জানুয়ারি ৮, ২০২৫
কালের বিচারে পাঁচ মাস খুবই কম। কিন্তু পাঁচ মাস যদি এক দম্পতিকে তাঁদের সন্তানদের মৃত্যুর পর অপেক্ষা করতে হয় প্রকৃত অপরাধীর সন্ধানের জন্য, সঠিক বিচারের জন্য, তখন? তখন মনে হয় করে কাটবে এই ঘোর তমসা। সময় সত্যিই আপেক্ষিক।
আমরা সকলেই জানি বিগত ৯ আগস্ট আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে আমাদের এক সহকর্মীর নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। এটা ভেবে নেওয়ার কোন কারণ নেই যে এই ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন ‘ছোট্ট’ ঘটনা। বরং এই ঘটনাটি, কেবলমাত্র আজ জি কর হাসপাতালে নয়, বিগত এক দশকের উপর পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ধরনের সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর ঘটে চলা থ্রেট কালচারের, ভয়ের অপসংস্কৃতির একটি উদাহরণ মাত্র। যা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই ভয়ের অপসংস্কৃতি, ভয় দেখানোর অপসংস্কৃতি, কেবলমাত্র ডাক্তারদের উপর যে চলে তা নয়, চলে সমস্ত ধরনের ডাক্তার-শিক্ষক, ডাক্তার, ডাক্তারী ছাত্র, নার্স, রোগী সহায়ক কর্মী সকলের উপরেই। এই অপসংস্কৃতি হাসপাতালের সীমানা ছাড়িয়ে এই রাজ্যের সমস্ত ধরনের সরকারী বেসরকারী কর্মক্ষেত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। মত প্রকাশের ক্ষমতা ক্রমশঃ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। বিরূদ্ধ মত প্রকাশকে অপরাধ বলে পরিগণিত করা হচ্ছে। প্রত্যেকেই, প্রতি মূহুর্তে ভয়ের আবহে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই নৃশংস ধর্ষণ ও খুন কেন সমস্ত সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক, ছাত্র, বিভিন্ন পেশার মানুষকে রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছিল? কারণ এই ভয়ের অপসংস্কৃতি মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। মানুষের মনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ প্রকাশের একটা উপলক্ষ্যের প্রয়োজন ছিল মাত্র। মানুষ তার অসন্তোষ, ক্ষোভ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ দেখিয়েছে। আন্দোলনে নেমেছে পথে।
২০১৭ সালে সাংগঠনিক ভাবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই WBDF তাঁর লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিল। চিকিৎসকদের পাশে থেকেছে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে যেখানে যখনই কোনরকম অনাচার হয়েছে, WBDF চুপ থাকেনি। গলার সুর উঁচু করতে পিছপা হয়নি। তা সেটা হাসপাতালে হোক, রাস্তাতে হোক অথবা কোর্টে। লড়াই চলছে। চলবে। চিকিৎসকদের অধিকার, সম্মান আর সুরক্ষার প্রশ্নে WBDF সর্বদা সোচ্চার হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। কখনো একা কখনো সমমনোভাবাপন্ন চিকিৎসকদের অন্যান্য সংগঠনের সাথে হাত হাত মিলিয়ে লড়াইয়ের পথ সহজ ছিলো না। তবু তা করেছে। করছে। করবে। তৈরী হয়েছে JPD, আমাদের চিকিৎসকদের মিলিত সংগঠন।
অভয়ার নৃশংস খুন-ধর্ষণের পর, বিগত পাঁচ মাস, আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। আন্দোলনের উপর সরকারের ধেয়ে আসা ক্রমাগত বাধা অতিক্রম করে চলতে হয়েছে। আন্দোলন তো খুনী ধর্ষকদের বিরুদ্ধে। সরকার কেন বাধা দিয়েছে? প্রশ্ন জেগেছে আমাদের মনে। সরকারের কী তাহলে কোন পক্ষ আছে? সরকার কী তবে নিরপেক্ষ নয়? প্রসাশন আমাদের বাধ্য করেছে পথে নামতে। বিভিন্ন সংগঠনকে হাতে হাত ধরে চলতে। এক সাথে জোট বাঁধতে। চিকিৎসকদের বাইরেও বিশাল এই সমাজ আজ এক সাথে জোট বেঁধেছে। প্রতিজ্ঞা করেছে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার।
আমাদের আজকের এই কনভেনশন একদিকে যেমন ভয় দেখানোর অপসংস্কৃতির বিরূদ্ধে, অন্য দিকে এই সুবিচারের দাবীতে এই আন্দোলনের জন্যেও। আইনি লড়াই চলছে আদালতে, রাস্তায় আন্দোলন চলছে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করে কঠোরতম শাস্তির দাবীতে। এই ভয় অপসংস্কৃতির মাথাদের চিহ্নিত করে, নির্মূল করার দাবী নিয়েও চলছে আমার আন্দোলন। জানি না এই রক্তবীজদের নির্মূল করা সম্ভব কি না। আমাদের কিছু নির্দিষ্ট দাবী আছে, আর তা হল –
১॥ বিচারালয় এবং সাধারণ জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থার প্রতি সিবিআই যে ব্যর্থতা দেখিয়েছে, সেই ব্যর্থতার জন্য অবিলম্বে সিবিআই-কে তদন্তের সমস্ত তথ্য জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দায়ের করতে হবে।
২॥ সন্দীপ ঘোষ এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি এবং অনিয়মের মামলায় চার্জশিটের জন্য রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে সিবিআই-কে প্রয়োজনীয় অনুমোদন (NOC) প্রদান করতে হবে।
৩॥ বৃহত্তর ষড়যন্ত্র এবং থ্রেট সিন্ডিকেটের সমস্ত মাস্টারমাইন্ডদের তদন্তের আওতায় আনতে হবে এবং যথাযথ শাস্তি দিতে হবে।
৪॥ স্বাস্থ্য দফতর, রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল এবং হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে অনিয়ম এবং দুর্নীতির যথাযথ তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫॥ রাজ্যের সমস্ত কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে (মেডিক্যাল বা অন্যান্য) ছাত্র সংসদের নির্বাচন অবিলম্বে সম্পন্ন করতে হবে যাতে ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করতে পারে এমন ছাত্র সংগঠন গঠন করা যায় এবং ক্যাম্পাসে সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।
৬॥ সমস্ত কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে নির্বাচিত ছাত্র সংস্থা গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৭॥ সরকারকে চিকিৎসক এবং অন্যান্য পেশার নির্বাচিত সংস্থা বা সংগঠনকে স্বীকৃতি দিতে হবে যারা তাদের নিজ নিজ পেশার প্রয়োজন এবং দাবি নিয়ে কাজ করবে।
৮॥ কলেজ ক্যাম্পাস এবং সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের সমস্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং অবিলম্বে করতে হবে।
৯॥ সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য এবং থ্রেট সিন্ডিকেট সম্পূর্ণভাবে বিলোপ করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা বিশ্বাস নির্বিশেষে জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে সমান অধিকার এবং সুযোগ প্রদান করতে হবে যাতে কোনো ভীতি বা ভয় ছাড়াই সমাজে বসবাস করা যায়।
WBDF যৌথ চিকিৎসক মঞ্চ (Joint Platform of Doctors), অভয়া মঞ্চ, WBJDF এবং অন্যান্য সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করছে, যাতে চিকিৎসক এবং অন্যান্য পেশাদাররা থ্রেট এবং হয়রানিমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারব।
WBDF পরিবার