(এই লেখাটির একটি সংক্ষিপ্ত ও ভিন্ন ভার্সন আনন্দবাজার পত্রিকায় (১১.০৬.২০২৫) উত্তর সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে)
এ বছরের ইন্টারন্যাশনাল পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন-এর ৩১তম আন্তর্জাতিক কনফারেন্স হয়েছে মেক্সিকো সিটিতে, ৯-১১ মে, ২০২৫। এই কনফারেন্সে থেকে মোট ১১ জন চিকিৎসক (ভারতের ৬ জন, পাকিস্তানের ৫ জন) যৌথভাবে একটি বিবৃতি দেন এবং ২৮ মে, ২০২৫-এ ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত হয় “স্টেপিং ব্যাক ফ্রম দ্য ব্রিংকঃ টাইম ফর রিজন অ্যান্ড র্যাপ্রোচমেন্ট বিটুইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান” শিরোনামে।
এদের বিবৃতিতে এক নিঃশ্বাসে ভারতের পহলগামে নিরীহ ভ্রমণকারীদের সন্ত্রাসবাদী হত্যা এবং বালোচিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেনকে হাইজ্যাক করা, দুটোরই নিন্দা করা হয়েছে। এদের বিবৃতি আমাদের পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ভারত এবং পাকিস্তান দুটি দেশই জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যের সামাজিক নির্ধারক শক্তি (‘সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অফ হেলথ’), আবহাওয়ার পরিবর্তন, এনভায়রনমেন্টজনিত সমস্যা এবং স্বাস্থ্য ও সার্বিক বিকাশের ন্যায়ের মাঝে বিদ্যমান ফারাককে কমিয়ে আনা – এসমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দুটি দেশই সামরিক এবং পারমাণবিক অস্ত্রের খাতে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে। দুটি দেশই মানুষের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খরচ করেছে। শুধু এটুকুই নয়, একটি গোটা প্রজন্ম ইতিহাসের বিকৃত ব্যাখ্যা ও মূল্যবোধ, অভাবিতপূর্ব উগ্র দেশপ্রেম, এবং এগুলোকে জ্বালানি-জোগানো পপুলার সংস্কৃতি, সিনেমা, দলীয় এবং সামাজিক মিডিয়ার যৌগপদ্যে ভিন্নভাবে বেড়ে উঠছে।
এদের বক্তব্য হল – “স্বাস্থ্যপরিষেবার সঙ্গে যুক্ত পেশাজীবী মানুষ হিসেবে আমরা অবশ্যই দীর্ঘায়ত সংঘর্ষের বিপদ এবং এর ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়া নিয়ে কথা বলবো। এই দুটি দেশেরই শিশু মৃত্যুর হার এদের আশেপাশের দেশগুলোর থেকে অনেক বেশি। শৈশব এবং বয়ঃসন্ধিকালের পুষ্টির অভাব পৃথিবীর ক্ষেত্রে সর্বাধিকের মধ্যে পড়ে … শিশুচিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যপরিষেবার পেশাজীবী মানুষ হিসেবে আমরা সংঘর্ষ এবং এর পরিণতির বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলছি। আমরা আমাদের রোগি এবং আগামী প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ।”
যুদ্ধের বিরুদ্ধে চিকিৎসকদের এরকম অবস্থান ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বর্তমান প্রেক্ষিতে আমাদের কাছে অন্যরকমের মনে হলেও, চিকিৎসকদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান ইতিহাসে নতুন নয়। অনেকেই হয়তো বিখ্যাত জার্মান চিকিৎসক-বিজ্ঞানী রুডলফ ভিরচাঊ (১৮২১-১৯০২)-এর নামের সঙ্গে পরিচিত। তিনি নিজে ঘোষিত যুদ্ধবিরোধী ছিলেন। তাঁর সেই বিখ্যাত পর্যবেক্ষণ – মেডিসিন একটি সমাজবিজ্ঞান, এবং রাজনীতি একটি প্রসারিত চেহারায় মেডিসিন ছাড়া আর কিছুই নয়। সমাজবিজ্ঞান হিসেবে, মানুষের বিজ্ঞান হিসেবে, মেডিসিনের দায়বদ্ধতা আছে সামাজিক সমস্যাকে চিহ্নিত করা এবং সেগুলোর তাত্ত্বিক সমাধানের চেষ্টা করার জন্য।
