নোটিশ পড়েছে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। সন্ধান চাই নোটিশ। এই ওয়ান্টেড দুষ্কৃতীদের ধরে দিতে পারলেই মাথা পিছু লাখ টাকা পুরস্কার।
মেডিক্যাল কলেজের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নয়া ত্রাস এখন এই নিখোঁজের নোটিশ। কে বা কারা, সাদা সেলোটেপ দিয়ে চিটিয়ে গেছে, ওষুধ নেই হাসপাতালের ওয়ার্ডে। কখনো সেই ওয়ার্ডটা অর্থোপেডিকসের, কখনো মেডিসিনের। কী কী ওষুধ নেই ওয়ার্ডে? কোন কোন ওষুধের খোঁজ করলে সিস্টারদিদি মাথা নেড়ে নাকচ করে দেবেন অনুরোধ? রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাথায় বসে থাকা মেডিক্যাল কলেজগুলোর একটাতে (আসলে ঘুরিয়েফিরিয়ে সবগুলোতেই) ভর্তি থাকলে কোন কোন ওষুধের অভাবে রোগী কাতরাবে, কিন্তু কিনে না আনা পর্যন্ত ওষুধ পাওয়া যাবে না? ওষুধটা হচ্ছে প্যারাসিটামল, জ্বরের ওষুধ, ট্যাবলেট এবং ইঞ্জেকশন। ওষুধটা হচ্ছে ডাইক্লোফেন্যাক, সবথেকে বেশি ব্যবহৃত ব্যথার ওষুধ, ইঞ্জেকশন। ওষুধটা হচ্ছে ট্রামাডল, ব্যথানাশক ওষুধের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী ওষুধ, ইঞ্জেকশন। ওষুধটা হচ্ছে লিনেজোলিড, অপারেশনের পর দেওয়া অন্যতম বেশি ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক, ট্যাবলেট। আর কী কী নেই? নর্মাল স্যালাইনের ৫০০ এমএল এর বোতল, যেটা কতোটা প্রয়োজনীয় সাধারণ মানুষকে আলাদা করে বোঝানোর দরকার নেই! নেবুলাইজার মাস্ক নেই, রোগীকে অক্সিজেন দেবার দরকার হলে সাদা কাগজে লিখে আনতে বলতে হবে ফুটপাথের উল্টোদিকের দোকান থেকে! আর যদি পয়সা না থাকে রোগীর আত্মীয়র? যদি দোকান থেকে হাজার দুহাজার চারহাজার টাকার ওষুধ কিনে আনার মতো আর্থিক অবস্থা না থাকে রোগীর বাড়ির লোকের? রোজ রাউন্ডে ওষুধ লেখা থাকবে, আনতে বলা হবে, কিন্তু ওষুধটা আর এসে উঠবে না। রোগী তাহলে সরকারি হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে মারা যাবে, অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে, ব্যথার ওষুধের অভাবে। বাড়ির লোক ভাববে, যাক হাসপাতালে শুয়ে মরলো অন্তত!
মেডিসিনের ওয়ার্ডে মেরোপেনেম অ্যান্টিবায়োটিকের ভায়াল নেই। মেরোপেনেম হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিকের রাজা, না হলেও মন্ত্রী, যেসব ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ অন্যরা সামলাতে পারে না, তাদের তাড়াবার দায়িত্ব মেরোপেনেমের। সেই ইঞ্জেকশন দিনে দুটো করে লাগলে তার খরচ ৩০০০ টাকা। ৩০০০ টাকা পকেট থেকে বের করতে পারে তো সরকারি হাসপাতালের রোগীরা? ওপিডি থেকে দেওয়ার ওষুধের অবস্থাও তথৈবচ। পাওয়া যাচ্ছে না হাই প্রেসারের ওষুধ, দেখা পাওয়া যাচ্ছে না সুগারের ওষুধ গ্লিপ্টিনদের — এই সরকারি হাসপাতালের ওপিডির প্রেসার-সুগারের ওষুধের ওপর ভরসা করে বেঁচে আছেন রাজ্যের বেশিরভাগ রোগী। তাদের ওষুধ মাসের পর মাস বন্ধ থাকবে তাহলে? ওপিডি আসবেন আর খালি হাতে ফিরে যাবেন রোগীরা? সাইকিয়াট্রিক ওষুধ, নিয়মিত অন্যান্য জীবনদায়ী ওষুধ রাজ্যের বেশিরভাগ হাসপাতালের ওপিডিতেই অমিল বেশ কিছুদিন ধরে। তাহলে রোগীদের জীবনের দাম নেই?
রোগীদের জীবনের কি সত্যিই দাম নেই সরকারের কাছে? ওয়ার্ডে আউটডোরে মাসের পর মাস জীবনদায়ী ওষুধ পাওয়া যাবে না? এরপরও স্বাস্থ্যসাথীর ভাঁওতাবাজি চলবে, আর আমরা মুখ বুজে দেখে যাবো? সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বড় বড় মেডিক্যাল কলেজের বিল্ডিং তুলে দিয়ে ‘উন্নয়ন’ দেখাবেন, মাননীয়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী, আর বিল্ডিংগুলোতে গিয়ে ওষুধ না পেয়ে ফিরে যাবেন সাধারণ মানুষ? এই আপনার পরিকল্পনা স্বাস্থ্যের জন্য? এরপর ত্রিপুরা গোয়া করে বেড়াবেন আপনি? আর রাজ্যে ডাক্তার-নার্স অ্যাপয়েন্ট হবে কনট্র্যাকচুয়াল, লাখে লাখে টাকা মারবে নির্মল মাজি শান্তনু সেন আর তাদের দলবল, রোগী কল্যাণ সমিতিতে বসে, আর সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ওষুধ না পেয়ে রোগীরা মরবে ওয়ার্ডে পড়ে পড়ে?
এই বেইমানি, এই নির্লজ্জতা চোখ খুলে দেখতে পেলে আওয়াজ তুলুন। অ্যাপোলো ফর্টিস আমরিতে সব চিকিৎসা করাতে পারবেন তো, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত? সরকারি হাসপাতালের দুটাকার ওপিডি আর ফ্রি চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেলে, অকেজো হয়ে গেলে অসুবিধা হবে না তো? ওষুধের আর টেস্টের দামে টান পড়বে না তো মধ্যবিত্ত নিশ্চিন্তিতে? ভেবে দেখবেন একটিবার…
[মেডিক্যাল কলেজের অর্থো ওয়ার্ডের নোটিশ ]