হিজাব নিয়ে বিতর্কে যেহেতু অনেকবার ইউনিফর্ম প্রসঙ্গ এসেছে তাই দু’চার কথা।
স্কুল ইউনিফর্মের ভক্তদের যদি জানতে চাওয়া হয় যে ইউনিফর্মের সাথে বিদ্যভ্যাস বা বিদ্যা অর্জনের কি বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক, তখন তাঁরা চুপ করে যান। সোভিয়েত বিপ্লবের পরে বিখ্যাত শিক্ষাবিদ লুনাচারস্কি যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে ছিলেন তাতেও ইউনিফর্ম চালু ছিল না। সোভিয়েত শুনে এলার্জি আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে নজর ফেরান। সেখানে আজ ৮০% স্কুলে ইউনিফর্ম নেই। সে সব ছাত্র ছাত্রীরা লেখাপড়া শিখছে না এমন অপবাদ অতি বড় মার্কিন বিরোধীরাও দেবেন না। আমাদের দেশে বহুদিন স্কুলে ইউনিফর্ম বলে কোনো প্রথা চালু ছিল না। বিদ্যাসাগর, জগদীশ বোস, মেঘনাদ সাহা ওসব ছাড়াই দিব্যি লেখাপড়া শিখেছিলেন। হ্যারো ইটন জাতীয় পাবলিক স্কুলগুলো ফেরত আইসিএসদের চালু করা এসব উপনিবেশিক ধাসটামো অনেক হয়েছে। আর না।
ডিসিপ্লিন ভক্তদের এটা জানা উচিত যে এসব আসলে হচ্ছে ছোট বেলা থেকে ডিসিপ্লিনের নামে অথরিটির প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যবোধ গড়ে তোলার কলকাঠি। ওসব ফৌজে চলতে পারে, স্কুলে তার কোনো জায়গা নেই। সেখানে প্রশ্ন জেগে ওঠার অভ্যাস, অথরিটিকে চ্যালেঞ্জ করার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। পেটার্নালিস্টিক শাসন ব্যবস্থা নয়, শিশু মনে যুক্তির সবলতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, না হলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার
যারা স্কুলের আট ঘণ্টা ইউনিফর্ম দিয়ে শিশুমনে ধনী দরিদ্রের বিভেদ ঘুচিয়ে দেওয়ার তত্ত্বে বিশ্বাসী তাদের বলা যে শিশুদের এত নির্বোধ ভাবার কোনোই কারণ নেই। পাশের বন্ধুর টিফিন বাক্সের গন্ধে আমোদিত যে বালিকটি আঁজলা আঁজলা জল পান করে পেটে খিদের মোচড় ভোলার চেষ্টা করে, টিফিন পিরিয়ডে বা স্কুল ছুটির পরে বাড়ি ফেরার পথে দ্রুত পদাতিক যে বালকটির সাধের ইউনিফর্মে জল কাদা ছিটিয়ে যায় তারই সহপাঠীর মোটরগাড়ি, তাকে গরীব বড়লোকের প্রভেদ জানতে হয় না, সে এমনিই জেনে যায়, হাজার ইউনিফর্ম না পারে সেটা ভোলাতে না পারে ঘোচাতে। সতিকারের মানবতাবাদী হলে ইউনিফর্ম দিয়ে মানবতা প্রমোট করার প্রবঞ্চনার তত্ব ছেড়ে বৈষম্যমূলক, শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার কাজে আসুন।
এত কিছু লেখার পরে যেটা বলার থাকে যে ইউনিফর্ম নিয়ে এই বিতর্ক টা আসলে অবান্তর। মার্কস দেখিয়েছিলেন যে অর্থনীতি হচ্ছে ভিত্তি আর বাকি সব উপরিকাঠামো। ভিত্তি না পাল্টালে উপরিকাঠামোতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। গ্রামসি দেখিয়েছিলেন যে, কি ভাবে শাসক শ্রেণী আমাদের আটকে রাখতে চায় উপরিকাঠামোর অবান্তর লড়াইয়ে। কারণ ওরা জানে যে ওটা ওদের স্ট্রং পয়েন্ট, পরিচিত খেলার মাঠ আর ভিত্তির লড়াইটা ওদের উইক পয়েন্ট, অপরিচিত খেলার মাঠ। মিলিয়ে দেখুন গ্রামসির কথা।
কাশ্মীরে অবস্থাপন্ন ঘরের মেধাবী ছাত্রী আরুশা পারভেজের হিজাব পরার ইসলামী মৌলবাদী ফতোয়া কুৎসিত, অমানবিক, ফ্যাসিস্ট এটা দ্বিধাহীন ভাবে বলা যায়, প্রতিবাদের ঝড় তোলা দরকার তাও বলা যায়। কিন্তু সে নিয়ে বা কর্ণাটকের হিজাব নিষিদ্ধ নিয়ে আমরা যতটা উদ্বেল, যতটা প্রতিবাদী তার ভগ্নাংশের ভগ্নাংশ কি আমরা উদ্বেল কাশ্মীরে লক ডাউনের ফলে যে হাজার হাজার কর্মচুত শ্রমিকদের ছেলেপুলের লেখা পড়ার কি ব্যবস্থা হল, কতজন অর্থাভাবে স্কুল ছুট হয়ে গেল চিরতরে, অভাবের তাড়নায় শিশু শ্রমিক হয়ে গেল, সরকার কি করলো সে সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য এসব নিয়ে উদ্বেল, প্রতিবাদী ?
হিজাব চয়েস কি চয়েস না সে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা সময় কাটানো মানুষজন জীবনে বললো না কেন স্বাধীনতার এত বছর বাদেও অসংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকদের পারিশ্রমিকে বৈষম্য, কেন বেসরকারি ক্ষেত্রে তাদের মাতৃত্ব কালীন ছুটি দিতে এত টালবাহানা।
আসলে আমরা বরাবর ওদের ন্যারেটিভের ফাঁদে পা দিয়ে ওদের মাঠে খেলতে যাই আর হেরে গিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। ওদের বাধ্য করতে হবে আমাদের মাঠে খেলতে। দেখাই যাক না কে জেতে। ওদের সিলেবাস, ওদের প্রশ্নপত্রের পরীক্ষা আমরা দেবো না, আমাদের সিলেবাস আমাদের প্রশ্নপত্রের পরীক্ষা দেয়াবো ওদের। আমাদের তাই বিতর্কটা স্কুল ইউনিফর্ম নিয়ে নয়, শিক্ষার সর্বজনীন অধিকার কতটা সম্প্রসারিত হলো সে নিয়েই করা যাক।