পলিসি ওয়াচ-এ হু-র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক (SEARO) ডিরেক্টর নির্বাচন নিয়ে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল “Shenanigans in WHO South-East Asia as Politician’s Daughter Contests Regional Director Election” শিরোনামে (১৮.০৯.২০২৩)। এখানে “shenanigans” শব্দটির ব্যবহার নজর আকর্ষণ করে। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী এ শব্দটির অর্থ – “secret or dishonest activity or manoeuvring”
বিশ্বব্যাপী হু-র কার্যকলাপ মোট ৬টি আঞ্চলিক ভাগে বিভক্ত। (১) African Region (AFRO), (২) Region of the Americas (AMRO), (৩) Eastern Mediterranean Region (EMRO), (৪) European Region (EURO), (৫) South-East Asia Region (SEARO), এবং (৬) Western Pacific Region (WPRO)। ভারত SEARO অঞ্চলের হেড কোয়ার্টার্স। ৩ দিন ধরে এখানে SEARO অঞ্চলের ডিরেক্টর জেনারেল নির্বাচন হয়েছে। এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সাইমা ওয়াজেদ এবং নেপালের ৩০ বছরের পাবলিক হেলথ এবং একে উপযুক্তভাবে পরিচালনার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ ডঃ শম্ভু প্রসাদ আচার্য-র মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ১০টি দেশ ভোট দিয়েছিল। মায়ানমার সামরিক রাষ্ট্র বলে ভোটাধিকারের অধিকার ছিলনা। ফলাফল? প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ডিরেক্টর জেনারেল পদে বিজয়ী হয়েছেন ৯-১ ভোটে। ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে একটি ছোট খবর বেরিয়েছিল (২.১১.২০২৩) – শেখ হাসিনা ভারতে উগ্রপন্থী দমনের ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। ভারতের ভোট গিয়েছে তাঁর কন্যার পক্ষে। সাম্প্রতিককালে হু-র কোন নির্বাচনে এরকম নজিরবিহীন বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি।
SEARO অন্তর্ভুক্ত ১১টি দেশের নাম হল – Brunei, Burma (Myanmar), Cambodia, Timor-Leste, Indonesia, Laos, Malaysia, the Philippines, Singapore, Thailand এবং Vietnam। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখানে বাস করে। হু-র ওয়েবসাইটে এই অঞ্চল সম্পর্কে বলা হয়েছে – “প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন-জনিত বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি-প্রবণ এ অঞ্চল হু-র অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার to strengthen emergency risk management for sustainable development. ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ তথা সার্বজনীন স্বাস্থ্যের সুরক্ষা (UHC) এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া (প্রোমোট) আর building robust health systems are key priorities. The Region has eight flagship priority programmes, aligned to WHO’s global triple billion goals and the UN Sustainable Development Goals.” এ থেকে বোঝা যায় অন্যান্য অঞ্চলের থেকে পৃথকভাবে এ অঞ্চলটি হু-র কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এবং সমগ্র বিষয়টির সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য প্রয়োজন জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবায়িত করার জন্য ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা।
এখানে একটি তথ্যের উল্লেখ আশা করি SEARO নির্বাচনের বিশিষ্টতা বুঝতে সাহায্য করবে। কদিন আগে Eastern Mediterranean Region (EMRO)-র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৬ জন এবং Western Pacific Region (WPRO)-র নির্বাচনে সে সংখ্যা ৫ জন। কিন্তু South-East Asia Region (SEARO)-র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ মাত্র ২ জনের মধ্যে। এই ২ জন প্রতিযোগীর বায়োডাটা বেশ মজার। সাইমা ওয়াজেদ বাংলাদেশ ছাড়াও কানাডার নাগরিক। শিক্ষাগত যোগ্যতায় ক্লিনিকাল সাইকোলজিতে এমএ এবং “licensed school psychologist”। পাস করেছেন একটি প্রাইভেট ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি Barry University (মায়ামি, ফ্লোরিডা) থেকে। পাবলিক হেলথের ব্যাপারে এর থেকে বেশি আর কোন তথ্য তাঁর জীবনপঞ্জীতে পাওয়া যায়না। জানা যায়, তিনি অটিজম-এর ওপরে কাজ করেছেন।
ডঃ শম্ভুপ্রসাদ আচার্য পাবলিক হেলথে নর্থ ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা, থেকে ডক্টরেট করা ছাড়াও সোশ্যাল পলিসি, পপ্যুলেসশন ইকনমিক্স এবং বায়োস্ট্যাটিস্টিক্সে-এ মাস্টার্স করেছেনে আমেরিকার Ball State University, Indiana থেকে। পাবলিক হেলথের ওপরে কাজ করার অভিজ্ঞতা ৩০ বছরের বেশি। এমনকি তিনি “has previously worked as the Director of WHO to support Nepal and collaborate with the UN system”। ডঃ শম্ভুপ্রসাদ একটি গ্রামীণ পরিবারে জন্মে বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে প্রান্তিক মানুষেরা কতরকমের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় সেগুলো জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন।
জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবায়িত করার জন্য ম্যানেজমেন্টের দক্ষতার বিপরীতে ক্লিনিকাল সাইকোলজিতে মাস্টার্স এবং অটিজম-এর ওপরে কাজ করা কি যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবী করে – অন্তত হু-র নিজের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী?
উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, শেখ হাসিনা এই নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হবার অনেক আগে থেকেই নিরুচ্চার নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন তাঁর কন্যাকে সাথে নিয়ে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন, হু-র ডিরেক্টর জেনারেল তেদ্রোস আধানোম গেব্রেয়ুসাস, UN-এর সেক্রেটারি-জেনারেল গুতেরেস, ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রভৃতি তাবড় বিশ্ব প্রধানদের সাথে পরিচয় পর্ব শুরু করে দিয়েছিলেন। এর পরোক্ষ প্রভাব সহজেই অনুমেয়।
(বাইডেন ও তাঁর পত্নীর সঙ্গে শেখ হাসিনা এবং সাইমা ওয়াজেদ)
হু-র গঠনগত বিন্যাস এরকম – WHO African Region – 46 countries, WHO European Region – 53 countries, WHO Eastern Mediterranean Region – 21 countries, WHO Region of the Americas –35 countries, WHO South-East Asia Region – 11 countries এবং WHO Western Pacific Region – 27 countries। South-East Asia Region-এর জনসংখ্যা ২০০ কোটির বেশি এবং হু-র বাৎসরিক বাজেট বরাদ্দ ৫০০ মিলিয়ন ডলার। ফলে এ অঞ্চলের জনসংখ্যাগত এবং আর্থিক বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
৩ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত হয় (মে ২৬, ২০২৩) “WHO regional elections—more transparency and scrutiny essential” শিরোনামে। চিঠিটির শুরুতে তাঁরা জানান – “There are many weighty issues on the agenda of the World Health Assembly this week. Worryingly, no agenda item or side events have been devoted to the Regional Director elections this year.” চিঠির শেষে তাঁরা এক বিপজ্জনক ইঙ্গিত দেন – “Guidance, transparency, and limits on campaign finance are urgently needed. All of these might go some way to limit the political trading that has marked previous elections and help ensure the best person for these increasingly important posts is appointed.” সহজ করে বললে, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এই খ্যাতনামা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হু-র কাছে জরুরীভাবে দাবী করছেন – SEARO নির্বাচনে স্বচ্ছতা এবং নির্বাচনী প্রচারের ক্ষেত্রে লাগামছাড়া খরচের সীমা বেঁধে দিতে (আমাদের দেশের বিভিন্ন নির্বাচনের কথা পাঠকদের মনে পড়বে নিশ্চয়ই)। এবং তাঁরা রাজনৈতিক কেনাবেচা (political trading)-র (আমাদের এখানে যেমনটা ভোটের পরে “ঘোড়া কেনাবেচা” হয়) ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে বলছেন, বলছেন সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ যেন এ পদের দাবীদার হতে পারে। নির্বাচনের পরে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করল এর কোনটিই হু যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।
মে মাসের পরে সেপ্টেম্বর মাসে (২৩.০৯.২০২৩) ল্যান্সেট-এ এ নির্বাচনের ব্যাপারে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল “Protecting the integrity of WHO’s regional offices”। এ লেখায় বলা হয় – “বিশ্বস্বাস্থ্য (গ্লোবাল হেলথ) এখন সংকটের মধ্যে। ক্রমবর্ধমান অসাম্য, ক্রমাগত বেড়ে চলা অসংক্রামক ব্যাধির (যেমন ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, ক্যান্সার ইত্যাদি) বোঝা, এবং ভবিষ্যতের অতিমারির আশঙ্কা আরও জটিল হয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বহুসংখ্যক ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষের ফলে। এইডস, টিবি ও ম্যালেরিয়া এবং একই সঙ্গে নারী ও শিশুদের পরিহারযোগ্য মৃত্যু সমগ্র বিষয়গুলোর urgent concerns দাবী করে। খাদ্যের অনিশ্চয়তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। একই সময়কালে স্বাস্থ্যখাতে ধারাবাহিকভাবে ব্যয়বরাদ্দ হ্রাস বিপজ্জনক বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হু, একমাত্র বহুপাক্ষিক বৈধ সংস্থা যে নিবেদিত স্বাস্থ্যকে রক্ষা এং বিকশিত করার কাজে, এই সংকটে কার্যকরী নেতৃত্ব দিতে পারে, এবং এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু “global priorities” এবং ৬টি বিভিন্নভাবে বিন্যস্ত আঞ্চলিক অফিসের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করা একটি শক্ত চ্যালেঞ্জ। হু-র শক্তিশালী আঞ্চলিক এবং বিভিন্ন দেশের অফিসগুলোকে শক্তিশালী করে তোলা আরও এখন বেশি বেশি করে গুরুত্ববহ হয়ে উঠছে। তবুও একটি অশুভ প্রশ্নের পর্দা এ ভবিষ্যতের ওপরে ঝুলছেঃ কিভাবে আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসন-পরিচালনাকে (governance) উন্নত করা যায় এটা সুনিশ্চিত করার জন্য যে আঞ্চলিক এবং দেশের অগ্রাধিকারগুলো উপযুক্তভাবে ভাষা পাচ্ছে?” (পৃঃ ১০১৭)
