গভীর রাতে আমরা সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিলাম, নিঃশব্দে ঘটনাটা ঘটে গেল। এর আগে আর পরের ঘটনা গুলো পরপর এত দ্রুত গতিতে এত সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে ঘটল, তাতে পূর্বপরিকল্পনার ছবিটি দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেল আমাদের কাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখলাম—অভয়া
ধরে ফেলেছে ওদের দুর্নীতির পাহাড়। টাকা নিয়ে পাস করানো,অনার্স পাইয়ে দেওয়া, বিরোধিতা করলে ফেল করানোর হুমকি, জাল ওষুধ আর যন্ত্রপাতির কারবারে কোটি কোটি টাকার উপার্জন, তার নির্দিষ্ট ভাগ ওপরে চলে যাওয়া, যা নিয়মিত কাজে লাগে ক্ষমতায় টিকে থাকার ভোট করানোয় আর সাধারণ মানুষকেঅনুদানের জালে জড়িয়ে ভোট কেনার কাজে। সব জেনে ফেলা আর ফাঁস করে দেবার দুঃসাহস দেখাতেই আমাদের এই সত্ আর সাহসী মেয়েটাকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হল।
যেখানে তাকে হত্যা করা হবে, জায়গাটিকে ভেঙে ফেলতে হবে। তাই আগে থেকেই সুরক্ষার দোহাই দিয়ে ভেঙে সংস্কারের অফিসিয়াল অর্ডার PWD কে দিয়ে করিয়ে রাখা হল। খুন করে তদন্তকারীকে বিভ্রান্ত করতে বডি সেমিনার রুমে রাখতে হবে। তাই সেমিনার রুমে সঞ্জয়ের সেমিনার রুমে ঢোকা আর বার হবার প্রমাণ রাখতে নির্দিষ্ট কয়েকটি cctv ক্যামেরা অটুট রেখে বাকিগুলো নষ্ট করা হল। পরিকল্পনা — অভয়াকে খুন করে
সঞ্জয়কে ডাকিয়ে এনে ঐ ক্যামেরার সামনে দিয়ে প্রবেশ ও প্রস্থান করিয়ে ক্যামেরায় ধরে রাখা। বেচারা সঞ্জয় কিছুই বুঝল না। অভয়াকে নিয়ম ভেঙে ঐ দিনই ডিউটি দেওয়া হল। পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করে সন্দীপ ঘোষ সন্ধেবেলা বাড়ি চলে গেলেন। তাঁরই নির্দেশ থাকল– ভোর বেলা তাঁর কাছে খবর যাবে। তখনই তিনি প্রথম জানতে পারবেন এবং বিস্মিত ও বিহ্বল হয়ে পড়বেন।
পরিকল্পনা মাফিক বিদ্যুৎ গতিতে ঘটনা ঘটে যেতে লাগল। ভোর বেলা সন্দীপ খবর পেয়ে ছুটে এলেন। কিন্তু পেছনের ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এলেন, যেখানে কোন cctv ক্যামেরা ছিলনা। পরিকল্পনার এক রেখায় পরপর দাঁড়িয়ে গেল খুনী চার চিকিৎসক, সন্দীপ, বিনিত গোয়েল আর সর্বোচ্চ প্রান্তে মুখ্যমন্ত্রী। খবর পেয়েই মুখ্যমন্ত্রী অনেকক্ষণ কথা বললেন গোয়েলের সাথে। এতক্ষণ কেন? খবর পেয়েতো তাঁর সংগে সংগেই ছুটে আসার কথা। যে পুলিশ হত্যায় জড়িত, তাকেই দেওয়া হল তদন্ত ভার। আর সুন্দর পরিকল্পনা মত দ্রুতগতিতে সমস্ত আইন-বিধি ভেঙে দায়সারা পোস্টমর্টেম সেরে ডেডবডি বার্নিংঘাটে ধোঁয়া করে বাতাসে মিলিয়ে দেওয়া। প্রমাণের খনি ডেডবডি পুড়ে যাবার পর অনেক রাতে FIR।
কেন এত বেপরোয়া হয়ে পড়ল সবাই এরা একসাথে? ওদিকে মঞ্চে প্রবেশ সর্বোচ্চ বিচারক চন্দ্রচূড় সহ আরও কিছু বিচারক ও সিবিআই,ওদের সাথে এক লাইনে দাঁড়িয়ে গেল এক লাইনে পর্দার পিছনের বিশেষ শক্তির খেলায়। ঝাড়গ্রাম থেকে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে গোয়েলের ফোনের কথোপকথন তদন্তের আওতায় আনার চেষ্টাই হলো না সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে। আমরা যে সবই দেখতে পেলাম দিনের আলোর মত। কিন্তু কেউ পৌঁছাতে পারছি না ঘটনার বিন্দু গুলোতে। পৌঁছাতে গিয়ে দেখলাম ধাক্কা খাচ্ছি সবাই। আবিষ্কার করলাম আমরা ধাক্কা খাচ্ছি ভয়ঙ্কর শক্তপোক্ত পুরু কাচের একটা দেওয়ালে। এত সচ্ছ কাচ, দেয়াল দেখাই যাচ্ছিল না। ধাক্কা খেয়ে দেখি সেটা কোটি কোটি টাকায় তৈরি।
