গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণের রাজপ্রাসাদে প্রাত্যহিক কর্মব্যস্ততায় সম্প্রতি কিছু অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হইতেছে। প্রায় পক্ষকাল যাবত মহারাজ শশাঙ্কদেব রাজসভায় অনুপস্থিত আছেন। তাঁহার আকস্মিক অন্তরালবাসের কোনও তাৎপর্য রহিয়াছে কিনা সে বিষয়ে রাজপুরীতে বিশেষ কেহ জ্ঞাত নহে।
কিছুকাল পূর্বে প্রাসাদে রাজবৈদ্যের আগমন হইয়াছিল। রুদ্ধদ্বার শয়নকক্ষে পিতার সহিত রাজবৈদ্য যোগদত্তের কি কথোপকথন হইল, দ্বারের বাহিরে দণ্ডায়মান গৌড়ের যুবরাজ মানব তাহা জানিতে পারিলেন না।
বস্তুত, মাসাধিককাল হইতেই মানব তাঁহার পিতার আচরণে বাহ্যিক পরিবর্তন লক্ষ্য করিতেছিলেন। পিতার দেহ ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হইতেছে। খাদ্যরসিক মহারাজের নিত্যদিনের আহার্য গ্রহণে সবিশেষ রুচি লক্ষিত হয় না।
যদিচ, রাজকার্য সুষ্ঠুভাবে চলিতেছে। কামরূপরাজ ভাস্করবর্মা পুনরাক্রমণের দুঃসাহস করেন নাই। পুষ্যভূতিরাজ হর্ষবর্ধন গোতমচরণাশ্রিত হইয়াছেন — পররাজ্য আত্মসাতে তাঁহার বিপুল অনীহা!
তথাপি গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেবের মনে সুখ নাই, শান্তি অধরা। স্বীয় পুত্রের সহিত সহৃদয় বাক্যালাপে তাঁহার প্রবল অনাসক্তি প্রকাশ পাইতেছে। রাণী চিত্রাদেবী উত্তরোত্তর উদ্বিগ্নমনা হইয়া উঠিতেছিলেন। অবশেষে রাজবৈদ্যের আগমন সম্পর্কে অবহিত হইয়া পুত্রকে আপনার সমীপে আহ্বান করিলেন।
মানব মাতৃসন্দর্শনে আসিয়া রাণীকে যথাবিহিত অভিবাদনপূর্বক আসন গ্রহণ করিলেন।
চিত্রাদেবী বিচলিত কণ্ঠে কহিলেন — “পুত্র, আজ বৈদ্যশ্রেষ্ঠ যোগদত্ত আসিয়াছিলেন। এ বিষয়ে তুমি অবগত আছো কি?”
যুবরাজ কোমলস্বভাব, শান্তিপ্রিয় যুবক। পিতার সাম্প্রতিক মানসিক অস্থিরতার কারণ অনুসন্ধান করিবার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা তাঁহার হয় নাই। মহারাজাধিরাজের চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করা তাঁহার অসাধ্য। তবে বৈদ্যের আগমনে মানবও কিঞ্চিৎ আশ্চর্য ও চিন্তান্বিত হইয়াছিলেন।
তিনি অনিশ্চিতভাবে মস্তক আন্দোলিত করিয়া কহিলেন — “না, বৈদ্যরাজের আগমনের কারণ সম্পর্কে আমি অবহিত নহি মাতা — ক্ষমা করিবেন। তবে কিছুকাল যাবত পিতার আচরণ আমার অস্বাভাবিক বোধ হইতেছে। তিনি রাজসভায় উপস্থিত না-ই থাকিতে পারেন, কিন্তু মহামন্ত্রী বা অমাত্যবর্গের সহিত সাক্ষাৎ না করিবার হেতু আমি উপলব্ধি করিতে পারি নাই, এ কথা স্বীকার করিতেছি।”
রাণী ব্যাকুলস্বরে কহিলেন – “পুত্র, ইহা ব্যক্ত করা আমার পক্ষে অতীব লজ্জার — কিন্তু সঙ্কটকালে লজ্জা, ঘৃণা, ভয় সকলই ত্যাজ্য। তোমার জানা আবশ্যক যে বিগত এক পক্ষকাল তোমার পিতা অবরোধের অন্দরেও পদার্পণ করেন নাই — দুই সপ্তাহ আমি তাঁহাকে চাক্ষুষ করি নাই বৎস।”
মানব চমকিত হইলেন। তাঁহার জনকজননীর মধ্যে গাঢ় সদ্ভাব ছিল, পরস্পরের দীর্ঘ অদর্শন উভয়ের কেহই সহ্য করিতে পারিতেন না। যুদ্ধযাত্রা ব্যতীত তাঁহার পিতা দীর্ঘকাল মাতার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া একই প্রাসাদে দিনাতিপাত করিবেন, ইহা যুবরাজের কল্পনাতীত।
মানব বিশেষ চিন্তিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন — “এক্ষণে আমাকে কি করিতে আদেশ করেন মাতা?”