একই দিনে (২৩.০৯.২০৩) ল্যান্সেট-এ আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল “Criticism over WHO Regional Director nominee” শিরোনামে। এ লেখায় বলা হল – “The Bangladeshi regime has been criticised by Amnesty International and Human Rights Watch, as well as independent experts appointed by the UN, for repressive internal policies.” জানানো হল – “ল্যান্সেট-এর তরফে সাইমা ওয়াজেদকে যেসব ইমেল পাঠানো হয়েছিল সেগুলো সবই ফেরত এসেছে, সম্ভবত ভুয়ো আইডি। এমনকি টেক্সট মেসেজেরও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।” বাকিটা পাঠকেরা বুঝে নিন।
একেবারে শুরুতে হেলথ পলিসি ওয়াচ-এর যে প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করেছিলাম সে প্রবন্ধে একটি অনুধাবনযোগ্য মন্তব্য করা হয়েছিল – “being introduced by her mother at recent high-level summits such as BRICS, ASEAN, G20 and the UN General Assembly to craft deals in exchange for votes may be seen as crossing the fine line between a government’s legitimate lobbying for its candidate and craven nepotism.”
যাহোক হু এবং রাজনৈতিক প্রভাবের পারস্পরিক মিথিষ্ক্রিয়া নতুন কিছু নয়। একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই এ প্রক্রিয়া চলে এসেছে। আমরা হু-র জন্মলগ্নের কাহিনী অতি সংক্ষেপে একবার বুঝে নিই। এ ইতিহাসও চিত্তাকর্ষক।
“ভুলে যাওয়া” স্বাস্থ্যের দিন এবং হু-র জন্মলগ্নের কথা
সিবা ফাউন্ডেশন-এর ১০০তম সিম্পোসিয়াম আয়োজিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে লন্ডনে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশেষ খ্যাতনামা এবং মান্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ সিম্পোসিয়ামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের একজন ছিলেন কার্ল ইভাং (Karl Evang) – নরওয়ে সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা উপদেষ্টা, যিনি হু-র একজন co-founder-ও বটে। Gordon Wolstenholme এবং Maeve O’Connor-এর সম্পাদনায় এই সিম্পোসিয়ামে প্রদত্ত সমস্ত লিখিত ভাষণ Health of Mankind নামে প্রকাশিত হয় (London: J. A. Churchill, 1967).
এই পুস্তকে “Political, National and Traditional Limitations to Health Control” শিরোনামে ইভাং-এর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় (পৃঃ ১৯৬-২১৭)। এ প্রবন্ধে তিনি বিশ্বের স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণে জাঁদরেল সব কূটনীতিক এবং মন্ত্রীদের যৌগপদ্যের এক অজানা ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন – “One interesting historic example is that health was “forgotten” when the Covenant of the League of Nations was drafted after the first World War. Only at the last moment was world health brought in, producing the Health Section of the League of Nations, one of the forerunners of the present FAO, as well as of WHO. Although international participation in the League of Nations was limited, the Health Section of the League developed into one of the most successful and non-controversial parts of the organization, making itself indispensable through its statutory functions.” (পৃঃ ২০২)
বিষয়টি এখানেই মিটে যায়নি। ইভাং কৌতুক এবং বিস্ময় নিয়ে জানাচ্ছেন – “Who would have thought, therefore, that health would again be “forgotten” when the Charter of the United Nations was drafted at the end of the Second World War? However, this was exactly what happened, and the matter of world health again had to be introduced more or less ad hoc at the United Nations conference at San Francisco in the spring of 1945.” (পৃঃ ২০২-২০৩) অস্যার্থ, কে ভেবেছিলো যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন রাষ্ট্রপুঞ্জের চার্টার তৈরি হচ্ছে তখন স্বাস্থ্য আবার “forgotten” হয়ে যাবে? ঠিক এটাই ঘটেছিলো যখন ১৯৪৫-এর বসন্তে সান ফ্রান্সিসকোতে “জরুরী ভিত্তিতে” বিশ্ব স্বাস্থ্য-কে আলোচ্য তালিকায় আনা হয়। তিন জন মানুষ সেদিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন – ব্রাজিলের তরফে ডাক্তার Paula Souza, চীনের তরফে ডাক্তার Szeming Sze এবং নরওয়ের তরফে ডাক্তার ইভাং স্বয়ং।
এই পরিপ্রেক্ষিতে হু-র ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৫ সালে কূটনীতিবিদরা মিলে ইউনাইটেড নেশনস-এর জন্ম দেন তখন তাঁদের আলোচনায় একটি “global health organization” তৈরির প্রসঙ্গ আলচিত হয়। ফলশ্রুতিতে ৭ এপ্রিল, ১৯৪৮-এ হু-র সংবিধান গৃহীত হয়। এ তারিখটি এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালিত হয়। এবং আমরা ইভাং-এর নিজের বয়ানে এর পেছনের ইতিহাস জেনেছি একটু আগে।
