“সবার সামনে আমার পরিচয় করাতে গিয়ে আমার শ্বশুরমশাই অস্বস্তিতে পড়তেন। আমার খারাপ লাগত। শ্বশুরমশাই মানুষ চমৎকার। ব্যতিক্রমী রকমের সৎ। আত্মসম্মানবোধ দারুণ। আপাদমস্তক ভদ্রলোক।
বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। বিয়েবাড়ি বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে। কখনও ক্লাবে। পরিচয় করিয়ে দিতেন, এই যে, রাজশঙ্কর, আমার জামাই। কথাবার্তা গড়িয়ে আসত আমার পেশার দিকে। আরে দারুণ ব্যাপার, বাড়িতে একজন ডাক্তার রইল তাহলে! বসো কোথায়? কোন হাসপাতালের সঙ্গে এটাচড? আমি বলতাম, না, আমি তো জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করি।
সেটা ১৯৯২ সাল। জনস্বাস্থ্য বা পাব্লিক হেলথ শব্দটি তখনও খুব বেশি লোক জানত না। প্রশ্ন আসত, সেটা ঠিক কী? আর কথোপকথনটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠত। এতক্ষণের মিষ্টি হাসি আলাপচারিতা বদলে যেত ভ্রূকুটি আর ঈষৎ সন্দিহান মনে।
একের পর এক সামাজিক অনুষ্ঠানে ঘটত এই একই অস্বস্তি।
এমনই এক বিয়েবাড়ি যাওয়ার পথে শ্বশুরমশাই জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তুমি ঠিক কী করো সেটা একটু বুঝিয়ে বলবে আমায়? আমি তাঁকে বলতে থাকলাম। জনস্বাস্থ্য। টিকাকরণ। গুটি বসন্ত। স্বাস্থ্যবিধি। স্বাস্থ্যবিধান। ইত্যাদি। প্রভৃতি। তিনি শুনলেন। মন দিয়ে শুনলেন।
বিয়েবাড়ি পৌঁছানোর মুখে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আমি যদি বলি যে তুমি গবেষণা করো, সেটায় কি ভুল বলা হবে? আমার মনে হয়, সেটা সবাই বুঝবে। গড়পড়তা বাঙালির রিসার্চারদের প্রতি একটা সম্ভ্রমের বোধ আছে। গবেষক মাত্রেই জ্ঞানীগুণী, এমনটাই ভাবে সবাই। আমি হেসে ফেললাম। লোকটার জন্য মায়া হচ্ছিল, কেননা আমি সত্যিই ওঁকে ভালোবাসতাম। বেচারা এমন জামাই বেছেছেন, যার পেশাটাই এমন গোলমেলে! বললাম, আচ্ছা, তাই বলুন তবে।
ওই রিসার্চার শব্দটাই হিট করে গেল। কেউ জিজ্ঞেসই করল না, আমি রিসার্চ করি ঠিক কী নিয়ে। এই যে রাজশঙ্কর, ডাক্তারি পাস করে রিসার্চ করে, শ্বশুরমশাইয়ের মুখে এটুকু শুনেই সবাই এসে পিঠ চাপড়ে দিত। আহ্, রিসার্চ! দেশে গবেষকের সত্যিই খুব দরকার। তুমি নিশ্চয়ই ছাত্র হিসেবে ব্রিলিয়ান্ট!!”