রাজবৈদ্যের আকস্মিক আগমন এবং কাহারও সহিত আলোচনা ব্যতীত দ্রুত নিষ্ক্রমণ তাঁহার লঘু, শান্ত চিত্তকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিয়াছিল।
চিত্রাদেবীর কিন্তু পুত্রের প্রশ্নের উত্তর করিবার অবকাশ রহিল না।
মাতা-পুত্রের জল্পনার মধ্যেই দৌবারিক আসিয়া সংবাদ দিল, শশাঙ্কদেব যুবরাজকে স্মরণ করিয়াছেন।
অতুলৈশ্বর্যে সজ্জিত গৌড়াধিপতির নিভৃতকক্ষে কুণ্ঠিত পদক্ষেপে প্রবেশ করিয়া মানব দেখিলেন, পিতা শয্যায় শুইয়া আছেন। দক্ষিণহস্ত ললাটের উপর ন্যস্ত। পুত্র নিঃশব্দে পিতার শয্যাপার্শ্বে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহার বামহস্তটি আপন করতলে ধারণ করিলেন। মহারাজ কিন্তু চক্ষু ফিরাইলেন না। কিছুক্ষণ এইরূপে কাটিবার পরে মানব পিতার নিকট আপন উপস্থিতি জ্ঞাপন করিলেন – “পিতা কি আমাকে স্মরণ করিয়াছেন?”
শশাঙ্ক চমকিত হইয়া চাহিলেন। “পুত্র! কখন আসিলে? আমি জানিতে পারি নাই!”
মানব সবিস্ময়ে কহিলেন — “আমি যে আপনার হস্তধারণ করিয়া বসিয়া আছি পিতা। আপনি তো নিদ্রা যান নাই – তথাপি জানিতে পারিলেন না?”
শশাঙ্কদেব ধীরে ধীরে নিজ বামহস্ত যুবরাজের বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া লইলেন। তাহার পর বাহুখানি চক্ষের সম্মুখে আনিয়া অতীব মনোযোগে নিরীক্ষণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। গৌড়েশ্বরের বাম বাহুর অঙ্গুলি হইতে কফোণি পর্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শ্বেত ও লোহিত চিহ্নে ভরিয়া গিয়াছে।
মহারাজ শিশুর ন্যায় ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন – “মানব, আমার হস্তে কোনো স্পর্শানুভূতি নাই। সন্দেহ নিরসনে যোগদত্তকে আহ্বান করিয়াছিলাম। তিনি রোগ নির্ণয় করিয়া গিয়াছেন। কুষ্ঠ! আমার কুষ্ঠ হইয়াছে!”
দুই করতল দ্বারা আপন মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত করিয়া গৌড়বঙ্গের অবিসংবাদী রাজাধিরাজ হুহুরবে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন।
তাঁহার পদতলে চিত্রার্পিতের ন্যায় নির্বাক যুবরাজ মুহ্যমান হইয়া বসিয়া রহিলেন।
উপরোক্ত ঘটনার পরে ছয়টি চান্দ্রমাস অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে।
কান্যকুব্জের রাজসভায় হর্ষবর্ধন মন্ত্রীমণ্ডলীর সহিত মন্ত্রণায় ব্যাপৃত ছিলেন। হেনকালে প্রতিহার আসিয়া সংবাদ দিল, গৌড়ে নিযুক্ত কান্যকুব্জের গূঢ়পুরুষ কুন্তল বিশেষ প্রয়োজনে রাজার সাক্ষাৎপ্রার্থী।
হর্ষ অনুমতিসূচক ঘাড় নাড়িলেন।
অল্পক্ষণ পরে যখন কুন্তল সভায় প্রবেশপূর্বক রাজাকে অভিবাদন করিয়া তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল, তাহার মুখভাব দেখিয়া হর্ষবর্ধন বিস্মিত হইলেন। “কি সমাচার, কুন্তল? তোমার মুখ দেখিয়া বোধ হইতেছে কোনও কারণে তুমি বিশেষ আহ্লাদিত হইয়াছ!”