(কার্ল ইভাং)
এখানে যে কোন জিজ্ঞাসু পাঠককে ভাবাবে, স্বাস্থ্যের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বারেবারে ভুলে যাওয়া হচ্ছিল কেন? সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হবে সম্ভবত বাণিজ্য হিসেবে স্বাস্থ্য কতটা লাভজনক হতে পারে এবং কি পরিমাণ মুনাফা দিতে পারে তা তখনো অব্দি বহুজাতিক কোম্পানী এবং বিশ্বে প্রভুত্বকারী ইউরো-আমেরিকার দেশগুলোর মাথায় আসে নি, বোধ করি ভালোভাবে নজরেও আসে নি।
পরবর্তীতে, ২০০৫ সালে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীগুলোর পৃথিবীতে বিক্রীর পরিমাণ ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলার, ২০০৭-এ হল ৭১২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দু বছরে বিক্রী বেড়েছে শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশী। (সূত্রঃ Adriana Petryana – When Experiments Travel, Princeton University Press, 2009) ২০১৮-তে এর পরিমাণ ছিল ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। আরো গুরুত্বপূর্ণ হল এশিয়া এবং আফ্রিকায় ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বাজার বৃদ্ধির হার ১৭%, পূর্ব ইউরোপে ১১% এবং লাতিন আমেরিকায় ১০%। অথচ সমগ্র বিশ্বে এ হার মাত্র ৪%। আরেকটা তথ্য হল ২০০৫ সালে প্রযুক্তি-নির্ভর মেডিসিনের চাপে পড়ে ব্রাজিলকে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।
এরকম একটি লাভজনক বিনিয়োগের চিত্র যতদিন না স্পষ্ট হয়ে ঊঠেছে, ততদিন অব্দি নিও-লিবারাল অর্থনীতির কান্ডারীরা স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিনিয়োগ কর্মে সেভাবে হাত লাগায় নি। ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ ও বিপুল মুনাফার ধারণা নির্দিষ্টভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। সাথে সাথে বদলাতে শুরু করে ১৯৪৫ সাল অব্দি আন্তর্জাতিক জগতে “forgotten” বিষয়টির চরিত্র। এক নতুন যাত্রাপথ জন্ম নেয় – ১৯৭৮ সালের আলমা আটা সম্মেলনের “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা”-র (comprehensive primary health care) এবং “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র বোধ থেকে ২০১৫-তে এসে অতিমাত্রায় বিক্রয়যোগ্য “স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র পণ্য বাজারের বোধে প্রায় পূর্ণত রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া। অধুনা গবেষকেরা দেখিয়েছেন, আফ্রিকার যে দেশগুলোতে এবোলা (Ebola) এরকম মারণান্তক চেহারা নিল সে দেশগুলোতে IMF এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর চাপে জনস্বাস্থ্য খাতে ক্রমশ খরচা কমিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর (যেমন সিটি স্ক্যানার বা MRI কিনতে হয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে) স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়েছে। ফলে এবোলা যখন মহামারির চেহারা নিয়েছে তার সাথে মোকাবিলা করার মতো কোনরকম পরিকাঠামো এ দেশগুলোতে ছিল না। এমনকি সামান্য গ্লাভস, মাস্ক কিংবা গাউনও পাওয়া যায়নি প্রথমদিকে।
আমাদের এ আলোচনায় আমরা চারটে বিষয় নিয়ে ভেবে দেখবো – (১) “সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র শ্লোগান কি করে স্বাস্থ্য পরিষেবার মুক্ত বাজারের অর্থনীতির আওতায় চলে এলো; (২) প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার সংহত ধারণা কিভাবে বেছে-নেওয়া (selective) স্বাস্থ্য পরিষেবার ধারণাতে রূপান্তরিত করা হল, যার ফলে ঝাঁ চকচকে অত্যন্ত দামী (নামীও বটে) পাঁচতারা হাসপাতাল বা নার্সিং হোম “ভালো স্বাস্থ্য”-র সমার্থক হয়ে উঠলো; এবং (৩) ক্লিনিক্যাল হেলথ বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসা এবং পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যের মধ্যেকার দার্শনিক অবস্থানগত পার্থক্য মুছে গিয়ে দুটোই একাকার হয়ে গেলো, এবং (৪) কিভাবে জনমানসে “ভার্টিকাল হেলথ” অর্থাৎ ব্যক্তিরোগীর রোগ ধরে চিকিৎসা প্রতিস্থাপিত করছে “হরাইজন্টাল হেলথ” অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য বলতে যা বোঝায় সে ধারণাকে। একইসাথে আমরা নজরে রাখবো মেডিসিনের জগতে শিক্ষাক্রমের ক্রম-রূপান্তর এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে ত্বরাণ্বিত করলো এবং এ পরিবর্তনের একটি উপাদান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল। এবং এ সমস্ত ক্ষেত্রেই হু-র ভূমিকা পুনর্বিবেচনার দাবী রাখে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, কার্ল ইভাং ১৯৫৩ সালে ভারতেও এসেছিলেন, ডাক্তারি ছাত্র, ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্তাদের সাথে ২য় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ে বিশ্বের স্বাস্থ্য সংকট নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন। একজন গবেষক মন্তব্য করছেন – “Considering Evang’s strong commitment to social medicine, an additional main question revolves around the role and legacy of social medicine in early post-war international health cooperation.” (Sunniva Engh, “The complexities of postcolonial international health: Karl Evang in India 1953”, Medical History 2023 Jan; 67(1): 23–41)