স্পেনে ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদী, স্বৈরতন্ত্রী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য (১৯৩৬-১৯৩৯) একটি ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড’ তৈরি হয়েছিল। হেমিংওয়ের মতো বহুসংখ্যক লেখক-শিল্পী-কৃতবিদ্য মানুষের অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তরফে নেহেরু, মুলক রাজ আনন্দ ও কৃষ্ণ মেননের উদ্যোগে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো – এত বৃহৎ ছিল আন্তর্জাতিকভাবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রতিরোধের এই বর্ণালী।
(উপরে জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে পাঠানো অ্যাম্বুলেন্স। নীচে জওহারলাল নেওরু ও অন্যান্যরা)
(হেনিংওয়ে (মাঝখানে) – স্পেনের গৃহযুদ্ধে)
(জর্জ অরওয়েল (ডানদিকে) ও অন্যান্যরা)
হেলেন গ্রাহাম তাঁর দ্য স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারঃ আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন বইয়ে বলেছেন – স্পেনের এই ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থান মুসোলিন (১৯২২) এবং হিটলারে অভ্যুত্থান (১৯৩৩) যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল তার সমতুল্য। ৮৬টি দেশ এবং উপনিবেশ থেকে মুক্তিকামী মানুষ এই ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
মেডিক্যাল হিস্টরি জার্নালে (২০২২) প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে – পোল্যান্ড থেকে আগত চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল ৫৬ জন, জার্মানি থেকে ৩৯ জন, আমেরিকা থেকে ৩৬ জন, হাঙ্গেরি থেকে ২৬ জন, এবং ফ্রান্স ও রোমানিয়া উভয় দেশ থেকেই আগত চিকিৎসকের সংখ্যা ২৫ জন করে ছিল। কানাডা থেকে আগত সুবিখ্যাত চেস্ট সার্জন নর্মান বেথুন তো ছিলেনই।
(স্পেনের রণাঙ্গনে নর্মান বেথুন)
গৃহযুদ্ধের সময়ে যে চারটি ক্ষেত্রে প্রধানত মেডিক্যাল সায়ান্সের অগ্রগতি হয়েছিল, সেগুলো অল্প কথায় বললে – (১) যেকোন ক্ষত এবং আঘাতের চিকিৎসা, (২) ব্লাড ব্যাংকের বিকাশ ঘটানো, (৩) বিশেষত বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রোগের চিকিৎসা, এবং (৪) সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য কিভাবে মেডিক্যাল সাপোর্ট টিম তৈরি করা যায়।
আমেরিকান কবি ল্যাংস্টন হিউজ ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডের বীর সন্তানদের উদ্দেশ্যে একটি অসামান্য কবিতা লিখেছিলেন। আমার করা অনুবাদে সে কবিতাটি একবার পড়া যাক।
“আমি এলাম
পেরিয়ে এলাম মহাসমুদ্দুর
এবং অর্ধেক বিশ্ব
কতশত সীমান্ত আকাশছোঁয়া পাহাড়
আর কত না দেশ
যারা বলেছিলঃ না
তুমি যেতে পারবে না।
আমি এলাম
এলাম আগামীদিনের
আলোকোজ্জ্বল সীমান্ত প্রদেশে
উজাড় করে দিলাম আমার এতদিনের শৌর্য আর প্রজ্ঞা।
কিন্তু সে তো খুব বেশি নয়
কারণ আমি যে যুবক
(বরঞ্চ বলা ভালো যুবক ছিলাম
এ জন্য যে, এখন তো আমি মৃত)
আর সবার বেঁচে থাকার জন্য
আমি যা দিতে চেয়েছিলাম
সবই দিয়েছি।
যখন এক ঝাঁক বুলেট এসে
স্তব্ধ করে দিল আমার হৃদস্পন্দন
এবং শোনিত উপছে পড়লো আমার গলা বেয়ে
আমি বুঝিনি, এ কি রক্ত!
