ডাঃ ঘোষের চেম্বারে আজ ভ্যাক্সিন নেওয়ার ভিড়। সরকারি নির্দেশিকা মেনে ডাঃ ঘোষ ভ্যাক্সিনেশন বন্ধ রেখেছিলেন। সরকারি নির্দেশিকার ‘১৪ ই এপ্রিল’ বহুদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সরকারি তরফে এখনো ভ্যাক্সিনেশন শুরু হয়নি। তাই সপ্তাহ দুয়েক হ’ল ডাঃ ঘোষ করোনার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে ভ্যাক্সিনেশন শুরু করেছেন। অভিভাবকদের নানাবিধ সমস্যা, প্রশ্ন আর উৎকন্ঠায় ডাঃ ঘোষ জেরবার।
– ডাক্তারবাবু, বাচ্চা তো নার্সিং হোমে সিজার করে হয়েছে। লক ডাউনের জন্য কোথাও টিকা দিতে পারিনি। কী হবে?
– দেখুন, বাচ্চার সাতাশ দিন বয়স হয়ে গেছে। এখন শুধু বিসিজি টিকাটাই দেওয়া যাবে।
– বাকি দুটো না দিলে কিছু ক্ষতি হবে না তো স্যার?
– সব টিকাই বাড়তি সুরক্ষা দেয়। কাজেই পুরোপুরি আশ্বস্ত করি কীভাবে? এখন আর এসব ভেবে মন খারাপ করে লাভ নেই। দেড় মাসের টিকা সময় মতো দিয়ে নেবেন।
– আচ্ছা স্যার।
ঝড়ের মতো ঢুকে এলেন পরবর্তী ভদ্রমহিলা।
– ডক্টর, ওকে কিন্তু বাজারের সবচেয়ে দামীটা দিতে হবে। দাম যাই হোক ওটাই দেবো। নন্দিনীর মা সব দামী ভ্যাক্সিন দিয়েছে। আমিও ওগুলোই নেবো।
এই টাইপটা ডাঃ ঘোষ বেশ ভালো করে জানেন। এঁদের কাছে স্বাস্থ্যের বিষয়টিও স্টেটাস সিম্বল। ভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা বা রোগ-প্রতিরোধ বড় কথা নয়। আসল ব্যাপার কমদামী ভ্যাক্সিন দিয়ে নন্দিনীর মা’র কাছে হেরে যাওয়া চলবে না। এঁদের কাছে ‘উমুক রোগের টিকা’ নয় ‘এত দামের টিকা’ ব্যাপারটিই গুরুত্বপূর্ণ। এসব লোকজন দেখলে স্যার পারতপক্ষে দু-একটার বেশি কথা বলেন না। কোনও পরিষেবা দিয়েই এঁদের খুশি করা মুশকিল।
পরের জন এলেন। পোশাকে কিংবা ব্যবহারে আগের জনের সাথে বিস্তর ফারাক।
– ডাক্তারবাবু, সব টিকাগুলাই কি লিতে হবে? খরচার ব্যাপার আছে ত.. এখন ত ইনকামও বন্ধ। আপনি য্যামন বলবেন সেউরকম লিব।
– দেখুন কিছু টিকা আছে যেগুলো নিতেই হবে। কিছু আছে ‘নিলে ভালো’। আমি আপনাকে লিস্টে দাগ দিয়ে বলে দিচ্ছি।
– আপনি য্যামন ভাল বুঝ্যান করে দিন।
আরও প্রায় জনা দশেক বাচ্চার টিকা ও বাবা-মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর শেষের ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিয়ে ভেতরে এলেন।
– বলছি ডক্টর, ওর দেড় বছরের বুস্টারটা বাকি আছে। ওটা কি মাসখানেক দেরি করা যাবে?
– হ্যাঁ। বুস্টার ডোজ একটু পেছানোই যায়। প্রথম একবছরের টিকা আর যেসব টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
– আর ওর হেপাটাইটিস-এ ফার্স্ট ডোজটাও মিস গেছে।
– এটাও দেরি করে দেওয়া যায়। হেপাটাইটিস এ জলবাহিত রোগ। কাজেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, হাত ধোওয়া, শুদ্ধ পানীয় জল ব্যবহার.. ইত্যাদি বজায় রাখবেন।
– আচ্ছা স্যার, করোনার জন্য আদা আর হলুদ বেটে খাচ্ছি। অসুবিধে নেই তো?