আরেকটি গবেষণাপত্রে এ বিষয়ে আরও বিশদে আলোচনা করা হয়েছে – “Scandinavian entry points to social medicine and postcolonial health: Karl Evang and Halfdan Mahler in India” (Sunniva Engh এবং Niels Brimnes, Medical History 2023 Jan; 67(1): 1–4)
এখানে আরেকটি তথ্যও ঊল্লেখের দাবী রাখে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সূচনালগ্নে ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হু ছেড়ে বেরিয়ে যায় বা বের করে দেওয়া হয়। পশ্চিমী লগ্নি পুঁজির লবি সে সময় থেকেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এক গবেষক দেখিয়েছেন (Anne-Emmanuel Birn) (“The stages of international (global) health: Histories of success or successes of history?” Global Public Health 2009, 4(1): 50-68), যদিও সোভিয়েট রাশিয়া ১৯৪৯-১৯৫৭ পর্যন্ত সময়ে হু-র সদস্য ছিলো না কিন্তু হু-র বাৎসরিক বাজেটের ৬% যোগাত এ দেশটি। ১৯৫৯ সালে সদস্য হবার পরে এর পরিমাণ বেড়ে হয় ১৩%।
Elizabeth Fee, Marcu Cueto এবং Theodore M. Brown-এর গবেষণাপত্র “At the Roots of The World Health Organization’s Challenges: Politics and Regionalization” (American Journal of Public Health, 2016 November; 106(11): 1912–1917) দেখিয়েছে – হু-র জন্মের প্রথম দশক থেকেই এর নেতৃত্ব কারা দেবে এটা একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল। বলছেন – “The agency moved closer to US foreign policy and became partially captive to US resources and priorities. It pursued a pragmatic course of limited objectives, settled upon an institutional structure of regionalization—incorporating compromises over decolonization—and initiated several disease control programs.”
সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে ১৯৪৯ হু-র সম্পর্ক ছিন্ন হবার পরে যে সোশ্যাল মেডিসিন বা মানুষকে কেন্দ্রে রেখে মেডিসিনের এবং বিশ্বস্বাস্থ্যের নীতি নির্ধারণের যে ঝোঁকটি প্রাধান্যকারী জায়গায় ছিল তার পরিবর্তন ঘটলো। বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক মেডিসিন (“techno-centric”) অর্থাৎ নতুন প্রযুক্তির উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে মানুষকে – এমন ধারণা প্রাধান্যকারী স্থান নিতে শুরু করল। এ পরিবর্তনের একটি ভয়ঙ্কর ইতিহাস ধরা আছে রাচেল কারসন-এর পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী পুস্তক Silent Spring-এ (১৯৬২ সালে প্রথম প্রকাশিত)। এ পুস্তকের ৪০তম বার্ষিকীর ভূমিকায় লিন্ডা লিয়ার লিখছেন – “Carson questioned the moral right of government to leave its citizens unprotected from substances they could neither physically avoid nor publicly question. Such callous arrogance could end only in the destruction of the living world.” (পৃঃ xv)
র্যাচেল কারসন তাঁর বইয়ের শুরুতেই সেই পৃথিবীর ছবি তুলে ধরেছেন যেখানে ডিডিটির (এবং অপরিমিত প্রযুক্তির ব্যবহারে) যথেচ্ছ ব্যবহারের (যেখানে মানুষকে কেন্দ্রে রাখা হয়নি, কেন্দ্রে আছে মুনাফা) ফলশ্রুতিতে নিষ্পত্র, পাখীর কলকাকলিহীন, সবুজের দিগন্ত প্রসারিত বিস্তারের পরিবর্তে পড়ে রয়েছে ঊষর প্রান্তর যেখানে প্রাণের কোন স্পর্শ নেই। নেই জীবনের কোন অফুরন্ত সমারোহ। ডিডিটির ব্যবহারে এমনকি মৃত্তিকার চিরকালীন অবিচ্ছেদ্য বন্ধু কেঁচোরা বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর “ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা”।
তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে কারসন লিখছনে – “Dead earthworms had been seen in numbers after a gentle rain; probably the robins had fed on the poisoned worms. For other birds, too, the once beneficial rain had been changed, through the evil power of the poison introduced into their world, into an agent of destruction. Birds seen drinking and bathing in puddles left by rain a few days after the spraying were inevitably doomed.”
