দিন আসছে! আমাদের জন্য বরাদ্দ দিনটি বছর ঘুরে আবার আসছে! টিভি, নিউজ পেপার, এমনকি মোবাইলেও শাড়ি, গয়না, কসমেটিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন জুড়ে শুধুই আমরা! আমরা মানে সমাজের সেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। যাদের সমাজের প্রথম শ্রেণির নাগরিকেরা গর্ব ভরে বলেন, “আমি তো বৌকে কোনও কিছুতে বারণ করি না। ওকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছি।” কিংবা “আমি কিন্তু ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনও বিভেদ করিনি। ছেলের মতো মেয়েকেও পড়িয়েছি। ওকেও চাকরি করতে দিয়েছি।” ব্যাপারটা এমন, যা স্বাভাবিক, যা হওয়ারই ছিলো, সেটা হচ্ছে, এটাই মহান ব্যাপার।
এই যেমন ফেসবুক স্ক্রোল করতে করতে একটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট কিট কোম্পানির বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো। ব্যাপারটা এমন, এক প্রশাসনিক কর্তা কোলে ছোটো বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। দুধের বোতল থেকে ছোট্ট বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছেন। সামলাতে না পেরে, বোতল থেকে দুধ পড়ে যাচ্ছে। তাঁকে চিনতে না পেরে আরেক ভদ্রমহিলা তাঁকে গৃহবধূ বলে টিপ্পনি কাটলেন। তারপরে এক মহিলা পুলিশ কর্মীর কথায় বুঝতে পারলেন, তিনি এক উঁচুপদের পুলিশ কর্তা। ওই টেস্ট কিট কোম্পানি বিজ্ঞাপন বার্তা, ওরা মেয়ে। ওরা ঘর-বাইরে সব সামলাতে পারে। ওরা সবকিছু পারে! ওদের কাঁধ অনেক চওড়া! ইত্যাদি ইত্যাদি!
শুধু ওই একটি কোম্পানি নয়। সোনার গয়না থেকে শাড়ি, ল্যাপটপ থেকে ওষুধের কোম্পানি, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আগে প্রায় সব কোম্পানিই এমন একখানা বার্তা দিতে চান। হাসি মুখে একটি মেয়ে ঘরে-বাইরের সব দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পালন করছেন। একজন “পারফেক্ট মহিলা”-র সংজ্ঞা।
আজ্ঞে না! আমরা সব পারি না। আমরা সব পারতে চাই না! এই অনাবশ্যক সুপার হিউম্যান বানানো এবার বন্ধ হোক। মেয়েদের বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে অনেক সময় আদর করে বলা হয়, তুমি মা দূর্গার মতো হয়ে ওঠো। দশ হাতে সংসার সামলিও। শুনতে ভালো লাগলেও, আসলে কিন্তু তার কাঁধে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর বোঝা বইবার সময় যাতে টুঁ শব্দও না করে তাই তার বোঝাকে একটা গৌরব গাঁথায় মুড়ে দেওয়া হয়।
আসলে, গৌরবের খামে না ঢোকালে যে বোঝা চাপানো বেজায় কঠিন। এই ধরুন, আগে বাড়ির কাজ মূলত মেয়েরা করতো। এখন শিক্ষার প্রসার, দীর্ঘ লড়াই করে বহু মেয়ে বাইরেও কাজ করেন। কিন্তু তার মানে এই নয়, তাঁরা ছেলেদের মতো সমান সমান সংসারে গুরুত্ব ও দায়িত্ব পান। সংসারের অধিকাংশ কাজের দায়িত্ব এখনো মেয়েদের ঝুলিতেই থাকে। যাকে আমরা আবার গল ভরা কথায় বলি, ‘সংসারের রাশ হোম মিনিস্টারের হাতে’। এসব না বললে চলবে কি করে!
অফিস থেকে ফিরে গৃহকর্তা রাতের খাবার গরম করবে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা দেখবে, খাওয়াবে! গৃহ সহায়িকা না আসলে হাফ বেলা ছুটি নিয়ে বাসন মাজবে! ঘর পরিষ্কার করে হাঁপাতে হাঁপাতে অফিস যাবে! আর বৌকে বলবে, আগের বার তো তুমি করলে, এবার আমি সামলে নিচ্ছি। ধুস! কেমন কমেডি সিরিয়ালের দৃশ্যের মতো শোনাচ্ছে না! আসলে এরকম একেবারেই হয় না।
ছেলেমেয়েদের নম্বর কম হলে কিংবা যদি সংসারের দায়িত্ব সামলানো নিয়ে যদি কোনও প্রশ্ন ওঠে, প্রথম কথাই হয়, “তোমার তো চাকরি করার দরকার নেই! কেন করো!”
ব্যাপারটা এমন, ছেলেদের চাকরি দরকারি আর মেয়েদেরটা বিলাসিতা! আসলে পারিবারিক বা সংসারের দায়িত্ব যে আসলে দুজনের এই বোধদয় হতে হতে বহু মহিলার কর্মজীবন শেষ হয়ে যায়!
