ভোর পাঁচটার সময় ঘুম থেকে ওঠা এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। ভারতী মণ্ডল যবে থেকে ভারতী সিং হয়েছে তখন থেকেই বদলের শুরু। বিয়ের পর জোড়বাঁধা মানুষটাকে আপন করা। তিন সন্তানের জন্ম দিয়ে লালন করা। আর স্বামীর কাজের সুবাদে বিহারের গ্রাম ছেড়ে কলকাতা শহরের ছোট্ট ঘরে নিজের সংসার করতে গিয়ে দিন রাতের ফারাক কবেই ঘুচে গেছে। শরীর অবশ্য সায় দেয় নি। মাস দুই আগেই প্রেসারের সমস্যা ধরা পড়ে। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন যাপনের পরামর্শ ডাক্তারবাবু দিলেই যে সমাধান হবে তা তো নয়। নোটবন্দীর পর থেকে মানুষটার হাতে তেমন কাজ নেই। কলকাতা শহরে থেকে তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা আর পাঁচটা পেট চালাতে একজন মানুষকে কতোটা পরিশ্রম করতে হয় তা ভারতী জানে। নিজেও কোনোভাবে আর্থিক সাহায্য করতে না পারার খেদ অন্তরকে বিদ্ধ করে। তাইতো সাংসারিক পরিশ্রমে নিজেকে উজাড় করে দিতে কসুর করে না ভারতী।
এবারের ছটপুজোয় কয়েকদিন আগেই বড়ো ভাসুরের শ্রাদ্ধ উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে সপরিবারে যেতে হয়েছিল। ক্যান্সারের কারণে তাঁর যন্ত্রণাদায়ক অকালবিয়োগের ঘটনা শুনে হাহুতাশ করেছে খুব। প্রচুর টাকাও খরচ হয়ে গেছে।
ছটপুজোর আগের দিন দুপুরের খাওয়া সেরে বাড়ির অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে দাওয়ায় চুল আঁচড়াতে বসেছিল। সদ্য প্রয়াত বদরাগী ভাসুরের কথাই বেশি করে মনে পড়ছে। হম্বিতম্বিতে ভাইদের মধ্যে সেরা। পান থেকে চূন খসার জো ছিল না। অবশ্য রান্নার ভুলত্রুটি হলে তেমন রাগ করতেন না। হাতের পাঁচ বলে মেনে নিতেন। এই দাপুটে ভাসুরকেই শেষ দিনগুলোতে অবহেলা সইতে হয়েছে।……..
ভাবনার রেশ কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গিয়েছিল কেউ জানে না। ভারতীর মেজো জা তাকে একদৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে যেই না ডেকেছে গম্ভীর গলায় ভারতী তাকে এমন ধমক দিলো যে তার আক্কেল গুড়ুম। বড়ো ভাসুর যেমন করে বকাঝকা দিতো অবিকল সেই রকম হাবভাব। এরপর বাড়িময় শোরগোল পড়ে গেল। বিশু ভকত কে ডাকা হল। সে এই এলাকায় নামকরা গুনিন। বাচ্চাদের হাওয়া বাতাস লাগলে তার জলপড়াতেই সারে। তার কবজের গুণ লোকমুখে ফেরে। কিন্তু তার দ্বারা সমাধান হলো না। বিশু ভকতের পরামর্শে মোটরসাইকেলে করে আনা হলো আরও বড়ো গুনিনকে।
ততক্ষণে গ্রামের বাচ্চা বুড়ো সবাই হাজির। উঠানে চূন দিয়ে গোল করে গণ্ডি কাটা হয়েছে। গণ্ডির ভিতরে একটা মড়ার খুলি সামনে রেখে বসে আছে গুনিন। চারপাশে নানান উপাচার। মন্ত্রপাঠের সাথে নানান কেরামতি দেখিয়ে চলেছে। বড়ো ভাসুরের নাম ধরে তুই-তোকারি করে ডাকলে ভারতী সাড়া দিচ্ছে। গুনিনের লেকচার শুনে সবাই নিশ্চিত যে ভারতীর ওপর এখন তার বড়ো ভাসুরের আত্মা ভর করেছে। ভারতীকে ঝাঁটাপেটা করছে, জুতো নাকে ঘসছে, চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনী দিচ্ছে। এতেই নাকি ভাসুরের প্রেতাত্মা পালিয়ে যাবে। গ্রামের লোক সেই মজা দেখছে। শেষে একটা জলভরা কলসি রাখা হলো ভারতীর সামনে। গুনিনের নির্দেশ মতো ওটা দাঁতের কামড়ে তুলে নিয়ে ভারতী ছুটে চললো লম্বা উঠোন বরাবর। তারপর ধপাস করে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো। ভুত ছেড়ে গেছে মনে করে ভিড় পাতলা হতে লাগলো। জলের ঝাপটা, পাখার বাতাস পেয়ে ভারতী চোখ মেলে তাকায়। সারা শরীরে ব্যথা, মাথা ভার লাগছে। সবার চোখে জিজ্ঞাসা অথচ ভারতীর কিছুই মনে নেই। লজ্জা পেয়ে অবিন্যস্ত পোষাক ঠিক করতে মনযোগ দেয় সে।
আমজনতা যাকে ‘ভুতের ভর’ বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে তা ‘মানসিক রোগ’। অন্ধবিশ্বাসের আবহে বেড়ে ওঠা মানুষদের মধ্যেই এই ভুতে ধরার প্রকোপ দেখা যায়। অভাব, অতৃপ্তি, ক্ষোভ, বেদনা, বঞ্চনা, অবহেলা প্রভৃতি মানসিক যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশের ফলে ‘ভূতের ভর’ হয়। রোগীর অবচেতন মন তার অবদমিত ইচ্ছা প্রকাশের সুযোগ পেয়ে যায়। অন্ধবিশ্বাসের ফলে এই অবস্থাকে রোগ না ভেবে ‘ভূতের ভর’ মনে করে ওঝা-গুনিন ডাকা হয়। একই ঘটনা মুসলিম পরিবারে হলে ‘জিনের ভর’ বলে অভিহিত হয়। ওঝা-গুনিনের কেরামতির পর একসময় রোগী রোগমুক্ত হয়। তখন তা মন্ত্র-তন্ত্রের গুণেই হয়েছে বলে মনে করা হয়। আসলে বিশ্বাসের ফলে এই সমস্যার উদ্ভব হয় বলেই বিশ্বাসের দ্বারাও এর পরিসমাপ্তি ঘটার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এই ব্যবস্থার কুফল সম্পর্কে মানুষ উদাসীন থাকে। ওঝা-গুনিনকে প্রশ্রয় দিলে রোগীর শ্লীলতাহানি থেকে মৃত্যু সবকিছুই মেনে নিতে হয়। ‘ভূতের ভর’ আসলে সামাজিক ব্যাধি। দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন, ব্যাপক শিক্ষার বিস্তার, সমাজ সচেতনতা এবং ভুত-জিন-ঈশ্বর বিশ্বাসের কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে না পারলে ‘ভর’ এর চিকিৎসা পুরোপুরি সম্ভব নয়।