যাহোক, আমরা Elizabeth Fee, Marcu Cueto এবং Theodore M. Brown-এর পূর্বোক্ত গবেষণাপত্রে ফিরে আসি। এঁদের প্রবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে – ১৯৫০ সালে আমেরিকার Willard L. Thorp, Assistant Secretary of State for Economic Affairs, “আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন”-এর বার্ষিক সম্মেলনে বলেছিলেন, রোগ এবং দারিদ্র্যের সাথে অবশ্যই যুৎসই লড়াই করতে হবে কারণ এরা “feed communism” এবং এভাবে “threaten the “very survival of our democracy.”। (পৃঃ ১৯১৩) মজার ব্যাপার হল কোন দার্শনিক বা নৈতিক অবস্থান থেকে ক্ষুধা, রোগ এবং দারিদ্র্যের সাথে লড়াই নয়, এগুলো থাকলে পুঁজি-নির্ভর গণতন্ত্রের পরিবর্তে কমিউনিজম মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে এ কারণে। অর্থাৎ, ১৯৪৯-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন হু থেকে বেরিয়ে যাবার পরে তৎকালীন দ্বি-মেরু বিশ্বে স্বাস্থ্যের আঙ্গিনায় রাজনীতির সদম্ভ, বলদর্পী পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল।
অথচ, “By the early 1950s, the WHO had developed and approved a 4-year plan for fellowships, and by 1956 had provided more than 5000 of them to health professionals from 149 countries, thus helping to build or reconstruct public health systems.” শুধু এটুকুই নয় – “It had also completed important work in standardization, such as in the Sixth Revised List of Diseases, Injuries and Causes of Death, the International Pharmacopoeia, the list of biological standards for drugs, and International Sanitary Regulations (1952). These new regulations standardized quarantine and, thus, the control of smallpox, plague, cholera, yellow fever, louse-borne typhus, and louse-borne relapsing fever, all defined as subject to quarantine.” (পৃঃ ১৯১৩)
সবশেষে লেখকেরা জানাচ্ছেন – “Perhaps of greatest importance is the arrival of new and powerful competitors: among them, the World Bank and the Bill and Melinda Gates Foundation, each with very large financial resources.”
একসময়ে বাংলার গ্রামে শ্লোগান ছিল “লাঙ্গল যার জমি তার”। সেরকমই নতুন শ্লোগান যেন তৈরি হল “টাকা যার সংগঠন তার”। আপাতত এর সর্বশেষ উদাহরণ হল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত (৯.১১.২০২৩) প্রতিবেদন “Breaking Up Is Hard to Do — More Heartbreak from Corporate Decisions in Medicine”।
তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে
খানিকটা ভিন্ন প্রসঙ্গে গিয়ে বলা যায়, ১৯৭৭ সালে Allan Enthoven মুক্ত বাজারের উপযোগী Consumer Choice Health Plan (“এ ন্যাশনাল হেলথ ইন্সিউরেন্স প্রোপোজাল বেসড অন রেগুলেটেড কমপিটিসন ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর”) তৈরি করলেন। আমেরিকার কার্টার প্রশাসন এটাকে অনুমোদন করলো। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে “Consumer Choice Health Plan” শিরোনামে দুটো কিস্তিতে প্রকাশিত হল এ লেখা। ১৯৭৯-এর ২৭শে ডিসেম্বর Wall Street Journal-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখালো যে হেলথ কেয়ার করপোরেশনগুলোর নীট আয় ১৯৭৯ সালে ৩০-৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৯৮০ সালে আরো ২০-২৫% আয় বৃদ্ধি প্রত্যাশিত।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এর প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক তাঁর এক প্রবন্ধে জানালেন – ১৯৭৯ সালে কেবলমাত্র বিভিন্ন ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার এবং যৌগিক পদ্ধতিতে প্রতি বছরে শতকরা ১৫ ভাগ হারে বাড়বে। (Arnold Relman, “The New Medical-Industrial Complex,” NEJM 1980, 303(17): 963-970) এ লেখাতেই রেলম্যান জানালেন যে আমেরিকানরা ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং মালিকানায় মুনাফার তাগিদকে বিশ্বাস করে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো যে মেডিক্যাল পরিষেবাকে মুক্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দেবার এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে দেখার প্রথম প্রস্তাব আসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র সুবিখ্যাত গবেষণাপত্র “Uncertainty and the Welfare Economics of Medical Care”। এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল The American Economic Review-এ ১৯৬৩ সালে। মজার ব্যাপার হল জনস্বাস্থ্য নিয়ে WHO-র অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট পুঁজির চাপে যখন ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে, সংকুচিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ তখন অর্থাৎ ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে WHO-র মুখপত্র Bulletin of the WHO-তে কেনেথ অ্যারো-র লেখাটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হল। মূল লেখাটি ৩৩ পৃষ্ঠার, WHO ছেপেছিল ৯ পৃষ্ঠা।
