মানবজাতি আজকে চরম বিপদের সম্মুখীন। আতঙ্কের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা ভালো মন্দ অনেক খবর সংগ্রহ করে থাকি। ভয় আর দুশ্চিন্তাটা তখন চরম আকার নেয় যখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে এই ধরণের পোস্ট দেখি “পাশের বাড়িতে করোনা পেশেন্ট পাওয়া গেছে/আমাদের বিল্ডিং-এর অন্য ফ্ল্যাটে করোনা ধরা পড়েছে ….এবার আমরা শেষ…. আমাদের কী হবে …ফিলিং ওরিয়ড উইথ”, অমুক তমুক নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জনকে ট্যাগ করা (যদিও ফিজিক্যাল ডিস্ট্যানসিং এখানে মানতে হয় না)। মজা করে বললাম কিন্তু এটা চিন্তার বিষয় এবং কম বেশি সকলের ভয়ের কারণ। সাল .২০২০-তে দাঁড়িয়ে আমরা এতটা আতঙ্কগ্রস্ত তাহলে এক বার ভাবুন ১৯২৫ সালের আলাস্কার নোম শহরের লোকদের ডিফথেরিয়া এন্টিটক্সিন পাওয়ার ঘটনা কতটা রোমহর্ষক ছিল।
আর্টিক সার্কলের ২ ডিগ্রী পশ্চিম দিকে আলাস্কার নোম শহর। তখনকার সময় নোম ছিল একটি বড় শহর। ওখানকার ভৌগোলিক অবস্থান নোম শহরে পৌঁছনোর রাস্তাটা খুব দুর্গম করে দিয়ে ছিল। নভেম্বর থেকে জুন মাস নোম শহরটি অন্য সব জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় যেত. এই বরফের সাম্রাজ্যে পৌঁছনো এবং যোগাযোগ রাখতে পারা কার্যত অসম্ভব হয় যেত।
১৯২৪ সালের মেনার্ড কোলম্বাস হাসপাতাল। ২৫ টি শয্যা সম্পন্ন হাসপাতালে আছেন ৪ জন নার্স আর একমাত্র চিকিৎসক ডঃ কার্টিস ওয়েল্চ। হাসপাতালে সমস্ত মেডিসিনের লিস্ট পরীক্ষা করতে গিয়ে ডঃ ওয়েল্চ দেখলেন শুধুমাত্র ডিফথেরিয়া এন্টিটক্সিন নেই। কাল বিলম্ব না করে চিকিৎসক এই এন্টিটক্সিনের আবেদন করলেন চিকিৎসা বিভাগে। শীত বেশি বাড়লে খুব বিপদে পড়বে শহরটি এই এন্টিটক্সিন না পাওয়া গেলে, কারণ তখন আর নোমে কেউ সহায়তা করতে পৌঁছতে পারবে না।
এন্টিটক্সিন সময়মতো পাওয়া গেলো না। শীত বাড়তে থাকলো আর নোম বরফের আস্তরণে ঢেকে গেলো।
১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাস। দু জন শিশুর টনসিলাইটিস ধরা পড়লো। আস্তে আস্তে শহরটির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক টনসিলাইটিস কেস জানা গেলো এবং ৪ টি শিশুর মৃত্যু হলো। অটোপসি করা না গেলেও ডঃ ওয়েল্চ নিশ্চিত হলেন এটা ডিফথেরিয়া। মারণ রোগ থাবা বসিয়েছে নোম শহরে। ডঃ কার্টিস ওয়েল্চ আবার মার্কিন হেলথ সার্ভিস ওয়াশিংটন ডিসি-তে খবর দিলেন। ওখান থেকে খবর এলো এন্টিটক্সিন আছে, কিন্তু পৌঁছবে কি করে? বরফের আস্তরণ ভেদ করে জাহাজ যেতে পারবে না. উন্নত মানের প্লেন তখন ছিলো না যেটা তুষার ঝড় অতিক্রম করে কম আলোয় উড়তে পারতো।
তাহলে কি সব শেষ হয় যাবে? কেউ কি আর বাঁচতে পারবে না সাক্ষাৎ মৃত্যুর কবল থেকে? এবার আবার ডঃ ওয়েল্চ যোগাযোগ করলেন ওয়াশিংটন ডিসির হেলথ সার্ভিসে। ওনারা ডঃ ওয়েল্চকে জানালেন নোম থেকে ৬৭৪ মাইল (১০৮৫ কিমি) দূরে নীনানা শহরে ওনারা এন্টিটক্সিন পৌঁছে দেবেন, কিন্তু নোম পর্যন্ত বাকি পথ কি করে অতিক্রম হবে সেটা নোমের বাসিন্দারা ঠিক করবেন।