নিজের শুরুর দিকগুলোর কথা বলেছেন ডাঃ রাজশঙ্কর ঘোষ। ডাক্তারি পাস করার সময় থেকেই যিনি পাব্লিক হেলথ নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। করেছেন। করছেন। হেলথ সেন্টার থেকে শুরু করে ভারত সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিভিন্ন জনস্বাস্থ্য ও টিকাকরণ প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। তেরটি দেশে এনকেফেলাইটিস টিকাদান কর্মসূচির দেখভালের দায়িত্ব পালন করেছেন। আপাতত বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের টিকাকরণ বিভাগে এদেশের অন্যতম প্রধান।
ছোট্ট ছোট্ট লেখার মিশেলে তৈরি হওয়া ছোট্ট বই এটি। কিন্তু বইয়ের সাইজ দেখে তার ধার ও ভার আন্দাজ করতে গেলে ভুল হবে। অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রায় প্রতি পাতায়। এককালে এক বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ছিল, অনুভব করেছি, তাই বলছি। এ বই ঠিক তেমন। বইখানার পাতা ওল্টালেই স্পষ্ট, এ কোনও নিজের পরিসরে বসে নিখাদ তাত্ত্বিক চর্চার (যদিও তেমন চর্চাও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত হড়বড় করে যে করেই হোক কিছু করে ফেলার বাজারে, ‘থিংক রিফ্লেক্ট অ্যান্ড ওনলি দেন অ্যাক্ট’ শিক্ষা হিসেবে দিনকে দিন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে) ফসল নয়, এ বই পুরোদস্তুর প্র্যাক্টিকাল এক্সপিরিয়েন্স সঞ্জাত। এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হল, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলা হয়েছে গল্পের মাধ্যমে। লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার গল্প।
যেমন ধরুন, প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সরকারি জনস্বাস্থ্য প্রকল্পকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে গিয়ে, পেশাজীবনের একেবারে শুরুর দিকেই, লেখক অভিজ্ঞ সহকর্মীর কাছে শেখেন কয়েকটা শব্দবন্ধ, যে শিক্ষা তিনি আজও মনে রেখেছেন।
“সহজ কথা।
স্পষ্ট কথা।
স্বল্প কথা।
সত্যি কথা।”
এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ‘কথা’ অর্থাৎ কথোপকথনের গুরুত্ব অসীম।
বৃহৎ জনস্বাস্থ্য প্রকল্পকে (বা যেকোনো প্রজেক্টের ক্ষেত্রেই) সফল করতে হলে টিমলিডারের জন্য সদাস্মরণীয় কথাগুলোও তিনি জেনেছেন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই –
কাদের নিয়ে কাজ করছ, মানুষগুলোকে চেনো।
সহকর্মীদের যথাসাধ্য সম্মান দিও।
ধৈর্য হারিও না।
অকারণ প্রতিশ্রুতি দিও না।
এবং লিডারশিপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু শব্দও –
লিসন – যে নেতা টিমের বাকিদের কথায় কর্ণপাত করেন না, তিনি নেতা-ই নন।
লিভারেজ – টিমের বাকিদের শক্তি-দুর্বলতাকে জেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী তাদের ব্যবহার করো।
লিড – পরিস্থিতি অনুযায়ী টিম-কে লিড না করতে পারলে তিনি আর কীসের লিডার!
লিগ্যাসি – কাজ করতে করতেই পরের লিডারকে তৈরি করে যাওয়াও তো লিডার-এর দায়িত্ব।
আবারও লেখকের চাকরিজীবনের শুরুর দিকে ফিরি। সেটা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়। লেখক তখন আলিপুরদুয়ারের এক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তিনজন মেডিকেল অফিসার। দুজন অ্যালোপ্যাথ (লেখকই এই শব্দ ব্যবহার করেছেন), একজন হোমিওপ্যাথ।
রোগী মোটামুটি তিনরকম। প্রথম দলের জ্বর। যাদের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কর্তব্য ম্যালেরিয়ার সম্ভাবনা যাচাই করে নেওয়া। দ্বিতীয় দলের সমস্যা অম্বল-গ্যাস। আদতে পায়খানার সমস্যা, কিন্তু সেই কথাটা ডাক্তারবাবুদের কেউ মুখ ফুটে বলেন না। ডাক্তারবাবুদের বুঝে নিতে হয়। মূলত আমাশা। সেই চিকিৎসাতেই কাজ হয়ে যায়।