কুন্তল হাস্যবিম্বিত বদনে প্রত্যুত্তর করিল — “আহ্লাদিত হইবার তুল্য সংবাদই আনয়ন করিয়াছি মহারাজ। শুনিয়া সমগ্র কান্যকুব্জ আনন্দে উদ্বেল হইয়া উঠিবে।”
হর্ষ সপ্রশ্নমুখে চাহিয়া রহিলেন, উপস্থিত রাজপুরুষগণ সুসমাচার শ্রবণ করিবার অধীর আগ্রহে উৎকর্ণ হইয়া উঠিলেন।
কুন্তল নাটকীয়ভাবে কহিতে লাগিল — “ধর্মশত্রু তাহার কুকীর্তির যোগ্য শাস্তি পাইয়াছে রাজন। ভগবান আপন হস্তে সেই দুরাচারী দুর্বৃত্তের প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করিয়াছেন। পূর্বতন মহারাজ রাজ্যবর্ধনের বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঋত্বিক গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক তাহার পাপের উপযুক্ত দণ্ড পাইয়াছে। তাহার কুষ্ঠ হইয়াছে রাজন, কুষ্ঠ! বৈদ্য রোগ চিহ্নিত করিয়া নিদান দিয়া গিয়াছে, এই রোগের কোনও নিরাময় নাই। ধীরে ধীরে গৌড়েশ্বরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গলিত হইয়া খসিয়া পড়িবে, দুর্গন্ধে কেহ নিকটে আসিবে না, আপন পুত্রও সেই কদাকার বিকলাঙ্গের মুখদর্শন করিবে না, পাপিষ্ঠ একাকী স্বকৃত পাপের ভার বহিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইবে –“
“স্তব্ধ হও” — হর্ষের আকস্মিক রুদ্ধ গর্জনে কুন্তল সচকিত হইয়া থামিয়া গেল। সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী চমকিত হইয়া তাঁহার মুখপানে চাহিলেন। হর্ষের মুখ অবর্ণনীয় বেদনায় বিকৃত হইয়া গিয়াছে। ললাট রক্তিমাভ, অধর কম্পিত, চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হইয়াছে।
কুন্তল মূক বিস্ময়ে চাহিয়া রহিল, মন্ত্রী-অমাত্যবর্গ পরস্পরের মধ্যে বিস্মিত দৃষ্টিবিনিময় করিলেন।
কিয়ৎকাল পরে সম্রাট হর্ষবর্ধন আত্মসংবরণ করিয়া কহিলেন — “কোনও মনুষ্যের দুর্ভাগ্যজনক দুরারোগ্য ব্যাধির সংবাদে আনন্দিত হওয়া কাপুরুষোচিত কর্ম — নিন্দার্হ তো অবশ্যই। সেই মনুষ্যের দ্বারা অতীতে যত ক্ষতিসাধনই হইয়া থাকুক, তাহার ক্লেশে পুলক অনুভব করা নিতান্ত অমানবিক। কুন্তল, বিস্মৃত হইও না যে শত্রু রাজ্যের নৃপতি হইলেও শশাঙ্কদেব একজন রাজা। বাক্যে তাঁহার প্রতি বিশেষণ প্রয়োগে তোমার অধিক যত্নবান হওয়া উচিত ছিল।”
ভূষণবর্মা আর সহ্য করিতে পারিলেন না।
স্বীয় আসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তিনি উচ্চকণ্ঠে কহিলেন — “ক্ষমা করিবেন মহারাজ, কিন্তু আমি পূর্বেও যে মত ব্যক্ত করিয়াছি, এক্ষণেও তাহাই করিব। কপট ষড়যন্ত্রকারীর দুর্ভাগ্যে সমব্যথী না হইলে অধর্ম হয় না। স্মরণ করুন রাজন, এই ব্যক্তি আপনার জ্যেষ্ঠভ্রাতা, আমার পরম মিত্র রাজ্যবর্ধনের অকালপ্রয়াণের জন্য দায়ী। এই ধর্মান্ধ পাপিষ্ঠ বৌদ্ধবিহারে অগ্নিসংযোগ করিয়া, বোধিবৃক্ষের নির্মম কর্তন করিয়া, পবিত্র বুদ্ধশিলার বিসর্জনের আয়োজন করিয়াছিল। ইহার দুরারোগ্য ব্যাধির সংবাদে আমি অন্তত বিন্দুমাত্র দুঃখিত বোধ করিতেছি না।”
হর্ষ বিষণ্ণ নতমুখে ভূষণবর্মার বক্তব্য শ্রবণ করিতেছিলেন।