মঞ্চে সবাই সময়মতো নিজেদের পাট ধরা -ছাড়া সুন্দর ভাবে করে গেছেন। ঝাড়গ্রাম থেকেই মুখ্যমন্ত্রী চেঁচাতে শুরু করেছেন–আমার দক্ষ পুলিশ অপরাধী কে ধরে ফেলেছে। সঞ্জয়ের ফাঁসি চাই। ভাইপোও দাঁড়িয়ে গেল এক লাইনে — ওকে একাউন্টার করে মারা হোক। কিন্তু আমরা যে দেখে ফেলেছি–একাধিক হত্যাকারীর হাতে খুন হবার প্রমাণ অভয়ার শরীরে। আমাদের দৃষ্টি ফেরানো গেলনা সঞ্জয়ের দিকে। মুখ্যমন্ত্রী সাতদিন সময় দিলেন পুলিশকে। ব্যর্থ হলে সিবিআই। ওটা অবশ্য পুলিশকে প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে নির্দেশ। জনান্তিকে নির্দেশ — সাতদিন কিন্তু অনেক সময়। আমার কাজ আমি করে দিয়েছি তোমাদের দক্ষতা দেখি। না,পুলিশ পেরেছে। তিন দিন পরে সিবিআই এর হাতে গেলেও ঐ সময়েই প্রমাণ লোপাটের মহান কাজের অনেকটাই সেরে ফেলেছে। তবু না। একশোভাগ না। টেকনোলজি যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
তাই চন্দ্রচূড় আর সিবিআইকে ও কিনতে হল কত কোটি টাকায়? সে অবশ্য আমাদের মত চুনোপুঁটিরা কীকরে জানবে? আমরা দেখলাম, সবই
দেখতে পেলাম — ঐ তো খুনী, ঐতো ধর্ষক, ঐতো প্রমাণ লোপাটকারী। কিন্তু পৌঁছাতে পারলামনা, সেই কোটি কোটি টাকার কাচের দেওয়ালে আটকে গেলাম।
কাচের দেওয়ালের ভেতরেই সব ঘটল। আমাদের শ্লোগান ঐ দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ফিরল, সিবিআই, বিচারক সবাই কাচের ভেতরে। বাইরে থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওদের কিছুতেই চোখে পড়ছে না। থিয়েটারের মঞ্চে জিনিস খোঁজার মত খুঁজছে। সামনেই পড়ে,অথচ নাটকের প্রয়োজনে সারা মঞ্চ চষেও ” না পাওয়া ” হতে হবে। অবশ্য এটাওতো এক বিপুল মঞ্চে কোটি কোটি টাকার টিকিটের নাটক!
সব কাজ সারা হলে হাত ভালো করে ধুয়ে ফেলে মুখ্যমন্ত্রী নাটকের দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করলেন, হাইকোর্টে যাবজ্জীবন নয়,ফাঁসি চাই। কারণ তিনি নাকি শান্তি পাচ্ছেন না। ঠাকুর ঘরে কে রে? আমিতো কলা খাই না। আসলে মৃত অভয়ার প্রমাণ ভরা শরীরটাকে লোপাট করতে পারলেও জীবিত সঞ্জয়ের মস্তিষ্ক যে প্রমাণের খনি হয়ে বসে আছে! সমস্ত প্রমাণগুলো ওর শরীরের ভেতরে শ্বাস নিচ্ছে। ওর ভেতরে যেটুকু প্রাণ ধুকপুক করছে,সে যে ভয়ানক ক্ষমতা রাখে! এক লহমায় এই বাংলার রাজ্যপাট উল্টে দিতে পারে।
সততা,মানবিকতা আর সাহসিকতা যে চিরন্তন। তাই এখনও কোন কোন বিচারক যাদের কাচের ঘরে ঢোকানো সম্ভব হয়নি, তাঁরা কিন্তু খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছেন পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনার সামঞ্জস্য গুলো। তাঁদের দিকে চেয়েই আজ বসে আছে বাংলার সংবেদনশীল, হৃদয়বান ও প্রতিবাদী মানুষ। আমাদের সবার জেনে যাওয়া প্রকৃত সত্যের গায়ে সরকারি সীলমোহর পড়বে কিনা?!
কাঁচের বাইরে থাকা ওই বিচারকরাই আমাদের ভরসা। কি সুন্দর লিখেছেন পুণ্যদা। আমি মুগ্ধ। যতজন কে পারি এ লেখা আমি শেয়ার করব, পড়াব। প্রণাম নেবেন।
এটা আমার লেখা নয়। মনোরোগবিদ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা।
হ্যাঁ, ছবিটা দেখে একদম আপনার মত লেগেছে। খেয়াল করিনি নামটা। Sorry। কিন্তু লেখাটা অসাধারণ লেগেছে।
বাসে বসে পড়ছিলাম। একঝলকে ছবিটা দেখে আপনারই মনে হল। আসলে content টা এত মন দিয়ে পড়ছিলাম যে author কে সেটা ভালো করে দেখা হয়নি। Sorry দাদা।
mookerjeashyamol@gmail.com