১.
ম্যাকেন্জি ওয়ার্ডে ভর্তি এক অল্পবয়সী ছেলে। তিন মাসের জ্বর, প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষায় সেরকম কিছু ধরা পড়েনি। মোটামুটি “অজানা জ্বরে”র সুলুক সন্ধানের জন্যই ভর্তি করা। তখন আমি ফার্স্ট ইয়ার, হিস্ট্রি নিলাম, সব সিস্টেম পরীক্ষা করলাম- বিশেষ কিছু পেলাম না। সন্ধ্যাবেলা থার্ড ইয়ারের দাদা রাউন্ডে এলো, তাকে সব বলা হলো। দাদাও অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করলো- চেস্টে কিছু ফাইন্ডিং পেলো দাদা, সেটা আমিও শুনলাম। পরদিন স্যার এলেন, স্যারের ষাটের ঘরে বয়স, প্রেসার-সুগার সবই থাবা বসিয়েছে শরীরে। কিন্তু স্যারের এখনো ক্লিনিক্স-অন্ত প্রাণ। স্যারও অনেকক্ষণ পেশেন্টটাকে দেখলেন, সব শুনলেন- আমাদের নতুন করে শোনালেন। সব মিলিয়ে স্যারের পনের-কুড়ি মিনিট, দাদার আধ ঘন্টা, আমার এক ঘন্টা মতো এক্সপোজার হয়ে গেছে। পরদিন পেশেন্টের রিপোর্ট এলো কফের নমুনায় যক্ষ্মারোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। তারও তিন দিন পর রিপোর্ট এলো, সেটা মাল্টি ড্রাগ রেসিস্টান্ট। পেশেন্টকে শিফট করা হলো স্থানীয় এম ডি আর টিবি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
করোনায় আমাদের বয়সী মানুষদের মৃত্যুহার প্রায় শূন্য, চিকিৎসা মোটামুটি ঘরে বসে ঘুম। মাল্টি ড্রাগ রেসিস্টান্ট যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা কীরকম ভয়ঙ্কর সেটা যারা সেই চিকিৎসা পেয়েছে, তারাই জানে।
২.
তখন আমি ইন্টার্ন। মেডিক্যাল কলেজে ফ্লোরে পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে, পেটে জল জমেছে বলে। মেডিকেল কলেজে acute ওয়ার্ডে সব সময় গ্লাভস ইত্যাদি পাওয়া যেত না। তখন এত কিছু ভাবার সময় বা বয়স কোনোটাই ছিল না। বিনা গ্লাভসেই তার চ্যানেল, পেটের জল বের করা সবই হলো। পরে তার পুরোনো সব কাগজ বেরোলো, তাতে একটা CD4 কাউন্টের রিপোর্ট, যা সাধারণত HIV রোগীদের ক্ষেত্রেই করা হয়ে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে এত কাগজের মধ্যে HIV রিপোর্টের কোনো কাগজ নেই। রাতারাতি HIV রিপোর্ট পাওয়াও যাবে না। পার্টিকে ডেকে জিগেস করা হলো, তারা কিছুতেই মানবেনা আর কোনো কাগজ আছে কিনা। পরে চাপাচাপিতে জানা গেল, পেশেন্ট ইতিমধ্যে ART সেন্টারে চিকিৎসাধীন- মাঝে ওষুধপত্র বন্ধও করে দিয়েছে। এসব কাগজ দেখালে কেউ ভালো করে নাকি দেখে না, তাই পার্টি ইচ্ছা করেই এসব কাগজ সরিয়ে রেখেছে। যেটার পরোক্ষ অর্থ এটাই দাঁড়ায়, রিপোর্ট লুকিয়ে ওরা ২৩-২৪ বছর বয়সী তিন-চার জন ডাক্তারের জীবন বিপন্ন করেছে, সেটাও অবলীলায়, সব কিছু জেনেশুনে। HIV রোগ নিয়ে নিশ্চয়ই নতুন করে বলতে হবেনা!
৩.
এই ক’দিন আগের ঘটনা। কিডনির সমস্যা নিয়ে ডায়ালিসিসের পেশেন্ট ফুলে ঢোল হয়ে ভর্তি হলো। দু’সপ্তাহ ধরে ডায়ালিসিস করানো সম্ভব হয়নি। এই ধরণের পেশেন্টের চ্যানেল করা এক প্রকার অসম্ভব। পেশেন্ট শ্বাসকষ্টের জন্যে শুতেও পারছে না, তাই সেন্ট্রাল লাইন করাও দুরূহ ব্যাপার। অনেক জায়গায় ফুটিয়ে এদিক ওদিক থেকে রক্ত মাখামাখি হয়ে অবশেষে চ্যানেল হলো, প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষা পাঠানো হলো। রিপোর্ট এলো, হেপাটাইটিস সি রয়েছে পেশেন্টের। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এটাও পার্টি জানতো, জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস থেকে ক্রনিক লিভার ডিসিসের সম্ভাবনা হেপাটাইটিস বি-এর থেকেও অনেকাংশে বেশি। সঠিক সময়ে ধরা না পড়লে আর অন্য কোনো কারণে মারা না পড়লে লিভার ক্যানসার হওয়া একপ্রকার নিশ্চিত।
এই কথাগুলো একা আমার গল্প নয়। ফ্রন্টলাইনে ডাক্তারি করা সব ডাক্তারের জীবনেই এই ঘটনা আকছার ঘটে চলেছে, ভবিষ্যতেও যদি ডাক্তারি পেশা বেঁচে থাকে, এসব থাকবেই। করোনা সেই রোগের তালিকায় শুধু আরেকটা নাম মাত্র। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পেশাতে আসা, সেটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ শুধু একটাই, ডাক্তারিটা এখনো একটা Thankless job. সমাজের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই, তার কারণ সমাজে প্রকৃত শিক্ষার আলোই নেই। আজ একটা ভিডিও দেখলাম, কয়েকজন সাধুকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, পৈশাচিক আনন্দে!! আচ্ছা এরা কি মানুষ!! আমরা হাসপাতালে মৃতপ্রায় ৯৫ বছরের বুড়োকেও কীভাবে আরো আধ ঘন্টা বেশি বাঁচিয়ে রাখা যায় সেই নিয়ে প্রাণপাত করি, হয়তো সেই সময়ে অন্য ওষুধগুলো কাজ করার সময় পেয়ে যাবে, হয়তো মানুষটা বেঁচে উঠবে!! একেকটা প্রাণকে একেকটা মিনিট বেশি বাঁচানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি, উল্টোদিকে আমাদেরই প্রজাতির কিছু মানুষ অবলীলায় মানুষ হত্যা করছে!! এই সমাজের কাছে আমরা কী প্রত্যাশা করবো ?
কিন্তু একটা কথাই বলবো, করোনা ডাক্তারদের হারাতে পারেনি, পারবেও না। বন্ধ ঘরে ঢুকে ফেসবুকে ডাক্তারদের নিয়ে যাই কুৎসাচর্চা করুন, দিনের শেষে আমরাই জিতবো- যেভাবে এতদিন জিতে এসেছি, আমাদের নিষ্ঠায় ভর করে, আমাদের শ্রমে ভর করে-
“জন হেনরীরা মরেও মরেনা, গানে গানে থেকে যায়
কান পেতে শোনো হাতুড়ি এখনো শ্রমিকের গান গায়”
ডাক্তারবাবুদের ধন্যবাদ জানানোর জন্য চাই, সমাজ চেতনা। যা আমাদের আপত শিক্ষিত মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া খুব দুরহ।