– অসুবিধে নেই। তবে আলাদাভাবে সুবিধে কিছু হয় বলে আমার জানা নেই।
– আপনি তাহলে.. এই যে দেখুন, দেখুন। আদা-হলুদ-কালো মরিচ দিয়ে চা খেলে করোনার সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
– রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সব ধরনের শাকসব্জী, পরিমিত ঘুম, ফলমূল, প্রোটিন, শরীরচর্চা ইত্যাদি সবকিছুর গুরুত্ব আছে। আলাদাভাবে ওসব হলুদ-আদা-মরিচ খেয়ে ইমিউনিটি বাড়িয়ে করোনা আটকানো যায় বলে কোনও প্রমাণ নেই।
– এই যে আপনাদের দোষ.. অর্গানিক জিনিসের গুণ মানতে চান না।
ডাঃ ঘোষ অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করেন..
– হুঁ, অর্গানোফসফেটেরও গুণ মানতে কষ্ট হয়।
– কিছু বললেন?
– হ্যাঁ। বলছি, আদা-মরিচ-হলুদ থেকে শুরু করে জবাফুলের পরাগরেণু বা দুর্বাঘাসের রস যা খুশি খান। তবে দয়া করে ওতে ইমিউনিটি বেড়ে যাওয়ার আনন্দে হাত ধোওয়া, মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারগুলো ভুলে যাবেন না যেন..
চেম্বার শেষ হতে হতে দুপুর দেড়টা পেরিয়ে যায়। একটা প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে ঘুরঘুর করছিল। ফাঁকা পেয়ে স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম..
– আচ্ছা স্যার, আপনি ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে এত জোর দিচ্ছেন কেন? তার চেয়ে তো বরং করোনা এড়ানোর জন্য বাড়িতে থাকাই ভালো।
– দ্যাখ, এটা শাঁখের করাত অবস্থা ভ্যাক্সিন নিতে বেরোলেও ভয়, না বেরোলেও ভয়। কিন্তু এটা মাথায় রাখিস ভ্যাক্সিন দিয়ে যে রোগগুলো রোধ করা হয় তারা ভয়াবহতার বিচারে করোনাকে ধরে ধরে দশ গোল দেবে। এই একই ঘটনা ২০১৪-১৫ সালে ইবোলার সময় হয়েছিল। দেখা যায় ভ্যাক্সিনেশন দেরিতে হওয়ার জন্য ইবোলার চেয়ে তিনগুণ মৃত্যু হয় হামে। তাও ইবোলার মারণক্ষমতা ছিল গড়ে ৬০%, কখনও বেড়ে ৯০% অব্দি। অর্থাৎ, ইবোলার মারণক্ষমতা করোনার চেয়ে বহুগুণ বেশি।
– কিন্তু স্যার, ১৩০ কোটির দেশে ২-৩% লোকেরও রোগ হয়ে গেলে আমরা কি সামাল দিতে পারবো? আর হাম কি সত্যিই এতটা মারণ রোগ?
– ভালো প্রশ্ন করেছিস। এখানেই তো ভ্যাক্সিনের আশীর্বাদ রে.. শুধু ২০০০-২০১৭ সালের মধ্যে হামের টিকা দিয়ে ২১ মিলিয়ন মৃত্যু ঠেকানো গেছে। এখনো প্রত্যেক বছর টিকাকরণের মাধ্যমে গড়ে ২-৩ মিলিয়ন রোধ হয়। ডিপথেরিয়া-হুপিং কাশি- ধনুষ্টঙ্কার-মাথার টিবি.. এগুলো সবই ভয়ানক। টিকার রক্ষাকবচ থাকে বলে ভয়াবহতা বোঝা যায় না। টিকাকরণ কর্মসূচী দুর্বল হয়ে গেলে এই রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এটা প্রতিষ্ঠিত। কাজেই করোনাতে কী হতে পারে সেটা ভেবে তার চেয়ে বহুগুণ ভয়ংকর শত্রুকে অবহেলা না করাই ভালো।
– তাহলে যতদিন না সরকারি টিকাকরণ আবার শুরু হচ্ছে..