অ্যারো তাঁর অবস্থান প্রবন্ধের গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন – “the subject is the medical-care, not health. The causal factors in health are many, and the provisio of medical care is only one.” এরপরে তিনি “analysis of the medical-care market”-এ প্রবেশ করেন। বলেন – “in the analysis of the medical-care market is comparison between the actual market and the competitive model…” ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ আনেন অ্যারো – “It is frequently observed that widespread medical insurance increase the demand for medical care.” এক অদ্ভুত যুক্তি জালের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলাম – একদিকে, ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ এলো স্বাস্থ্য পরিষেবার জগতে; অন্যদিকে, ইন্সিউরেন্সের বহু বিস্তৃত ব্যবহার যে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়াবে এ প্রসঙ্গও চলে এলো। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি যে পণ্য দুনিয়ার অন্য ক্ষেত্রের মতো এখানে শুধু কেনাবেচার-র সম্পর্ক নয় – একজন ব্যক্তি মানুষের অন্যের স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা ও ঊদ্বেগ থাকে যা পণ্য জগতের অন্য ক্ষেত্রে দেখা যাবেনা। তাঁর অভিমত – “The economic manifestations of this taste are to be found in individual donations to hospitals and to medical education, as well as in the widely accepted responsibilities of government in this area.” KFC, Nike কিংবা অ্যাডিডাসের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই এ দৃশ্য দেখতে পাবনা।
একটি অতি শক্তিশালী “মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স” গড়ে উঠলো, কোথাও বা “মিলিটারি-মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স”। Daniel Carlat একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাইকিয়াট্রিস্ট এবং Tufts Medical School-এর ফ্যাকাল্টি। ২৫শে নভেম্বর ২০০৭-এর নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তাঁর দু পাতা জোড়া আত্মকথন “Dr. Drug Rep” প্রকাশিত হয়েছিলো। এই আত্মকথনে জানান, কিভাবে Wyeth কোম্পানির আমন্ত্রণে তিনি বিলাসবহুল Millennium হোটেল-এ পৌঁছোন এবং তাঁর শাখার একজন নামী গবেষকের সাথে আলাপ হয়। Wyeth কোম্পানির তৈরি একটি নতুন anti-depressant ওষুধ venlafaxin (Effexor) নিয়ে Carlat-এর বক্তব্য রাখার কথা ছিলো এবং দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি এ কাজটি করেওছিলেন। তাঁর দেওয়া হিসেব অনুযায়ী নিজের প্র্যাক্টিস থেকে তাঁর ১,৪০,০০০ ডলারের মতো আয় ছাড়া Wyeth কোম্পানির বক্তা হিসেবে আয় ছিলো ৩০,০০০ ডলার। একবার একটি সেমিনারে বক্তা হিসেবে বলার সময় Effexor যে রক্তচাপ বাড়ায় সে বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য ইচ্ছাকৃতভাবে করেন নি। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এই পার্শ্ব–প্রতিক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে নিতান্ত বিরক্তি প্রকাশ করেন। Carlat-এর বয়ানে – I wondered if he saw me for what I feared I had become – a drug rep with an M.D. I began to think that the money was affecting my critical judgement. পরবর্তীতে তাঁর এ উপলব্ধি আরো দৃঢ় হয় যে তাঁকে শুধু Effexor-এর বিক্রী বাড়ানোর জন্য অর্থ দেওয়া হয়েছে, এতো যত্ন-আত্তি করা হয়েছে – Once I stopped doing that, I was of little value to them, no matter how much “medical education” I provided. এবং সে মুহূর্ত থেকে তিনি এ যোগসূত্র ছিন্ন করেন, স্বাধীন সত্তা নিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন আবার।
অসুস্থতা বিক্রীর (selling sickness) ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি জায়গাকে soft target হিসেবে নেওয়া হয় – সাইকিয়াট্রিক এবং লাইফস্টাইল ড্রাগ। সাইকিয়াট্রিক ওষুধের ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে American Psychiatric Association-এর তত্ত্বাবধানে তৈরি Diagnostic and Statistical Manual (DSM), যা সাইকিয়াট্রির জগতে বাইবেলতুল্য। ১৯১৭ সালে প্রথম প্রকাশিত DSM-এ রোগের সংখ্যা ছিলো ৫৯টি। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে DSM-V. এতে ৩৭৫টি মতো অসুখের ক্যাটিগরি বলা হয়েছে। এরকম একটী সাম্প্রতিককালে জন্ম নেওয়া অসুখের নাম “shyness syndrome”। এই নতুন নামকরণে আসার আগে মাসের মাসের মাস DSM-এর বিশেষজ্ঞরা সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন নতুন নাম ঠিক করা নিয়ে – “chronic complaint disorder” বা “chronic undifferentiated happiness” প্রভৃতি নামকরণকে পরিত্যাগ করা হয়, গ্রহণ করা হয় “shyness syndrome”।
