, পলিটিকাল প্রেসার (গ্রামে বেশি), গুণ্ডা দিয়ে এলাকা ম্যানেজিং এগুলোই প্রধান।
কয়েকটা কথা এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, অভয়া কিন্তু অন্যায়কে মেনে নেয় নি বলে প্রাণ দিয়েছে। সে যেকোনো সময় আর সবার মত কদর্য সিস্টেমের কাছে আত্মসমর্পন করতে পারত। সে তুলনায় আমাদের আত্মত্যাগ কতটুকু। আর আত্মত্যাগ পূর্ণ আন্দোলন ছাড়া শাসক স্বেচ্ছায় জনগণের দাবী মেনে নিয়েছে কবে? সাধারণ মানুষকে দলমত নির্বিশেষে সামাজিক সুশাসনের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। লড়াইয়ের ওপর দমন নামবে। মাঝে মাঝে মনে হবে আমরা এক কানা গলিতে ঘুরপাক খাচ্ছি। আমাদের ভাবতে হবে আমাদের পরের প্রজন্মের কথা। এই খুনি-ধর্ষকদের মদতদাতাদের হাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদ তো? লড়াইয়ে ওঠানামা হবে কিন্তু থামলে চলবে না। থামলে শাসকের নখ-দাঁত আপনার-আমার এবং সমস্ত সমাজের ওপর আরো দৃঢ় আক্রমণ শানাবে। আর ইস্পাত দৃঢ় নেতৃত্ব তৈরি হয় লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যা একমাত্র আগামীর ভবিষ্যতকে সুরক্ষা দিতে পারে। হাজার হাজার বছরের সমাজের অগ্রগতির ইতিহাস তাই বলে।
আন্দোলনের এই সন্ধিক্ষণে যখন আশা-নিরাশায় আমরা দোদুল্যমান সেই সময় আগামী ৯ মার্চ বিকেলে নাগরিক আন্দোলনের যৌথ মঞ্চ ‘অভয়া মঞ্চ’এর আহ্বানে কোলকাতার রানী রাসমণি অ্যাভিনিউ-তে জনসমাবেশে পেশ হতে চলেছে ‘জনতার চার্জশিট’। অভয়া হত্যার নায়ক ও চক্রান্তকারীদের মুখোশ খুলে যে দুর্নীতি এবং হুমকি সংস্কৃতির জন্য প্রাণ দিতে হলো অভয়াকে তার রক্ষক ও প্রশ্রয়দাতাদের আবরণ উন্মোচনই এর উদ্দেশ্য। বিচারের বাণী যদি নীরবে নিভৃতে কাঁদে তবে ‘জনতার চার্জশিট’ই হবে আগামী আন্দোলনের মূল ভিত্তি। এটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে মানুষের দাবী – ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
কাজেই আমাদের আওয়াজ হোক –
‘তিলোত্তমা ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’
ডা শুভজিৎ ভট্টাচার্য
৮ নভেম্বর, ২০২৪