– একদম ঠিক জায়গায় ধরেছিস। যাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে তাঁরা বাইরে থেকে টিকা দিয়ে দিচ্ছেন। দেশে অগণিত মানুষ আছেন যাঁদের থাকার ঘর নেই অথবা থাকলেও গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয়। এই লকডাউনের জন্য কাজও বন্ধ। অর্থাৎ, পেটে খাবার নেই, হাতে পয়সা নেই। ভ্যাক্সিন কিনে নেওয়া তাঁদের দূরবর্তী কল্পনাতেও আসে না। বিশেষত সেইসব জায়গায় এই রোগগুলোর প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। অন্তত প্রথম এক বছরের টিকা দিয়ে দিতেই হবে। দেড়-আড়াই-সাড়ে তিন মাসের টিকায় এক মাসের জায়গায় খুব টেনেটুনে দেড় থেকে দু’মাসের ফাঁক রাখা যায়। তার বেশি হয়ে গেলে মুশকিল।
– যতদিন না টিকা দেওয়া যাচ্ছে ততদিন কোনও সতর্কতা নেওয়া যেতে পারে?
– হ্যাঁ। যেমন ধর, হুপিং কাশি বা হাম। এগুলো করোনার মতোই হাঁচি-কাশি থেকে ছড়ায়। করোনার মতোই একই সতর্কতা নিতে হবে। রোটা ভাইরাসঘটিত ডায়েরিয়া রোধের জন্য সাধারণ পরিচ্ছন্নতা। তাছাড়া সুষম আহার, ঘুম ইত্যাদি যা যা বললাম..
– আচ্ছা স্যার, যাঁরা টিকা নিতে আসবেন আর যাঁরা দেবেন তাঁদের সবার যাতায়াত, টিকাকরণ কেন্দ্রে দূরত্ব বজায় রাখা, সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া, বয়স্ক কারো সাথে বাচ্চাকে না পাঠানো, মাস্ক পরা.. এগুলোও তো গুরুত্বপূর্ণ। তাই না?
– হ্যাঁ। সে তো বটেই। দূরদূরান্ত থেকে টিকা নিতে আসাই মুশকিল। তুই যদি মহামারীকে একটা যুদ্ধ হিসেবে দেখিস তাহলে মাথায় রাখিস যেকোনো যুদ্ধে বোমা-বন্দুকে যত ক্ষয়ক্ষতি হয় তার চেয়ে বহু বহুগুণ হয় তৎপরবর্তী আর্থ-সামাজিক ধ্বস, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদিতে। অবশ্য যত সহজে এতগুলো কথা বলে দিচ্ছি, পুরো ব্যাপারটা সামাল দেওয়া তার চেয়ে অনেক কঠিন।
বলতে বলতে ডাঃ ঘোষ চেম্বার থেকে বেরিয়ে যান। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে আড়াইটা ছুঁয়েছে..
বর্তমানে পরিস্থিতি বিচার করে লেখাটা অত্যন্ত দরকারি একটা লেখা. অনেকের খুব কাজে আসবে. এই লেখার মধ্যে একটা জায়গা খুব ভালো লেগেছে যেখানে dr ঘোষ, হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে লিখেছেন, ভালো ভেকশিন এর থেকে বড়ো কথা দামি ভেকশিন. উমুকের মা দিয়েছে তাই আমাকেও দিতে হবে. ভেকশিন একটা স্ট্যাটাস সিম্বল. এই ধরনের মানুষই সমাজ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিপদজনক. এরা বেশি বোঝেন প্রয়জনের তুলনায়. ফলস্বরূপ মাঝে মাঝে তিল কে তাল করে পুরো সিস্টেম কে গুলিয়ে দেন. এটাই বিপদ এনে দেয় পেশেন্ট এর ও ডাক্তার এর ও. তাই আমার মতে ঠিক যতটুকু জানলে চলে ঠিক তটাই জানা ভালো , বাকিটা কম জেনে ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল হওয়াই শ্রেয় বলে মনে হয়..
ভালো থাকিস, এভাবেই তোর কাজ চালিয়ে যাও ভাই??
বতর্মান সময়ের খুব উপকারী পোস্ট ।।
।। ধন্যবাদ ।।