আজ থেকে ২২ বছর আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ২৪শে জুন ২০০১ সংখ্যায় মার্গারেট ট্যালবট একটি প্রবন্ধ লেখেন – “The Shyness Syndrome”. এ প্রবন্ধে তিনি দেখান, ডেভিড বেকহ্যাম, স্পাইস গার্ল বা রিকি উইলিয়ামস-এর মতো সেলিব্রিটিরা ওষুধ কোম্পানির টাকায় মিডিয়ার সামনে কেমন করে নতুন ধরণের social phobia-র শিকার হচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন। একটি নতুন anti-depressant ওষুধ তৈরি হচ্ছে social phobia-র জন্য। যে বিশেষ বৈশিষ্ট মানুষের ভিন্নতার জন্ম দেয়, সেরকম একটি বৈশিষ্ট স্বল্পবাক বা লাজুক চরিত্রকে medicalize করে ফেলতে পারলে তা ওষুধের ও চিকিৎসার আওতার মধ্যে চলে আসবে। নতুন ওষুধ তৈরি হবে। কয়েক মিলিয়ন বা বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হবে। ক্রিস্টোফার লেন মন্তব্য করছেন – “Yet because DSM-III had so dramatically expanded the pharmaceutical market for anxiety disorders, SmithKline’s executives enthused, “The opportunity . . . is enormous—around 90 million adults in North America and Europe are affected at any one time.” (Christopher Lane, Shyness: How Normal Behavior Became a Sickness, Yale University Press, 2008, পৃঃ ১২১)
এমনকি ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত পুর্বোক্ত পুস্তকের বুক রিভিউ-এ মন্তব্য করা হয়েছে – “Treat someone for shyness, and the insurance companies will laugh at you. Treat someone with social phobia, with its DSM seal of approval as disorder 300-23, and the bill will be paid.” (“How shyness became social phobia”, Lancet March 29, 2008, পৃঃ ১০৬৩)
ট্যালবট পূর্বোক্ত প্রবন্ধে আশঙ্কা বোধ করেন এমন কোন দিন হয়তো আসবে যখন পৃথিবীতে মৃদুভাষী, স্বল্পবাক বা স্বভাব ভীরু বলে কিছু থাকবে না – Maybe in another generation or so, we’ll find ourselves sorely missing the meek and the mild, the stoic and the taciturn among us. Is somebody out there inventing the drug to treat excessive perkiness? এ আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তিতে আছে অর্থনৈতিক মুনাফা। আমেরিকাতে ওষুধ কোম্পনিগুলো বছরে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করে “on promoting their products.” (Lancet, “Dealing in drugs”, November 6, 2004, pp. 1655-56) অন্য আরেকটি প্রসঙ্গে গবেষকেরা দেখিয়েছেন, কিভাবে মহিলাদের কিছু স্বাভাবিক স্বভাবকে একটি বিশেষ রোগের নামে নামাঙ্কিত করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করা হয়। (Ray Moynihan and Barbara Mintzes, Sex, Lies + Pharmaceuticals: How Drug Companies Plan to Profit from Female Sexual Dysfunction, Allen & Unwin, 2010).
এভাবেই এখন হু-র চরিত্র আগাপাশতলা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এরই একটি প্রতিফলন ২০২৩-এর শেষে SEARO-র ডিরেক্টর নির্বাচন। কিভাবে বহুজাতিক কোম্পানি এবং নীতি নির্ধারকেরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে সেটা বিলক্ষণ বোঝা যাবে নীচের ভেন ডায়াগ্রাম থেকে। এ যেন একটি swinging door – এ পাশে বহুজাতিক, ও পাশে নীতি নির্ধারকেরা।
এখানে হু যেন একজন দর্শকের মতো আন্তরজাতিক লবির চাপে swinging door দিয়ে এপাশ ওপাশ করছে।
খুব ভালো লাগলো পড়ে। তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।
ঔষধ, ব্যবসা, ক্ষমতা, ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারবারিদের এই ইতিহাস আমাদের নতুন করে ভাবতে, বুঝতে, এবং শিখতে সাহায্য করবে।
হু এর চরিত্র বহুদিনই বদলে গেছে, আজ হঠাৎ করে সাইমা ওয়াজেদের নির্বাচন কখনোই খুব অবাক করা ব্যাপার নয়। কোভিডের শুরুর দিকে আমরা অনেকবার টেড্রোসকে সতর্ক করেছিলাম কোভিডকে PHEIC ঘোষণা করতে, ভদ্রলোক কানে তোলেননি। তখন জানতাম না, চিন আর আমেরিকার মধ্যে ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট যাতে না আটকায়, তাইজন্য এত ঢিলেমি।
হ্যাঁ, আপনার কথা যথার্থ
পলিটিক্স এক্ষণ সর্বর্তেই। কেউ নোটিশ করে না । দারুন লাগলো লেখাটা।
দারুন এক লেখা। পেছনের অনেক ইতিহাস দিয়ে সমৃদ্ধ। খুব ভালো লেগেছে। আবার মনে শংকাও জাগছে – বহুজাতিক ইন্ডাষ্ট্রীজ এর হাতে আমরা কি ভাবে বন্দী হয় রইছি।