স্থানীয় লোকেরা ঠিক করলো ডগ স্লেজ ছাড়া পৌঁছনো যাবেনা I প্রায় ১৫০ টি সারমেয় এবং তাদের ২০ জন মালিকদের নিয়ে একটি দল গঠন করা হল। রীলে রেসের মাধ্যমে ডিফথেরিয়া এন্টিটক্সিন নিনানা শহর থেকে পারি দেবে। ভয়ঙ্কর তুষার ঝড় আর -৫০ ডিগ্রী ফাহরিনহেইট তাপমাত্রা নিয়ে অতিক্রম করতে হবে ৬৭৪ মাইল পথ। রীলে রেসের ব্যাটন তুলে নিলো সারমেয় ব্লাকি। ওদিকে নোম শহরে মৃত্যু মিছিল আরম্ভ হয়ে গেছে। অন্য দিকে জীবন মৃত্যুর দৌড় আরম্ভ হয় গেছে। ব্যাটন এক সারমেয় থেকে আর এক সারমেয় হয়ে শেষে পৌঁছলো শাকটুলিক অঞ্চলে। প্রায় ৪১৪ মাইল পথ অতিক্রম হয়ে গেছে ৪ দিনে কিন্তু এবার পথ অত্যন্ত কঠিন। রীলে রেসের সব থেকে দুর্গম পথ এবার আরম্ভ হবে। দুর্ভাগ্য আরও বাকি ছিল। তাপমাত্রা -৬২ ডিগ্রী ফাহরিনহেইট নেবে গেছে আর ভয়ঙ্কর তুষার ঝড় দানবের শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়েছে। এবার ব্যটন তুলে নিলো দলের সবথেকে তেজি আর বুদ্ধিমান সারমেয় টোগো। আর বেশি সময় নেয়া যাবে না। নোম আর বাচঁবে না টোগোর দেরি হয় গেলে। ৩১ জানুয়ারী টোগো দৌড় আরম্ভ করলো। তাপমাত্রা তখন – ৮৫ ডিগ্রী ফাহরিনহেইট। নিজের সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়ে টোগো দৌড়োচ্ছে। পিছনে আছে টোগোর মালিক লিওনহার্ড সিপ্পালা আর টোগোর দলের বাকি সারমেয়রা। দিনের আলো খুব অল্প সময় থাকে এই বরফ রাজ্যে। অন্ধকার আর তুষার ঝড়ের মাঝে পথ হারালেন লিয়েনহার্ড সিপ্পালা। শারীরিক আর মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত সিপ্পালা বেঁচে থাকার আশা ত্যাগ করলেন। সারমেয়গুলোর প্রাণশক্তি প্রায় শেষ। নোম কি আর বাচঁবে না? টোগো কিন্তু হাল ছাড়েনি। ওকে পৌঁছতে হবে। ওকে বাঁচাতে হবে নোমের প্রতিটা শিশুকে। চিৎকার করতে করতে টোগো স্লেজ নিয়ে আবার ছোটা আরম্ভ করলো। দলের অন্য সারমেয়গুলো টোগোর আত্মবিশ্বাস দেখে অনুসরণ করলো টোগোকে। মালিক সিপ্পালা এখন শুধুমাত্র দর্শক। টোগো সঠিক পথ খুঁজে বার করলো। আবার নোম শহরের দিকে টোগোর দল নিজের জীবনের বাজি রেখে আরও তীব্র গতিতে ছুটলো। ১৩ কিমি/ঘন্টা .বিশ্রামের সময় নেই। আর ১০০ মাইল পথ বাকি। টোগো এসে পৌঁছলো নর্টন সাউন্ড অঞ্চলে। ৫০০০ মিটার পাহাড় অতিক্রম করতে হবে এই ভয়ঙ্কর আবহাওয়াতে। টোগো ক্রমশ চিৎকার করে নিজের দলকে চাগিয়ে রেখেছে। টোগো থামবে না। টোগো থামলে নোম শহরের জীবন স্পন্দন থেমে যাবে। টোগো পাহাড় টপকে রাত সাড়ে আটটায় নোমে পৌঁছে গেলো। ডিফথেরিয়া এন্টিটক্সিন লোকেদের প্রাণ বাঁচিয়ে দিলো। নোম শহর নিজের দেবদূত টোগোকে কোনো দিন ভুলবে না। এতটা পথ অতিক্রম করতে গিয়ে প্রচুর সারমেয় মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছিল।
অদম্য সাহসের এই ঘটনা আমাদের আজও শেখায় এই করোনা পরিস্থিতিতে সাহস আর ধৈর্য রাখতে। আমরা নিশ্চয়ই জিতবো।
দুর্দান্ত লেখনী। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। এক অজানা সত্য কী সুন্দর একটা গল্পর মোড়কে মেলে ধরলেন। এবং এই প্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস সংক্রমণ ঘটাবেই।
আপনার অন্য লেখা পড়বার সুযোগ চাইছি।
Thank you Sir for your inspiration. I’m honoured. Amar articles gulo ‘My other post ‘ option a click korle dekha jabe. ?