দিন কয়েক ধরে জ্বরে ভুগছে ছেলেটা। এখন সিজন চেঞ্জের সময়। ভাবলাম সেই কারণেই হয়তো এই বিপত্তি। বাড়িতে ঘরোয়া মেডিসিন বক্সে থাকা খুব চেনা একটা ট্যাবলেট দিয়েই চিকিৎসা পর্বের শুরু। জ্বর কমলো না দেখে চিন্তা বাড়লো। তিন দিনের মাথায় সোজা ডাক্তারবাবুর চেম্বারের দ্বারস্থ হলাম বাপ বেটা। খানিকক্ষণ স্টেথোস্কোপ ঠেকিয়ে এদিক ওদিক দেখে গম্ভীর গলায় ডাক্তারবাবুর উত্তর – এখনি চিন্তার কিছু নেই , তবে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। সিম্পটম দেখে মনে হচ্ছে – a case of typhoid। কথাকটি বলেই নিদানপত্রে খসখস করে গোটাকয়েক এন্টিবায়োটিক ওষুধের নাম লিখে দেন। রক্ত পরীক্ষা করে রিপোর্ট নিয়ে দুদিন পর আবারো যেতে বললেন।টাইফয়েড – একটি ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগের নাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে Salmonella enterica serotype বা Salmonella Typhy নামের এক শ্রেণির ব্যাকটেরিয়া এই বিশেষ ধরনের জ্বরের মূল কারণ। একবার আক্রান্ত হলে জ্বরের প্রকোপ চলে বেশ কয়েকদিন ; সঙ্গে বাড়তে থাকে অন্যান্য উপসর্গ যেমন দুর্বলতা, তলপেটের ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথায় যন্ত্রণা, বমনেচ্ছা ইত্যাদি। কোনো কোনো রোগীর শরীরে লাল রঙের rash বের হয়। রোগের স্থায়িত্ব বাড়লে ডায়েরিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। সাধারণত খাবার ও জলের মধ্য দিয়ে এই ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। আনুষাঙ্গিক জটিলতা না বাড়লে সাধারণ এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করেই এতকাল টাইফয়েডকে বাগ মানিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা। আর এখন?
খুব সম্প্রতি বিখ্যাত ল্যানসেট পত্রিকায় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Jason Andrews এক গবেষণা পত্র প্রকাশ করে জানিয়েছেন যে, “অত্যন্ত দ্রুত হারে টাইফয়েড রোগের প্রকোপ বেড়ে পেছনে রয়েছে যে ব্যাকটেরিয়া – Salmonella typhi সেটি এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। বিষয়টি গভীর উদ্বেগের।” আগে অত্যন্ত সাধারণ ট্যাবলেট দিয়েই যে রোগের প্রতিকার করা সম্ভব হতো তা যদি এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহার করেও নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে তো দুশ্চিন্তা বাড়বেই।
কেন এমন হলো?ব্যাকটেরিয়ার মতো বহিরাগতরা শরীরের মধ্যে ঢুকেই ঝটপট মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করে। এন্টিবায়োটিকের কাজ হলো ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় দ্রুততর গতিতে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করা। মজার বিষয় হলো এই যে প্রথম চক্করের দৌড়ে অণুজীবী ব্যাকটেরিয়ারা বেশ কয়েক কদম এগিয়ে থাকে। এমন হবার কারণ হলো অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় কম মাত্রায় এন্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয় অথবা খোদার ওপর খোদকারি করে নির্ধারিত সময়ের আগেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরফলে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে।
ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ৩৪৮৯ আইসোলেটের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই টাইফয়েড ক্ষমতা অর্জনকারী ব্যাকটেরিয়ারা টাইফয়েড জ্বরের সম্ভাব্য অণুজীবদের তুলনায় সংখ্যায় বেড়ে গেছে অনেকটাই। জেনোমিক পরীক্ষার এই ফলাফলে রীতিমতো উদ্বিগ্ন চিকিৎসক সমাজ।
গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু কিছু আইসোলেট তিন তিনবার DNA– gyrase genes এ মিউটেশনে সক্ষম হয়েছে যারফলে Ciprofloxacin এর প্রয়োগমাত্রা হাজার গুণের বেশি বেড়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবনায় ভাবিত। ইতোমধ্যেই ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্য ২০০০ সালেই তৃতীয় প্রজন্মের cephalosporins এবং পরবর্তীতে Ciprofloxacin রণক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু আজ ২৫ বছর পর সমীক্ষা চালাতে গিয়ে দেখা গেছে যে ভারতের গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদের একগুচ্ছ নমুনা Cetfriaxone, ampicillin, Ciprofloxacin এবং trimethoprim- sulfamethoxazole এর মতো এন্টিবায়োটিকস্ প্রতিরোধে সক্ষম হয়ে উঠেছে। গবেষকদের মতে এ সময় পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী Cetfriaxone প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন টাইফয়েড।
এন্টিবায়োটিকরা কি পিছিয়ে পড়লো?এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত গবেষকেরা। তাঁরা লক্ষ করেছেন যে Azithromycin এখনও টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁদের বিশ্বস্ত হাতিয়ার। পাকিস্তানের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এই ওষুধের প্রয়োগের ফলে ব্যাকটেরিয়ার দাপট অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা এজিথ্রোমাইসিন প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার খোঁজ পেয়েছেন যা টাইফয়েড রোগের চিকিৎসা নিয়ে চিন্তা বাড়িয়েছে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ২০১৩ সালের পর থেকে অন্যূন সাতটি পর্যায়ে ব্যাকটেরিয়ারা নিজেদের মিউটেশনের মাধ্যমে অভিযোজিত করে নিয়েছে আমাদের অজান্তেই। এমনটা সত্যি হলে আগামীদিনে টাইফয়েডের নিরাময় কেবল জটিল নয়, হয়তো যথেষ্ট ব্যয়বহুল হবে। এই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই বর্তমানে তিন ধরনের টাইফয়েড ভ্যাকসিন প্রয়োগের অনুমতি মিলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে। তবে এই ভ্যাকসিনগুলো কেবলমাত্র টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে না, পাশাপাশি আরও কয়েকটি রোগের বিরুদ্ধেও শরীরী প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে। ২০১৯ সালে পাকিস্তান প্রথম এই ধরনের ভ্যাকসিনের ব্যবহার শুরু করে। ভারতীয় চিকিৎসকরা মনে করেন ভ্যাকসিন সফল হলে দেশে টাইফয়েডে মৃত্যুর সংখ্যা এই সময়ের তুলনায় এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। বেঁচে যাবে হসপিটালাইজেশনের বিলাসী খরচ। ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সবাইকে চিন্তামুক্ত করবে এই আশা করি।
তথ্যসূত্র: Earth.com
জুলাই ২,২০২৫.
আরও একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রয়োজনীয় আলোচনা উপহার দেবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাই। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াদের ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স হয়ে ওঠার পেছনে আমরাই অনেকাংশে দায়ী। আমরা নিজেরাই নিজেদের চিকিৎসক। ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে নিজেই খাচ্ছি। যদি ভ্যাকসিন আসে তাহলে ভালো। লেখাটি পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। এমন সুখপাঠ্য মনোগ্রাহী লেখা আরও চাই।
এভাবে মতামত জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানাই। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে হবে। এন্টিবায়োটিকসের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদেরও বোধহয় সতর্ক থাকতে হবে একটু বেশি করে।
Quite interesting and I’m enriched with the knowledge! Never bothered to know about typhoid before. Though many near ones had gone through this before, but one never gave it much thought. The danger of the germs being capable to defeat anti biotics is the immediate cause of concern! Shall be waiting for more of such articles from the writer.
I am not a medical practitioner. My interest about various subjects inspire me write these articles related to the medical science. Its really a matter of great concern that bacterias are gradually getting resistant. We need to be very concerned about. Thanks for your encouragement.