দণ্ডাধিনায়ক আপন ক্ষোভ ব্যক্ত করিয়া নীরব হইলে হর্ষ মুখ তুলিয়া চাহিলেন। তাঁহার চক্ষু করুণার্দ্র, মুখচ্ছবিতে গভীর সন্তাপের চিহ্ন অঙ্কিত রহিয়াছে। তিনি ধীরস্বরে সভাস্থ সকলকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন — “ধর্মান্ধতাকে কেবল ক্ষমার দ্বারা পরাভূত করা সম্ভব। আমার ধর্ম আমাকে এই শিক্ষাই দিয়াছে। কিন্তু তাহা আমি কাহারও উপর বলপূর্বক আরোপ করিতে চাহি না। কল্য প্রাতঃকালে আমি সপরিবার প্রয়াগের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিব। আগামী পূর্ণিমাতিথিতে ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নানের পরে সেই স্থানে আগত সকল দীন-দুঃখী-আতুরের সাহায্যকল্পে আমার কোষাগার উন্মুক্ত করিয়া দিবার অঙ্গীকার করিতেছি। উক্ত পুণ্যদিনে পুষ্যভূতিসম্রাট হর্ষবর্ধনের সমীপে আগত কোনও প্রার্থী রিক্তহস্তে ফিরিয়া যাইবে না।”
ঘোষণা সমাপ্ত করিয়া হর্ষ সভায় উপস্থিত রাজকোষাধ্যক্ষের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন — ”বিজয়বর্মা, অদ্য সন্ধ্যায় মন্ত্রণাগৃহে আপনার সহিত আমার কিছু নিভৃত আলোচনা রহিয়াছে।
আশা করি, যথাসময়ে আপনার সাক্ষাৎ পাইব।”
রাজা দণ্ডায়মান হইলেন। সভাভঙ্গের সূচনায় সকলেই গমনোদ্যত হইল। হর্ষ যুক্তকরে সকলকে প্রণাম জানাইয়া মৃদুস্বরে কহিলেন — “আমার সহিত কাহাকেও সহমত পোষণ করিতে বাধ্য করিব না। অদ্য আমি আমার ভগিনী পরমসৌগতা রাজ্যশ্রীর সহিত তথাগত বুদ্ধের চরণে গৌড়াধিপতি শশাঙ্কদেবের আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করিব। গোতম তাঁহাকে ক্ষমা করুন। বোধিসত্ত্ব তাঁহার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলসাধন করুন।”
কর্ণসুবর্ণ নগরে নিতান্ত অনাড়ম্বরে যুবরাজ মানবের রাজ্যাভিষেকের প্রস্তুতি চলিতেছে। নগরীর কাহারও মনে আনন্দ নাই।
মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেবের অন্তিমকাল উপস্থিত হইয়াছে। রোগপাণ্ডুর বয়ানে এই অহঙ্কারী বীর নরাধিপতি মৃত্যুশয্যায় শায়িত — তাঁহার শিয়রে শোকস্তব্ধ নগরী সেই চরম ক্ষণটির অপেক্ষায় নির্নিমেষ নয়নে জাগিয়া আছে।
শশাঙ্কের মুখমন্ডলে বারেকমাত্র দৃষ্টিপাত করিয়া তাঁহার অন্তরঙ্গ জীবদত্ত পর্যন্ত আঁখি ফিরাইয়া লইলেন। বীভৎস জীবাণু রাজার মুখাবয়বে ভয়াবহ করাঙ্কচিহ্ন আঁকিয়া দিয়াছে। চক্ষুদ্বয় গলিত — চর্মের সহস্র ক্ষতমুখ হইতে পুঁজরক্ত ঝরিয়া পড়িতেছে। ব্যথাবেদনার বোধ রহিত হইয়াছে। জ্ঞান নাই।
নিদারুণ প্রতীক্ষায় সমস্ত রাত্রি কাটিয়া গেল। রাজপণ্ডিত অনঙ্গদেব শর্ম্মা কক্ষদ্বারে বসিয়া উচ্চকণ্ঠে শিবস্তোত্র পাঠ করিতে লাগিলেন। রাজার শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রমশ স্তিমিত হইয়া আসিল। মৃত্যুর ঘ্রাণে কক্ষমধ্যস্থ বাতাস ভারী হইয়া উঠিল। অবশেষে পূর্বদিকস্থ বাতায়নপথে দিনমণির প্রথম রশ্মি আসিয়া রাজাধিরাজের ললাট চুম্বন করিবামাত্র এই বঙ্গকেশরীর প্রাণবায়ু তাঁহার রুদ্রের সহিত মিলিবার আকাঙ্ক্ষায় অনন্তের পথে চিরতরে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।
সেইদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দুর্ভাগা গৌড়বঙ্গের ভাগ্যাকাশ শতাব্দীব্যাপী তমসা আসিয়া ছাইয়া ফেলিল। এক দুর্ভাগা দর্পিত বীরের অস্তাচলে যাইবার লগ্নে গৌড়লক্ষ্মীও মুখ ফিরাইলেন — শত বৎসরের পূর্বে সে নৈরাজ্যের যবনিকা আর উঠিল না।
(আগামী পর্বে সমাপ্য)