তৃতীয় দলের সমস্যা অন্যরকম। গা-ম্যাজম্যাজ থেকে ঘুম না হওয়া, বা দুর্বল হয়ে পড়া, অথবা ক্ষুদামান্দ্য। ব্লাড প্রেশার, ব্লাড সুগার ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। ভিটামিন আয়রন ইত্যাদি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই রোগীরা বারবার ফিরে আসেন। অনেকসময় সপ্তাহে দু’তিনবারও।
লেখক বোঝেন, এঁদের যা সমস্যা তার ওষুধ নেই। অসুখের নাম একাকিত্ব। এঁরা একটু কথা বলতে চান। চান, কেউ তাঁদের কথা মন দিয়ে শুনুক।
কিন্তু অ্যালোপ্যাথি টেবিলে খুব ভিড়। হোমিওপ্যাথি টেবিল তুলনায় অনেক খালি। লেখক এইধরনের রোগীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ দেবনাথের কাছে পাঠাতে শুরু করলেন।
ডাঃ দেবনাথের অসুখের প্রতি অ্যাপ্রোচটাই আলাদা। তিনি এঁদের নিজের পাশে বেঞ্চে বসান। মন দিয়ে তাঁদের কথা শোনেন। হাত ধরে বসিয়ে ধৈর্য ধরে শোনেন। কখনও হয়ত সঙ্গে নিয়ে গাছতলায় হাঁটিয়ে নিয়ে আসেন। মাঝেমধ্যে কাগজের পুরিয়া করে কিছু ওষুধ দেন।
তার পর থেকে সেই রোগীরা আর কখনোই অ্যালোপ্যাথদের কাছে আসেন না। সটান চলে যান ডাঃ দেবনাথের টেবিলে। লেখক জিজ্ঞেস করলে উত্তর পান, না না, আমরা দেবনাথদাকেই দেখাব। লেখকের উপলব্ধি –
“ডাঃ দেবনাথ এখন তাদের প্রিয় দেবনাথদা। যিনি শুশ্রূষা দেন, রোগের উপশম জোগান। আমরা শুধুই ডাক্তারবাবু। ওষুধ প্রেসক্রাইব করি।”
ডাঃ রাজশঙ্কর ঘোষ জনস্বাস্থ্যের কথা-ই লিখেছেন এ বইয়ে, কিন্তু এই ছোট্ট ছোট্ট অবজারভেশনের গুরুত্ব শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্যের পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্রমশ বিজ্ঞানভিত্তিক হয়ে ওঠা গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই (এবং সেই সুবাদে বাকি চিকিৎসাপদ্ধতির প্রান্তিক হয়ে ওঠাও, সম্ভবত, অনিবার্য), কিন্তু সেই বিজ্ঞানমুখীনতা কি কোনও এক জায়গায় চিকিৎসাকে উত্তরোত্তর নৈর্ব্যক্তিকও করে ফেলছে না? রোগীর শুশ্রূষার চাইতে রোগটিকে ধরে পেড়ে ফেলার দুর্মর মনোবাঞ্ছাই কি চিকিৎসাব্যবস্থায় সর্বময় হয়ে যাচ্ছে না??
প্রশ্নটা সরল হয়ত। কিন্তু উত্তরটা জটিল, সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর তো প্রায় অসম্ভব।
রোগীর কথা শোনার মধ্যেই রোগের উপশমের নির্ভুল দিকচিহ্ন লুকিয়ে থাকে – এ শিক্ষা চিকিৎসাবিদ্যার মূল। তবু তা কি সবসময় মনে থাকে ডাক্তারবাবুদের?
ডাঃ রাজশঙ্কর ঘোষের সঙ্গে এই বইয়ে জুড়িদার ডাঃ কৌশিক ঘোষ। কৌশিক অসুস্থতার গল্প বা ইলনেস ন্যারেটিভস নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তিনি কৃতি ফটোগ্রাফার। ফটোগ্রাফের মধ্যে দিয়ে তিনি গল্প বলেন। রোগীর গল্প। অসুস্থতার গল্প। চিকিৎসা ও শুশ্রূষার গল্প। বিলেতের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির গ্র্যাজুয়েট ইমেজিং সায়েন্টিস্ট ইন মেডিকেল অ্যান্ড সায়েন্টিফিক ফটোগ্রাফি স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় ফটোগ্রাফার তিনি। তাঁর তোলা বেশ কিছু ছবি এই বইয়ে আছে – যা এ বইয়ের সম্পদ।
বইমেলার বাজারে এই বইয়ের কথা বলছি বটে, কিন্তু বইটি কোথায় পাওয়া যাবে জানি না।
এমন বই যে কেন বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয়-বণ্টনের ব্যবস্থা হয় না, বলা মুশকিল!!
লেখকদ্বয়ের কাছে প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা অনেক, কিন্তু বৃহত্তর পাঠককে বঞ্চিত করার কারণে অনুযোগ তার চাইতে কম কিছু নয়।
Public Health – Musings & Anecdotes
Twenty Stories from the Journal of
Dr. Raj Shankar Ghosh
Photographs
Dr. Kaushik Ghosh
(উদ্ধৃত অংশগুলোর বাংলা তর্জমা আমার।)
সঙ্গের ছবিটি এই বইয়ের সম্পদ।
কোভিডের ঢেউ সরে যাচ্ছে। আর নতুন করে শুরু হচ্ছে দেশের টিকাকরণ কর্মসূচী। অপসৃয়মান নোনাজলের মধ্যে ভেসে ওঠা বাস্তবতার বালিয়াড়ি দিয়ে হেঁটে চলেছেন টিকাকর্মীরা। এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি। প্রতীকীও। ইতিহাসের ডকুমেন্টেশন।