কিংবা এক লাল অগ্নিশিখা!
কিংবা আমারি মৃত্যু
হয়ে উঠলো জীবন স্পন্দন।
সব তো একই
আমাদের স্বপ্ন
আমাদের মৃত্যু
তোমাদের জীবন।
আমাদের শোনিত
লাল অগ্নিশিখা
সব একাকার হয়ে গেছে।
(সূত্রঃ Luis Gustavo Girón Echevarría, Langston Hughes’s Spanish Civil War Verse”, Anuario de Estudios Filológicos, vol. XXVIII, 91-101)
একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ (অক্টোবর ৯, ২০২৪) প্রকাশিত হয়েছে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন “৬৫ ডক্টরস, নার্সেস অ্যান্ড প্যারামেডিকসঃ ওয়াট উই স ইন গাজা” শিরোনামে। এঁরা যেভাবে গাজাবাসীদের ওপরে যুদ্ধের নৃশংস পরিণতির কথা বর্ণনা করেছেন, তা থেকে একটিই সুস্পষ্ট বার্তা উঠে আসে – এরা এই যুদ্ধ, বিশেষ করে শিশুঘাতী এ যুদ্ধ, তাঁরা চান না।
ইতিহাস আমাদের স্মরণ করায়, ২০০২ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল শামিম-উর-রহমান এবং গণপতি মুদুর-এর লেখা প্রবন্ধ “ডক্টরস ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান ক্যাম্পেইন এগেইন্সট নিউক্লিয়ার ওয়ার”। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, ১৯৮৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল “ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়ার (আইপিপিএনডব্লু)”। চিকিৎসক এবং তাদের সংগঠনের যুদ্ধ-বিরোধী নিরলস, বিরতিহীন, সুদৃঢ় অবস্থান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতিও পেয়েছে।
আরেকটি সংগঠন মেডিসিন উইদাউট বর্ডার তথা “এমএসএফ” (সীমানা ছাড়িয়ে মেডিসিন) যেখানে যুদ্ধ বা মানুষ আক্রান্ত সেসমস্ত জায়গায় পৌঁছে গেছে তাদের চিকিৎসাসম্ভার এবং ত্রাণসামগ্রী নিয়ে। কিন্তু ২০১৮ সালের আগস্টে ইয়েমেন যে ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ হয়েছে সেখানে এমএসএফ-ও আক্রান্ত হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম ৭ মাসের মধ্যে এমএসএফ-এর ৩৭টি হাসপাতালে বোমা ফেলা হয়, যদিও অনেক আগেভাগেই এগুলোকে চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে এদের সবার জিপিএস অবস্থান সৌদি কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ইতিহাসের পরিহাস হল, ১৯৯৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল “এমএসএফ”। পুরস্কার গ্রহণ করার সময়ে এদের মুখপাত্র জেমস অরবিনস্কি বলেছিলেন – “মানবিক কার্যকলাপ সাধারণ বদান্যতা কিংবা দাতব্যের অতিরিক্ত কিছু। এর লক্ষ্য হল পরিস্থিতি যেখানে ভয়ংকরভাবে অস্বাভাবিক সেখানে স্বাভাবিকতার একটি ‘স্পেস’ তৈরি করা।”
ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত বয়ানের স্বাক্ষরকারী চিকিৎসকেরা “এমএসএফ”-এর সীমানাকে বাড়িয়ে নিয়ে চলেছেন চূড়ান্ত যুদ্ধবাজ, “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী”তে।
We must continue doing our humanitarian work in order to carry on our regular duties.👍
অসাধারণ।