আগে মেয়েরা শুধু বাড়ির কাজ করতো। এখন বাইরের কাজও করে। তাদের শারীরিক পরিশ্রম বাড়ছে। বিশ্রামের সময় কমছে। এমনকি সময়মতো খাওয়া টুকুও হয় না। অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস আর ঘুম নানান রোগের বিপদ ডেকে আনছে। হার্টের রোগ, হাড়ের রোগ, সুগার, কোলেস্টেরল বাড়াচ্ছে। আগে যখন অধিকাংশ মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতা ছিলো না, তখন শেখানো হতো, বাড়ির সকলের আগে খাবার খেলে তিনি অলক্ষ্মী। এখন তার সঙ্গে এটাও শেখানো হয়, তুমি তো বাড়িতে বেশি সময় দিতে পারো না। যেটুকু বাড়িতে থাকো, তখনো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে, আর সংসার করার দরকার কি বাপু! ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, তার বাইরে অর্থ উপার্জন করতে যাওয়াটা একটা অপরাধের সমান। তাই নাওয়া-খাওয়ার সময় ভুলে সেই অপরাধ খণ্ডনের জন্য যেটুকু সময় বাড়িতে থাকবে, পুরোটা সংসারে ঢেলে দিতেই হবে। আর এই ঢেলে দেওয়ার ফলে ভারতে প্রতি তিনজন মহিলার মধ্যে একজন গুরুতর হাড়ের সমস্যায় ভোগেন। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মেয়েদের মধ্যে ৫১ শতাংশ রক্তাল্পতায় ভোগেন। শুধুমাত্র আর্থিক সমস্যাই নয়, এ দেশে মহিলাদের পুষ্টির অভাবের সমস্যার পিছনে থাকে নানান সামাজিক রোগও।
শুধু শরীর নয়, মনের উপরেও চাপ পড়ছে। মেয়েদের মানসিক অবসাদ বাড়ছে। কারণ, তাদের যে যত্নের বড় অভাব। একটা গাছ যেমন অযত্নে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়, তেমনি কিন্তু দিনের পর দিন একাধিক চাপ সামলাতে গিয়ে, নিজের প্রতি যত্নের নূন্যতম সুযোগ থাকছে না। সম্প্রতি একাধিক তথ্য জানাচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে অবসাদ বাড়ছে। উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। ভারতের মনরোগ বিশেষজ্ঞদের এক পত্রিকায় বলা হয়েছে, এদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলারা পুরুষদের দ্বিগুণ বেশি মানসিক রোগের ভোগেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা হয় না। এরপরের উদাহরণটা দিই বিশ্বের উন্নত দেশের। আমেরিকার ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিস্টিক্স-র রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালের সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে, পুরুষদের তুলনায় মহিলারা দ্বিগুণ বেশি মানসিক অবসাদে ভোগেন। ২০-বছরের উর্ধ্বে মহিলারা ধারাবাহিকভাবে প্রতি দু’সপ্তাহ অন্তর অবসাদের সমস্যার শিকার হন। ১০ শতাংশের বেশি মহিলা নানান পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের সমস্যার জন্য মানসিক রোগের শিকার হন। সেখানে পুরুষরা শতাংশে হিসাবে ৫.৫ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বেগের সঙ্গে জানিয়েছেন, অবসাদে ভোগার ঝুঁকি পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ৫০ শতাংশ বেশি থাকে। তবে, মনে রাখতে হবে, যে টুকু জানা গিয়েছে, তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রেগে যাওয়া, অবসাদের মতো সমস্যাগুলোকে আমরা ‘পাগল’, ‘বদমেজাজি’-র মতো তকমা দিয়ে এড়িয়ে যাই। যার ফলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হয় না।
এবার অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই যে বাড়ির ও বাইরের দায়িত্ব মহিলারা সামলাচ্ছেন, সর্বদা কি তাদের মাথায় বন্দুক ধরে করানো হচ্ছে। না করলে কি তাদের মারধর করা হবে? আজ্ঞে না! সব কাজ কি মাথায় বন্দুক ধরে করাতে হয়? আমাদের বড় হয়ে ওঠার পথে এগুলো মস্তিষ্কের ভিতরে গেঁথে দেওয়া হয়। আর সবার উপরে যে কথাটা আমরা বিশ্বাস করতে চাই, “সংসারে শান্তি বজায় থাকুক!” এমন ‘শান্তি’, যা কেউ জন্মেও চোখে দেখতে পায় না।
বিজ্ঞাপন অথবা টিভি শো রাতারাতি তো কিছুই বদলে দিতে পারবে না। সম্ভবও না। কিন্তু, তাঁরা বদলের কথা বলেন। হয়তো নাম কিনতে চান। জিনিস বেশি বিক্রি। এটাই তো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। তা বেশ। জিনিসপত্র বিক্রি হলে তো বেশ ভালোই। তা যখন ভালো হওয়ার চেষ্টা করছেন একটু সত্যিই ভালো হয়ে উঠুন না! এই যে অযাচিত ভার চাপানোর চেষ্টাটা বন্ধ করুন। দেখান না, আর্থিক বা পারিবারিক ছেলেমেয়ে দুজনেই ভালোবেসে ভাগ করে নিলে দুজনে ভালো থাকবে!
এই করোনা তো কম দেখালো না। জীবন তো বড় ক্ষণস্থায়ী! একটু ভালো থাকতে চাই! খুব বেশি চাইছি কি!!!
এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে, নারী দি-বস কিংবা সব জায়গায় ভগবান পাওয়া যায় না, তাই মা পেয়েছি, এই সব আবোলতাবোল না বকে আমরাও দু-পা হাতের প্রাণী, যাদের একটি মস্তিষ্ক, একটি হৃদয় আছে– এটুকু সহজ কথা ভাবতে শিখলেই অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হবে।